
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে কারা অর্থ জমা রেখেছেন এবং এসব অর্থের উৎস কী তার খোঁজে আটঘাট বেঁধে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানো হবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করবেন বলেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে। সুইস ব্যাংকে অর্থ কারা রেখেছেন, এসব অর্থের উৎস, সুইস সরকার ও সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সঙ্গে যোগাযোগ, সংশ্লিষ্ট দেশে ল ফার্ম নিয়োগ, আইনি পদক্ষেপ গ্রহণসহ এ বিষয়ে সব কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটিকে।
এ কমিটিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), সিআইডি, পররাষ্ট্র, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এরই মধ্যে এ কমিটি বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানের পাচারের অর্থ ফেরত আনতে কাজ করছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের খোঁজে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবে। এ বিষয়ে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তি। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সরকার পরিবর্তন হয়। যারা গত ১৫-১৬ বছর দুর্নীতি করে অর্থ জমিয়েছেন তারাই এ পাচারের সঙ্গে জড়িত- এমন ধারণা সামনে রেখে অনুসন্ধান করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারা পাচার করেছেন, এসব অর্থের উৎস কী তা দেখা হবে। পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
এরই মধ্যে সরকারপ্রধান সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, জনগণের অর্থ লুটপাট করে পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ফেরত আনা হবে।
সূত্র জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সুইজারল্যান্ড সফরকালে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক হয়েছে কি না, তার খোঁজ নেওয়া হবে। এ ছাড়া এ সময়ে সুইস ব্যাংকের কোনো ধরনের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
এর আগে ভারত সুইস ব্যাংক থেকে সে দেশের অর্থ পাচারকারীদের একটি তালিকা আনতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজ নেবে।
সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যক্তি ও ব্যাংকগুলোর রাখা জমা অর্থের পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে ৩৩ গুণ বেড়েছে। ২০২৩ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ (সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা) জমা থাকলেও বছরের ব্যবধানে তা এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কোটি কোটি সুইস ফ্রাঁ (সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা) জমা আছে সেটি আগেও প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু এবারের সময়টি ভিন্ন। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সে সময়ের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদ নিরাপদে রাখতে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। অর্থাৎ, বর্তমান সরকার সম্ভাব্য তদন্তের আগে ঝুঁকি এড়াতে আয়-সম্পদের নিরাপদ রাখার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংককে নিরাপদ মনে করতে পারেন।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থ স্থানান্তর হয়ে সুইস ব্যাংকে জমা করা হয়েছে কি না, তার খোঁজও নিতে হবে। সরকার বদলের পর পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও সুইস ব্যাংকে এক লাফে বাংলাদেশিদের এত অর্থ বৃদ্ধির ঘটনা পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় না। কীভাবে এত অর্থ গেল, তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশে থাকা সম্পদ সম্পর্কে বাধ্যতামূলক বার্ষিক ঘোষণা চালু করতে পারে। যেমনটি ভারত ও মালয়েশিয়ায় করা হয়। ঘোষণা না করলে সম্পদ বাজেয়াপ্তর বিধান আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হুন্ডি, ওভার-ইনভয়েসিং, আন্ডার-ইনভয়েসিং-এসব অবৈধ রপ্তানি/আমদানি লেনদেনে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। এ জন্য এনবিআর, ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং কাস্টমসকে একীভূতভাবে ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার করতে পারে। অনেক সময় অর্থ পাচারকারীরা প্রভাবশালী হয়। এ জন্য সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হতে পারে- যেটি স্বাধীনভাবে তদন্ত করে, নাম প্রকাশ করতে পারে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সুইজারল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পেতে হলে বাংলাদেশের উচিত অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) এ সম্পর্কে সম্পৃক্ত হতে হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিবছর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের অ্যাকাউন্টের তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য হবে।
সাবেক তত্ত্বাধবায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এবং সেগুলো বিদেশে পাচার হওয়া বন্ধ করতে সরকারকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আদালতকে আরও স্বাধীন করতে হবে। তাদের কাজের দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেও সরকার পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে পারে।