
গত বছরের ৫ আগস্টের আগেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লেখা বা প্রকাশ করা নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল। কী পেশাদার লেখক-সাহিত্যিক, কী ইতিহাসবিদ, সবাই যেন হয়ে গিয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা গবেষক’। অনেকে তাদের নিয়ে বই লিখতে পারলেই যেন নিজেকে ধন্য মনে করতেন। কিন্তু দিন বদলের পালায় এখন পুরো উল্টো চিত্র। বই লিখে বা প্রকাশ করে যারা স্বগর্বে জানান দিতেন, আজ তারাই ওই সব বই লুকিয়ে ফেলছেন অন্তরালে। বাদ যাননি বই ব্যবসায়ী বা লাইব্রেরিগুলোও। ৫ আগস্টের পর বইয়ের বাজার ও লাইব্রেরি থেকে উধাও হয়ে গেছে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা নানা ধরনের বই।
শুধু তা-ই নয়; দেশের সব সরকারি অফিস, প্রতিটি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব বই নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। নতুন পরিস্থিতিতে আজ একটি কর্নারও কোথাও নেই। জানা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর মূল্যায়নধর্মী শত বই প্রকাশের প্রকল্প গ্রহণ করেছিল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। শত লেখক এসব বই রচনা করেছিলেন। বইগুলো বাংলা একাডেমির বিপণনকেন্দ্র থেকে বিক্রি হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সেসব বই বাংলা একাডেমি থেকে উধাও হয়ে গেছে।
একাধিক লেখক, প্রকাশক ও লাইব্রেরি-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সে কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার বইগুলো অধিকাংশ বইয়ের দোকান ও লাইব্রেরি নিজ দায়িত্বে সরিয়ে ফেলেছে। গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি করে কি না, সেই ভয়ে আগেই সংশ্লিষ্টরা ওই সব বই সরিয়ে ফেলেন। এখন এসব বইয়ের বদলে লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকানে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক বই। বিভিন্ন দলের নেতাদের ছবি ও নামসংবলিত বই মিলছে সেসব স্থানে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বই বা ইতিহাসকেন্দ্রিক প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির চরম বাস্তব চিত্রই দেখা যাচ্ছে আজ। অনেক আগে থেকেই এই চর্চা হয়ে আসছে। এ জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ যেমন দায়ী, তেমনি একশ্রেণির লেখক-প্রকাশক ও ব্যবসায়ীর অতি উৎসাহও দায়ী। শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেকেই তার নজরে পড়ার কৌশল হিসেবে ওই সব বই লিখে নানা নামে প্রকাশ করেছেন। ফেসবুক থেকে শুরু করে সব মাধ্যমে প্রচারেও ছিল প্রতিযোগিতা। এমনকি ব্যাংক, মন্ত্রণালয়, সরকারি অফিস, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিদেশি মিশনগুলোতেও অনেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বইয়ের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। তৈরি করা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। সময়ের পরিবর্তনে এখন পাল্টে গেছে আগের সেই চিত্র। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা সেসব বই আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বইয়ের বাজারে দিন বদলের হাওয়া
সম্প্রতি নীলক্ষেত ও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে কোনো দোকানেই শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগসংক্রান্ত কোনো বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং আওয়ামী লীগসংক্রান্ত অনেক বই কেজিদরে বিক্রি করতে দেখা গেছে নীলক্ষেতে। এসব বইয়ের বদলে বইয়ের বাজারে এখন জায়গা করে নিয়েছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে লেখা বইসহ আওয়ামী লীগবিরোধী অনেক বই।
বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রকমারি ডটকম ও বাতিঘর ঘুরে গতকাল শনিবার দেখা গেছে একই চিত্র। এ বিষয়ে বাতিঘরের বই বিক্রেতা শাওন খবরের কাগজকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামীসংক্রান্ত বইয়ের পাঠক নেই। পাঠক না থাকায় বিক্রিও নেই, বিক্রি হয় না বলে বাতিঘর এ ধরনের বই রাখছে না।
বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রকমারি ডটকমের সেলস ম্যানেজার মাহমুদুল হাসান সাদি খবরের কাগজকে বলেন, অনলাইনে বই থাকলেও বিক্রি হচ্ছে না। গণ-অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামীসংক্রান্ত বইয়ের বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
নীলক্ষেতের একাধিক লাইব্রেরির মালিক ও বিক্রেতা খবরের কাগজকে বলেন, সরকার পতনের আগে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার আওয়ামী লীগবিষয়ক বই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন বিক্রি হয় না, তাই এসব বই রাখাও হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলেন, বইয়ের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারিও আছে বলে শোনা যায়। তাই এসব বই রাখা এখন নিরাপদ নয় মনে করে ব্যবসায়ীরা সরিয়ে ফেলেছেন। অথচ তাদের ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে টেন্ডারের মাধ্যমে ওই সব বইয়ের রমরমা কেনাবেচা ছিল। বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হতো দোকানের সামনের সারির সেলফে।
নীলক্ষেতের বই বাজার, শাহজাদা, লিমন বই ঘর, সফা, মিতা, আকিনসহ রাজনৈতিক বইয়ের প্রায় ২০টির মতো লাইব্রেরি রয়েছে। নীলক্ষেতের বই বাজারের লাইব্রেরিয়ান মাহফুজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো বই এখন আমরা রাখছি না। কারণ এসব বই এখন বিক্রি হয় না। যারা আগে রাখতেন তারাও সরিয়ে ফেলেছেন।’ তার মতে, চুরি করে দুই-এক কপি বিক্রি করলেও প্রকাশ্যে বিক্রি হয় না। অনলাইন ও পার্সেলের মাধ্যমে সামান্য কিছু বই বিক্রি হলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়।
গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়তো থাকতে পারে, তবে সরাসরি কোনো চাপ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এসব বই কেউ আর কিনতে আসে না। ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় যেসব বই ছিল সেগুলো সরিয়ে ফেলেছেন।’
নীলক্ষেতের সানজিদা লাইব্রেরিতে বিক্রির দায়িত্বে থাকা জাকির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের অনেক বই ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এসব বই বিক্রি একরকম বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বই কেজিদরেও বিক্রি করেছি। যেসব বই বিক্রি হয় না তা গুদামে রেখে তো লাভ নেই। এসব বইয়ের জন্য অনেক টাকা লসও হয়েছে।’
গত ১৭ জুন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। সেখানকার লাইব্রেরিগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কোনো বই খোঁজ করে পাওয়া যায়নি। আজিজ সুপার মার্কেটের পাঠক সমাবেশের কর্মী রিয়াল খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন সময় পাল্টেছে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে বই কেনাবেচাতেও পরিবর্তন এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘পাঠকের চাহিদাকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যেসব বইয়ের চাহিদা বেশি, সেগুলো রাখার চেষ্টা করি। আওয়ামী লীগের বই ছাপানো ও বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তাই বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।’
উৎস প্রকাশনের প্রকাশক মোস্তফা সেলিম এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশে এখন অন্য রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। মব সৃষ্টি করে অনেক প্রকাশককে স্বৈরাচারের দোসর বলা হয়েছে। অনেকের বাসায় হামলা করা হচ্ছে। সময় বদলের কারণেই মূলত আওয়ামীসংশ্লিষ্ট বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এই ধরনের বইয়ের প্রকাশ বন্ধ আছে। এসব বই এখন একরকম নিষিদ্ধের তালিকায় চলে গেছে। বঙ্গবন্ধু-হাসিনার বই কেনা একসময় গর্বের বিষয় থাকলেও এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ হাতে তুলতেও চান না।’
‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের’ প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব সৃষ্টির ভয়ে আমরা আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট বই-পুস্তক আর দোকানে রাখছি না। আমরা ব্যবসায়ী, আমাদের কাছে সবার বই বা সব ধরনের বই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজ করছে যে ব্যবসায়ীরা ওই সব বই রাখাকে ঝুঁকি মনে করছেন।’
সম্প্রতি সমন্বয়ক পরিচয়ে অচেনা কিছু লোক দরজা ভেঙে হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশের সহযোগিতায় তিনি রক্ষা পান। এতে প্রকাশকরা ভয় পেয়েছেন।
নেই সেই সব বঙ্গবন্ধু কর্নার
মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ৭১টি সরকারি পাঠাগারসহ দেশের প্রায় এক হাজার পাঠাগারে এই কর্নার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারাগারে থাকা পাঠাগারগুলোও এতে যুক্ত করা হয়েছিল। প্রকল্পের খরচ ধরা ছিল ২২ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু এখন আর কোথাও কোনো কর্নার নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার থেকেও আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের বইগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরকারি একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থগারিক খবরের কাগজকে জানান, আওয়ামী মতাদর্শের কোনো বই এখন কোনো গ্রন্থাগারে নেই। ৫ আগস্টের পর সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
দেশের সব ব্যাংকে সে সময় বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হয়েছিল। সেখানে রাখা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য-ম্যুরাল এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছবি ও বই। কয়েকটি ব্যাংকে গিয়ে দেখা গেছে, সব ব্যাংক থেকে বঙ্গবন্ধু কর্নার সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘সব ব্যাংক থেকে বঙ্গবন্ধু কর্নার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলাই আমাদের কাজ। এই কর্নারের জায়গাগুলো এখন কী কাজে ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
প্রাবন্ধিক, লেখক ও সমাজ-বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সার্বিক বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভেঙে ফেলা এবং বিভিন্ন স্থাপনা থেকে বঙ্গবন্ধু-হাসিনার নাম মুছে ফেলার ঘটনা রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফল।’ তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসকে শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্নভাবে অপদস্ত করেছে। তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বর্তমান ঘটনাবলি তারই প্রতিফলন।’
‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি কোনো দলই জনগণের কাছে তাদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারেনি। একটানা সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। সে সময় বিএনপির অনেক নেতা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি। ফলে বিএনপির ভেতরেও একটা ক্ষোভ ছিল। এখন সব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে,’ যোগ করেন বিশিষ্ট এই সমাজচিন্তক।
তিনি বলেন, ‘দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধি নেই। ফলে প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রোশ, হিংসা-প্রতিহিংসা দেখা যাচ্ছে। এ কারণেই এসব ঘটছে। আওয়ামী সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই লেখা ছিল সুবিধা আদায়ের কৌশলমাত্র। প্রকাশিত বইগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু কর্নারের প্রকল্প ছিল অর্থহীন।