
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বাস, ট্রাক, মিনিবাসসহ প্রায় সব ধরনের গণপরিবহনে কর বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি গাড়ির আসন অনুযায়ী, সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৫০০ এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে গণপরিবহন খাতে সর্বনিম্ন কর ৪ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। গড়ে সর্বনিম্ন কর বেড়েছে ৩০ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৯২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্ধিত কর কার্যকর হলে যাত্রীদের ভাড়া বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে পণ্য পরিবহনের খরচ। কারণ কর বাড়ানোর ফলে পরিবহনের মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেবেন। পরিবহন খরচ বাড়লে এর প্রভাব সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে পড়বে। বিরূপ প্রভাব দেখা দেবে ব্যবসা-বাণিজ্যে। দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে। ফলে মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ ষখন দিশেহারা, তখন গণপরিবহন খাতে নতুন করে কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। বর্ধিত এই করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। বাজেটে এই পদক্ষেপকে ‘অযৌক্তিক ও গণবিরোধী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা।
অন্যদিকে পরিবহন-মালিকরা বলেছেন, এই খাতে লুব্রিক্যান্ট, ইঞ্জিনসহ অনেক যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়। আড়াই বছর আগে এক ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২২ থেকে ১২৩ টাকা। ফলে গণপরিবহন খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের আয় কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাড়তি কর দেওয়া সম্ভব নয়। কর বাড়ানোর ফলে প্রকারান্তরে, যাত্রীদের ওপর চাপ আসবে। তাই বাড়তি কর প্রত্যাহারে দাবি জানিয়েছেন তারা।
উল্লেখ্য, পরিবহন খাতে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে কয়টি নিয়ামক আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কর। এটি বেশি হলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়াও বেড়ে যায়।
গণপরিবহন খাতে সর্বশেষ কর বাড়ানো হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে। অর্থাৎ ছয় বছর পর কর বৃদ্ধি করা হলো।
এনবিআর সূত্র বলেছে, এই কর সমন্বয়ের সুযোগ আছে। পরিবহন-মালিকরা প্রতিবছর যে বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেন তার সঙ্গে তা সমন্বয় করা যাবে। কাজেই তাদের ওপর বাড়তি করের চাপ আসবে না। ভাড়াও বাড়ানোর কথা নয়।
পরিবহন খাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে কর আদায় করে তাকে বলা হয় ‘অনুমিত কর’ বা প্রিজাম্পটিভ ট্যাক্স। একে উৎসে বা অগ্রিম করও বলা হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, পরিবহন-মালিকরা তাদের প্রকৃত আয় দেখান না। তাই এনবিআর অনুমানভিত্তিক এই কর ধার্য করে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে পরিবহন খাত থেকে কর আদায় করে সরকার। কারণ এখানে সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে সহনীয় পর্যায়ে ধার্য করা হয়। অথচ সেই করও ঠিকমতো আদায় হয় না। অতীতে দেখা গেছে, কর বৃদ্ধি করলেই ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন আসে।
আন্দোলন-ধর্মঘটের হুমকি আসে। এ কারণে কোনো রাজনৈতিক সরকার কর বাড়াতে চায় না। ফলে এই খাত থেকে নামমাত্র রাজস্ব পায় সরকার। আয়কর আদায় বাড়াতে গণপরিবহন খাতে এবারের বাজেটে বাড়তি করারোপ করল অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এখন গণপরিবহন খাতে নিবন্ধন ফি, নবায়ন ফি ও সারচার্জ আদায় করে সরকার। তার সঙ্গে বাড়তি অনুমিত কর বা উৎস কর দিতে হয় মালিকদের। বছরে একবার এই কর আদায় করা হয়। নতুন বাজেটে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসহ মোট ১৩ ক্যাটাগরির পরিবহনে বাড়তি করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজ বলেন, বাড়তি করারোপের ফলে যাত্রীদের ভাড়া বাড়বে না। কারণ মালিকরা তাদের আয় থেকে এই কর দেবেন। তা ছাড়া আয়কর রিটার্নের সঙ্গে প্রযোজ্য কর সমন্বয়ের সুযোগ আছে। কাজেই মালিকদের ওপর চাপ আসবে না।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন-মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এ পরিস্থিতিতে আমরা ভাড়া বাড়াতে চাই না। সরকারের কাছে বর্ধিত কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। সরকার আমাদের আশ্বস্ত করেছে।’ তিনি আরও বলেন, বাড়তি কর তুলে না নিলে গণপরিবহন খাতে যে অচলাবস্থা তৈরি হবে, ‘তার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। আশা করছি বর্তমান সরকার আমাদের দাবি সক্রিয় বিবেচনা করবে।’
আপনাদের দাবি পূরণ না হলে কী করবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে পরিবহন খাতের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।’
বর্ধিত কর প্রত্যাহারের দাবিতে মালিক সমিতি এরই মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা, যোগাযোগ উপদেষ্টা, সচিবসহ এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এ ছাড়া ঈদুল আজহার আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে নতুন বাজেটে বাড়তি করারোপ নিয়ে আলোচনা হয় এবং বাড়তি কর প্রত্যাহার করা হবে বলে বাস-ট্রাক মালিক সমিতির নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে পরিবহন খাতে একটি কালো আইন রয়েছে। তা হলো দুঘর্টনার জন্য চালকের বিরুদ্ধে মামলা করার পর তার জামিন হয় না। আমরা এই কালো আইন বাতিল করতে বলেছি।’
এনবিআরের সাবেক সদস্য সামসুদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অন্য দেশের পরিবহন মালিকরা তাদের আয়ের ওপর প্রযোজ্য হারে কর দেন। আমাদের দেশে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে একটা ‘লাম্প-সাম’ কর আদায় করা হয়। সেই করও যথাযথভাবে আদায় করা হয় না। নিবিড় তদারকি করলে এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বাস আছে ৮৩ হাজার, ট্রাক ১ লাখ ৩০ হাজার, কাভার্ড ভ্যান ৪৫ হাজার, ট্যাক্সি ক্যাব ৩ হাজার, মাইক্রো বাস সাড়ে ৩ হাজার।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, বাজেটে বাড়তি কর বাড়ানোর ফলে ভাড়া বাড়বে। যার প্রভাব যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ওপর পড়বে। তিনি বলেন, সরকার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গণবিরোধী ও অযৌক্তিক। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে দিতে পারতাম। তখন বাড়তি করারোপের দরকার হতো না। নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নিশ্চিত না করে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপানো ঠিক হয়নি।
কর কত বাড়ছে
বর্তমানে ৫২ আসন বাসের কর ১৬ হাজার টাকা। নতুন বাজেটে এটি বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কর বাড়ছে ৫৬ শতাংশের বেশি। ৫২ আসনের নিচের বাসের জন্য বর্তমানে কর নির্ধারণ আছে ১১ হাজার ৫০০ টাকা। এটি বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে কর বাড়ছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। এসি বাসে বর্তমানে কর আছে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা।
এখানে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে কর বাড়ছে সাড়ে ৩৩ শতাংশ। দ্বিতল বাস ও এসি মিনিবাস কোস্টার ১৬ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই স্তরে কর বাড়ছে ৫৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কর বাড়ছে নন-এসি মিনিবাসের ক্ষেত্রে। বর্তমানে নন-এসি মিনিবাসের কর ৬ হাজার ৫০০ টাকা। এটি বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে সর্বোচ্চ ৯২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে।
পাঁচ টনবিশিষ্ট ট্রাক-লরির কর ১৬ হাজার টাকা থেকে এক লাফে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে ৮৮ শতাংশ কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেড় টন থেকে পাঁচ টনের পণ্য পরিবহন করে- এমন ট্রাকের কর ৯ হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৫৮ শতাংশ। দেড় টনের নিচের ট্রাকের ক্ষেত্রে ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
পিকআপ, ভ্যান ও হিউম্যান হলারের কর ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্যাক্সি ক্যাবের কর ১১ হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। কর বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া নন-এসি ট্যাক্সি ক্যাবের ক্ষেত্রে ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর বৃদ্ধির হার ৮৮ শতাংশ।