ঢাকা ১ শ্রাবণ ১৪৩২, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
English

লবণাক্ত জমিতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৭:০০ এএম
লবণাক্ত জমিতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ
পতিত জমিতে সবজির বাগান গড়ে তুলেছেন শ্যামনগর উপজেলার দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের সবিতা রানী। ছবি: খবরের কাগজ

জমির দিকে তাকালেই স্বামী জামিরুলের কথা মনে পড়ে সালমা খাতুনের। লবণাক্ততা বাড়ায় এই জমি হয়ে পড়েছিল নিষ্ফলা। দুমুঠো আহার জোটাতে হিমশিম খেতে খেতে প্রথমে এলাকা, পরে দেশ ছেড়েছিলেন জামিরুল। এরপর আর ফিরে আসেননি তিনি। মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়েছে চিরতরে।  

জামিরুলের অবর্তমানে তার স্ত্রী সালমা আবার ফিরেছেন সেই জমিতেই। লবণাক্ত সেই জমিই এখন ভরসা তার। লবণসহিষ্ণু জাতের ফসল উৎপাদন করে এখন সংসারে গতি ফিরিয়েছেন তিনি।   

সালমা খাতুনের মতোই ভাগ্য সোরা গ্রামের কুলসুম বেগমের। ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় নদীগর্ভে চলে যায় তাদের বাসস্থান। তার স্বামী আশরাফুল হোসেন ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমান অন্যত্র। কিন্তু সেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসেননি,  খোঁজখবর নেননি কুলসুমসহ তাদের সন্তানদের। লবণপানির ব্যবহারে জরায়ু হারাতে হয়েছে কুলসুমকে। তবে তিনি থেমে যাননি। গৃহপালিত পশুপাখি ও লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল ও সবজি আবাদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ধীরে ধীরে।

জামিরুলের মতো মানব পাচারের শিকার হয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন শিউলি খাতুন (ছদ্মনাম)। তিনি বেঁচে ফিরেছেন বটে, কিন্তু স্বামী তাকে গ্রহণ করেননি বিদেশে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ায়। শিউলিও দেশ ছেড়েছিলেন সংসারে সচ্ছলতা আনতে। তাদের জমিও লবণাক্ত হয়ে পড়ায় ফসল চাষের উপযোগিতা হারিয়েছিল। 

সব কূল হারিয়ে শিউলি এখন বাবার বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন কৃষিকাজ করে। ফসল ফলাচ্ছেন সেই লবণাক্ত জমিতেই।   

সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চল শ্যামনগর ও আশাশুনিতে এমন গল্প অসংখ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে কৃষির কথা অনেকেই ভুলেছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে ওই উপজেলার অনেক মানুষই পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসে। যাদের বেশির ভাগই হয়েছেন আসলে পাচারের শিকার।

যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ

বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা শিউলি খাতুনরাই এখন সংসারের হাল ধরছেন। নিজ বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি উৎপাদন করছেন। নিজ পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করছেন। একই সঙ্গে গৃহস্থালি পশুপাখিও পালন করছেন।  

যে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন এবং ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশ গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন, বর্তমানে সেই বিপর্যয়কে মোকাবিলা করে কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ ও তথ্য অনুযায়ী লবণসহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষ করে ধীরে ধীরে অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা। 

 শিউলি বলেন, “দেশে ফেরার পর মানসিকভাবে ভেঙেছিলাম। নানাজনে নানা কথা বলত। ওই সময় মানব পাচার রোধে কাজ করা সংস্থা ‘অগ্রগতি’ আমার পাশে দাঁড়ায়। আমাকে কাউন্সেলিং করাসহ জলবায়ু বিপর্যয়কে মোকাবিলা করেও যে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, সেটা তারা আমাকে বোঝান। একপর্যায়ে তাদের সাহায্যে লবণসহিষ্ণু জাতের বিভিন্ন ফসল চাষ করি। যেটার দেখভাল আমার বাবা করেন।”  

এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরিশাল অঞ্চলের দেড় হাজারের অধিক পাচারের শিকার মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন অগ্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সবুর বিশ্বাস। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৬৩৫ জন মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন তিনি। 

আব্দুস সবুর বলেন, ‘লবণপানির আগ্রাসনে উপকূলের মানুষ পাচারের শিকার হন। এ জন্য পাচারের শিকার ওই সব মানুষকে আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করি। তাদের স্থানীয় প্রযুক্তি, জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলি এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিই। লবণপানির আগ্রাসন মোকাবিলা করে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন।’

এক ফসলি জমিগুলো তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর 

সাতক্ষীরায় লবণাক্ত জমিতে এখন দেখা দিয়েছে অভাবনীয় কৃষি সাফল্য। দিগন্তজুড়ে শস্যের খেতগুলোতে ভুট্টা ও সবজির আবাদে সবুজ হয়ে গেছে। এক ফসলি জমিগুলো এখন তিন ফসলিতে রূপান্তর হয়েছে। লবণাক্ত জমিতে লাউ, কুমড়া, পেঁপে, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, উচ্ছে, শসা, লালশাকসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করে সফল হয়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা।

অথচ গত কয়েক দশক ধরেই লবণাক্ততার কারণে জমিতে ফলেনি ফসল। মিঠাপানির আধারগুলো গেছে শুকিয়ে। গ্রামের পাশ দিয়ে খাল প্রবহমান থাকলেও পানির অভাবে শস্য আবাদ করতে পারেননি উপকূলের কৃষকরা। শুষ্ক মৌসুমে দিগন্তজুড়ে দেখা দেয় খরা। এরই মধ্যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন এই এলাকার কৃষকরা। পতিত থাকা ফসলি জমির কোনায় পুকুর করে মিঠাপানির সংস্থান করছেন তারা। সেই পানি দিয়ে এখন ফলানো হচ্ছে শস্য।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রামে গেলে স্থানীয়রা জানান, আগে এখানকার কৃষকরা শুধু আমন ধান আবাদ করতে পারতেন। এখন সেই লবণাক্ত জমিতে বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করছেন। তারা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আশপাশের কৃষকদের। পতিত জমি এখন আশা দেখাচ্ছে। 

খুটিকাটা গ্রামের প্রান্তিক নিহার সরকার জানান, লবণাক্ততার কারণে তাদের এলাকার শত শত হেক্টর কৃষিজমি পতিত থাকে। তা ছাড়া মিঠাপানির আধারগুলো শুকিয়ে গেছে। তবে গত বছর একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

নিহার বলেন, তার এলাকার অধিকাংশ কৃষককে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর খনন করে দিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আবাদের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট সার, গাছের চারা, শস্যবীজ এবং অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করেছে। কৃষকরা লবণাক্ত জমিতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে নানা প্রকার ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে একেকজন কৃষক ৩০-৫০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। আরও অধিকসংখ্যক পুকুর খনন এবং গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে বারো মাসই সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

একই উপজেলার দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের তপন কুমার মণ্ডলের স্ত্রী সবিতা রানী বলেন, ‘স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভর ছিল সংসার। একজনের আয়ে সংসারে সচ্ছলতা না আসাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ি পোনা ধরতাম। এতে শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা দিত। তবে একটি এনজিওর সহযোগিতা নেওয়ার পর বর্তমানে নদীতে মাছ ধরা বাদ দিয়েছি। এখন ভেড়া পালন ও সবজি চাষ করে আমি স্বাবলম্বী। এখন আর স্বামীর কাছে কিছু চাইতে হয় না। নিজের টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারি।’

অনুসন্ধান যা বলছে

সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার শতাধিক মাছচাষি ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছে খবরের কাগজ। তাদের অনেকে লবণাক্ততা মোকাবিলা করে সফল, আবার অনেকে লবণপানিতে সর্বস্বান্ত হয়ে বদলে ফেলেছেন নিজের দীর্ঘদিনের পেশা, হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। আবার অনেকে জড়িয়েছেন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ওই সব মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় কীভাবে তারা সফল হয়েছেন? আর কেনইবা বাকিরা সফল হতে পারেননি?

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যারা সফল হয়েছেন তাদের সফলতার পেছনে বড় অবদান বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও, সংগঠনসহ স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য বিভাগের। তাদের প্রশিক্ষণ পেয়ে কোন মাটি ও পানিতে কোন ফসল বা মাছের উৎপাদন ভালো হবে সে অনুযায়ী তারা চাষাবাদ করেছেন। বাকি যারা সফল হতে পারেননি, তাদের লোকসানের নেপথ্যের কারণ হচ্ছে জানা ও বোঝার ঘাটতি। আবার অনেক এলাকার ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো ব্যবস্থা নেই। আবার পুকুর করার মতো মূলধন নেই অনেকের। এ জন্য ইচ্ছে থাকলেও  এসব জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে পারছেন না অনেকে। 

জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে কী হতে পারে সমাধান? প্রশ্ন রাখা হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডলের কাছে। দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে মোহন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, যেখানে অভিযোজন, পুনর্বাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকবে একসঙ্গে। উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে টেকসই অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেন জনবসতি বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে। কৃষিকে করতে হবে জলবায়ুসহনশীল। শুধু অবকাঠামো বা প্রযুক্তি দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুষ্ঠু পুনর্বাসনব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। 

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যা বলছে

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৫ হাজার ঘেরে সনাতন পদ্ধতিতে বাগদা চাষ হয়। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে প্রতিবছর লোকসানে জর্জরিত হতো সাতক্ষীরার চাষিরা। ভাইরাস ও দাবদাহের কারণে ঘেরে বাগদা চিংড়ি উজাড় হয়ে যাওয়ায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো তাদের। পরবর্তী সময়ে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা হলেও তেমন সফলতা ছিল না। ফলে দিন দিন বাগদা চাষে অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছিল চাষিদের।

তবে এ বিপর্যয় থেকে চাষিদের রক্ষায় এগিয়ে আসে মৎস্য বিভাগ। ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ নামক একটি প্রকল্পের আওতায় উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করতে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পানির গভীরতা ঠিক রাখা ও বায়োসিকিউরিটি নির্বাহ করা এ চাষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নতুন এ পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করতে জেলার সব চাষিকে পরামর্শ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেন, ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় শিবপুরের ২৩ জন চাষিকে নিয়ে কাজ শুরু করি। সেখানে সফলতা ব্যাপক। বায়োসিকিউরিটি ও ভাইরাসমুক্ত পোনা ব্যবহার করা হয় ঘেরে। সেখানে মাত্র ৩ মাসে ২০টি চিংড়িতে ১ কেজি ওজন হচ্ছে। চাষিদের এ পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা উচিত।’

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লবণাক্ততার প্রভাবে ফসলে সেচের সমস্যা হয়। লবণপানিতে সব ধরনের ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে উপকূলীয় এলাকার পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষের আওতায় এনেছি।’ যেটা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. বিষ্ণুপদ বিশ্বাস বলেন, ‘লবণপানি পশুপাখির জন্য ক্ষতির কারণ। এ জন্য আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার। তা ছাড়া আমরা খামারিদের পরামর্শ দিয়েছি লবণাক্ত পানি পরিহার করে লবণাক্ত পানিকে পিউরিফাইড করে মিষ্টি পানিতে পরিণত করার জন্য।’

ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা অপকর্ম-সিন্ডিকেটের সদস্যরা লাপাত্তা

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৭ এএম
অপকর্ম-সিন্ডিকেটের সদস্যরা লাপাত্তা
খবরের কাগজ ইনফো

ভাঙারি ব্যবসায়ী লালচাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর গা ঢাকা দিয়েছে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা। বীভৎস ওই খুনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মহিন সিন্ডিকেটের সদস্যদের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে লড়াই করা অন্যরাও এখন এলাকা ছাড়া। এতে করে কয়েক দিন ধরে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন স্থানীয় ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। তবে নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের আতঙ্কের রেশ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায়।

এদিকে সোহাগ হত্যা মামলায় মহিনের সহযোগী নান্নু কাজীকে (২৭) গত সোমবার দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১০ ব্যাটালিয়ন। নান্নু এই মামলার এজাহারভুক্ত ৭ নম্বর আসামি। এ ছাড়া মঙ্গলবার মামলার প্রধান আসামি ও খুনের মাস্টারমাইন্ড মহিনের আরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এই মামলায় মঙ্গলবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। এজাহারভুক্ত আরও ১১ আসামি এখনো পলাতক আছেন। পুলিশ ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা তাদের গ্রেপ্তারে মাঠে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় যেখানে সোহাগকে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে মানুষের জটলা। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। ঘটনাস্থলের আশপাশের দেয়ালে লাগানো হয়েছে হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে ব্যানার ও পোস্টার। ব্যানারের এক পাশে ছিল হত্যার শিকার সোহাগের ছবিও।

এ ছাড়া নিহত সোহাগের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সোহানা মেটালে গতকালও তালা ঝুলছিল। এমনকি মহিনের টর্চার সেল হিসেবে যে কক্ষটি সামনে এসেছে সেটিও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

ওই এলাকায় কথা বলতে গেলে মহিন ও সোহাগকে ব্যবসায়ী সম্বোধন করে কথা বলতে নারাজ অধিকাংশ ব্যবসায়ী। তারা খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরা সন্ত্রাসী, তারা মূলত চোরাই কারবার করত। ভাঙারি পণ্য (তামা, পিতল, দস্তা, সিসা, প্লাস্টিকের পণ্য) ব্যবসার আড়ালে চোরাই কেবলসহ (তার) নানা অবৈধ অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের কারবার ছিল তাদের। চোরাই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই এখানে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এমনভাবে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাব বা আধিপত্য তৈরি করেছিল, যেখানে প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হতো। এই সিন্ডিকেট এলাকায় আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল টাকা কামাত। সেই সব টাকার ভাগবাঁটোয়ারা বা ওই সব ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরে খুন হন সোহাগ। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, সোহাগ-মহিন গ্রুপের দৌরাত্ম্য-আধিপত্য বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অতিষ্ঠ ছিলেন মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীরা। এই হত্যাকাণ্ডের পর সোহাগ-মহিনের সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসীরা এবং অন্য গ্রুপের সদস্যরাও গা ঢাকা দিয়েছে। আপাতত এখন কিছুটা স্বস্তিতে ব্যবসা করছেন তারা। 

সোহাগের পাশের দোকানের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে জানান, প্রায় এক যুগ ধরে তিনি এই এলাকায় ব্যবসা করেন। সোহাগ এখানে দোকান দিয়েছেন তিন মাস। এর আগে সোহাগ মহিনের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়াতেন। তিনি বলেন, ‘সোহাগ-মহিন গ্রুপ এই এলাকায় বেশ পরিচিত। তারা চাঁদাবাজি ও চোরাই কারবারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। এলাকায় তাদের খুব দাপট ছিল। কেউ কথা না শুনলে চালাতেন নির্যাতন। এখন কাউকে দেখা যায় না। সব পালিয়েছে।’

পাশে খবির দেওয়ান নামে আরেকটি একটি পিতলসামগ্রীর দোকানের কর্মচারী মাহফুজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সোহাগ আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। মহিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারাসহ ১০ থেকে ১২ জন এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন।’

টর্চার সেলে তালা

মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট থেকে পশ্চিম দিকে তাকালেই চোখ যায় বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী অফিসে (মিটফোর্ড হাসপাতাল)। টিনের ছাউনিযুক্ত এই অফিসের একটি কক্ষ মহিনের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার হতো বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে গতকাল ওই অফিসের সেই কক্ষের দরজা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। কেউ তাদের কথা না শুনলে এখানে এনেই নির্যাতন করা হতো বলে জানান স্থানীয়রা। 

জানা যায়, মহিনের নির্যাতনের শিকার এই এলাকার বাসিন্দা গাড়ি ব্যবসায়ী শাওন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাবার সূত্র ধরে আমি গাড়ির ব্যবসা করি। সোহাগ হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে মহিন গ্রুপ আমার কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দেব না বলে জানিয়ে দিলে পরে চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী অফিসে নিয়ে আমাকে মারধর করে।’ 

শাওন আরও অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসী মহিন সঙ্গে অস্ত্র রাখতেন। মহিন গ্রুপের ভয়ে এলাকার লোক তটস্থ থাকতেন। ১০ থেকে ১৫ জন দল বেঁধে তারা এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলা মহিনের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। মহিনের ডান হাত ছিল নান্নু গাজী।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, সোহাগ হত্যাকাণ্ডে মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া মহিনের আরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। সোহাগকে পাথর মারা ও লাশের ওপর ওঠে উল্লাস করা দুই ব্যক্তিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে খুঁজছে পুলিশ। এই দুজনের বিষয়ে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। দ্রুত সময়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। 

আসামি নান্নু কাজী গ্রেপ্তার

সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় অন্যতম আসামি নান্নু কাজীকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামে নান্নু কাজী তার মামার বাড়িতে আত্মাগোপন করেছিলেন। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নান্নু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন বলেও জানানো হয়েছে।
 
মহিনের আরও ৫ দিনের রিমান্ডে

মহিনকে আবারও পাঁচ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান ওই আদেশ দেন। এর আগে প্রথম দফায় পাঁচ দিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবারও ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। গত ১০ জুলাই প্রথম দফায় মহিনকে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। আদালতে রিমান্ড আবেদনের বিপরীতে আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

প্রসঙ্গত, গত ৯ জুলাই সন্ধ্যার আগে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন রজনী বোস লেনে পাকা রাস্তার ওপর সংঘবদ্ধভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী ও যুবদলকর্মী লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) এলোপাতাড়ি পাথর দিয়ে আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সোহাগ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৯ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তাদের মধ্যে ভিডিও ফুটেজ ও নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে ১১ জনকে শনাক্ত করেছেন তারা। 

জরুরি ওষুধের নামে মাদক আমদানি

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৬ এএম
জরুরি ওষুধের নামে মাদক আমদানি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

গত অর্থবছরে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা প্রায় ৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার পণ্য আটক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আটক পণ্যের বেশির ভাগই ছিল মাদকদ্রব্য। কাগজে কলমে এসব পণ্যের দাম দেখানো হয়েছিল ৯৫১ কোটি টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করা হয়েছে। এনবিআরের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য ছাড়াও যৌন উত্তেজক পণ্য, সোনার বার, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, উচ্চ মূল্যের ওষুধ, ইলেকট্রনিকস পণ্য, দামি মোবাইল ফোন, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল, বিলাসবহুল গাড়িও আমদানি করা হয়েছে। জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির কথা বলে এসব আনা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির সময় সবচেয়ে বেশি পণ্য আটক করা হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত থেকে আমদানির সময় এবং দুবাইতে রপ্তানির সময় বেশি পণ্য আটক করা হয়। তবে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন থেকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্যের মধ্যে মাদকদ্রব্য বেশি পাওয়া গিয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য এনে রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্রি করা হয়েছে। বয়সে তরুণ-তরুণীরা মাদকের প্রধান ক্রেতা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের বিভিন্ন দোকানের মাধ্যমে এসব বিক্রি করা হয়। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমদানি করা মাদকদ্রব্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্যদেশেও রপ্তানি করা হয়েছে। আটক মাদকদ্রব্যের মধ্যে আইস, ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল, হেরোইন বেশি। কোকেন ও বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনও আটক করা হয়েছে। মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রাও আটক করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সুজাতা এক্সেসরিজ লিমিটেডের নামে আমদানি করা কাঁচামাল পৌঁছায়। বন্দরের কর্মকর্তারা কাগজপত্রের সঙ্গে কার্টনের ভেতরে কী আছে তা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেন কাঁচামালের সঙ্গে গোপনে ৭শ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) আনা হয়েছে। এর বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। শুল্ক শাখার কর্মকর্তারা মালামাল আটক করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই নামে বাস্তবে কোনো কারখানার অস্তিত্বই নেই। জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে এলসি খোলা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির সময় মাদকদ্রব্য কোকেন আটক করা হয়েছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিভিন্ন ধরনের যৌন উত্তেজক পণ্য আটক করা হয়েছে। বিমানবন্দর দিয়ে আমদানির সময় বিভিন্ন ধরনের মাদক আটক করা হয়েছে। এসব চালানের প্রতিটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে আনা হয়েছে। এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানের নাম বেশি। 

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বিগত সরকারের গত ১৫/১৬ বছর ব্যবসায়ী নামধারী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংক ও এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব হয়নি। এসব ব্যক্তি ব্যাংক ও এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিরাপদে এ কাজ করেছেন। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত সরকারের সময়ের নামি ব্যবসায়ীদের অনেকে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানিতে জড়িত ছিলেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এদের অনেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা হিসেবেও দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মতো লোকেরাও জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা পরিবারের দাপুটে সদস্যরাও এ কাজে জড়িত ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্তমান এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা ঘোষণায় জড়িত আছে কি না তার তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে এনবিআর সংশ্লিষ্টদের অনেকের বিষয়ে সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এসব ব্যক্তিদের অনেকে আত্মগোপনে গেলে বা গ্রেপ্তার হলেও তাদের দলের লোকজন মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি করতে থাকেন। আগের মতোই ব্যাংক ও এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে সহযোগিতা করতে থাকেন। 

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর চেয়ারম্যান শুল্ক শাখার দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে দেন। টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য হিসেবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশি রাখা হয়। 

টাস্কফোর্স কমিটি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে থাকে। কোন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় কী ধরনের পণ্য বেশি আসছে, এ কাজে কে বা কারা জড়িত, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, কোন ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খুলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য বেশি আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে, ব্যাংক ও এনবিআরের কে বা কারা এ কাজে জড়িত- এমন অনেক বিষয় খতিয়ে দেখে তদন্ত করে টাস্কফোর্স কমিটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। টাস্কফোর্স কমিটি তদন্তের প্রয়োজনে সিআইডিসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছে। 

এনবিআর চেয়াম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জোর দিয়ে কাজ করছে। এ অসাধু ব্যক্তিরা যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন এনবিআর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আশা করি এনবিআরের এমন অবস্থানের কারণে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি কমবে।

তিনি আরও বলেন, এনবিআরের সব কাজে এখন প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। 

টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৈরি পোশাক খাতের কারখানাগুলো শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব সুবিধা পাওয়ার শর্ত থাকে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদনে ঠিক যতটা কাঁচামাল লাগবে ততটাই আমদানি করবে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কম দামের ও কম পরিমাণের কাঁচামাল (ফেব্রিক বা কাপড় (সুতি, লিনেন, সিল্ক, উল, নাইলন, পলিয়েস্টার ইত্যাদি), সুতা, বিভিন্ন ধরনের এক্সেসরিজ আমদানির কথা বলে বেশি দামের বেশি পরিমাণের পণ্য শুল্ক না দিয়ে এনে কারখানায় না লাগিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশিরভাগই জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এ কাজ করেছেন। এসব কাঁচামাল দিয়ে উন্নতমানের পণ্য রপ্তানি করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও রপ্তানি করেছে নিম্নমানের কিছু পণ্য। 

রপ্তানি করা পণ্যের দাম হিসেবে একটি অর্থও দেশে আনেনি। বিদেশেই আছে। 

এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধে এনবিআর আগের চেয়ে তৎপর। তবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি ব্যবহারে কাজ করতে সক্ষম হলে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি রপ্তানি কমবে। অর্থপাচারও কমবে।’ 

স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন রাজনীতিকরা

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৫ এএম
স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন রাজনীতিকরা

কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা থাকতে পারবেন না। বুধবার (১৬ জুলাই) প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ কথা জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোরালো আহ্বান জানানো হয়েছে। সুপারিশমালার আলোকেই এই প্রস্তাব আগামীকালের বৈঠকে অনুমোদনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির প্রথম বৈঠক বুধবার বেলা ৩টায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ।

প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পাঠানো প্রস্তাব সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুদক সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। এসব কমিশনের সুপারিশের মধ্যে শিগগিরই বাস্তবায়নযোগ্য ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ’ সংশ্লিষ্ট সুপারিশও রয়েছে।

সুপারিশে বলা হয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ম্যানেজিং কমিটিতে সংশ্লিষ্ট থাকায় নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি গঠনের জন্য জোরালো সুপারিশ করেছে কমিশন।  

তা ছাড়া বৈঠকের আলোচ্যসূচির ১৭টি প্রস্তাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ৩৩টি পদ, সরকারের পরিকল্পনা বিভাগের আইসিটি সেলের মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার ও অ্যাসিসটেন্ট মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ারের পদ-নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ দুটি পদ নাম পরিবর্তন করে রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী ও সহকারী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী পদ নাম করার প্রস্তাব দিয়েছে পরিকল্পনা বিভাগ।

তা ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আওতাধীন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের লক্ষ্যে রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে ৩৭টি পদ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির (এনআইবি) জন্য রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে ২১টি পদ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের জন্য রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে ২২টি পদ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন বেনাপোল, বুড়িমারী, ভোমরা, আখাউড়া ও তামাবিল স্থলবন্দরের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার ৫টি পদ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিকল্পনা অনুবিভাগের বিভিন্ন শাখার জন্য ১১টি ও লাইব্রেরি শাখার জন্য একটি পদসহ মোট ১২টি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ১১টি মডার্ন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন (২য় সংশোধনী) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল স্টেশনের জন্য রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে ২৪টি পদ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কার্যক্রম শক্তিশালী ও বর্ধিতকরণ শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত ১৬টি পদ রাজস্ব খাতে স্থায়ী করার কথা বলা হয়েছে। একই প্রকল্পের আরও ৭৬টি অস্থায়ী পদ রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি করার আগে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণের লক্ষ্যে ১৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৭৩টি পদ সৃজনের প্রস্তাব রয়েছে।

সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এসব পদ সৃজনের জন্য পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ ছাড়া প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) ২২টি পদ বিলুপ্ত করার জন্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৪’; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৪’ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (সকল) (নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি) প্রবিধানমালা, ২০২৫’ অনুমোদনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান পদটির নাম পরিবর্তন করে উপপরিচালক (লাইব্রেরি) নামকরণ করার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী, প্রতিরোধে উদাসীনতা

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১:১৫ এএম
বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী, প্রতিরোধে উদাসীনতা
ছবি: খবরের কাগজ

বর্ষা এলেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কয়েক বছর ধরেই এমনটি হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। গত জুনের তুলনায় চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগী অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যক্রম কম। 

এভাবে চলতে থাকলে সামনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পুলিশের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত সেভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় আনসার সদস্যদের নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু অভিজাত এলাকায় অভিযানই চালাতে পারছে না সিটি করপোরেশন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের এই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ২১০ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মে মাসে ৩, জুনে ১৯ এবং জুলাইয়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেখানে জুনে মারা গেছেন ১৯ জন, সেখানে জুলাইয়ের ১৪ দিনে মারা গেছেন ১৬ জন। জুন মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫১ জন। আর জুলাইয়ের ১৪ তারিখ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ১৬৪ জন।

গত ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোয় ৮৩১ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোয় ১ হাজার ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। ১৪ জুলাই পর্যন্ত এই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশেন এলাকার হাসপাতালগুলোয় ১ হাজার ২১৪ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোয় ২ হাজার ৫২ জন ভর্তি হয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব রোগী সিটি করপোরেশন এলাকার নয়। ঢাকার বাইরের রোগী ঢাকার হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী কম। গত ১২ জুলাই দুই সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন দক্ষিণ সিটির ১২ জন বাসিন্দা এবং উত্তর সিটিতে ৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণের হাসপাতালগুলোয় ৬৩ জন এবং উত্তরের হাসপাতালগুলোয় ২০ জন ভর্তি হন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। সড়কের বিভিন্ন স্থানে, পরিত্যক্ত বিভিন্ন পাত্রে, পলিথিনে পানি জমে থাকছে; যা মশার বংশবিস্তারের সহায়ক পরিবেশ। 

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই বর্ষা শুরুর আগে মশা নিধনে বিশেষ কর্মসূচির ঘোষণা আসে। এবারও এসেছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মুগদা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কামরাঙ্গীরচর, শেওড়াপাড়া ও উত্তরা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ এলাকায় গত সপ্তাহে মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। কোথাও কোথাও ছিটানো হলেও তা তেমন একটা কাজে আসছে না। 

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরের বাসিন্দা সালমা আক্তার বলেন, সন্ধ্যার পর জানালা খুলে রাখা যায় না। ঘরে বসেই মশার কামড় খেতে হয়। আগে মাঝে মাঝে ওষুধ স্প্রে করতে দেখা যেত, এখন সেটাও বন্ধ। গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এখন মশা মারার ওষুধ কিনে ছিটাই। অথচ করের টাকা তো সিটি করপোরেশন নেয়। আমাদের সেবা দেয় কে?’

দক্ষিণ সিটির রামপুরা, গোপীবাগ ও কাকরাইল আর উত্তরের দক্ষিণখান, মিরপুর ও পল্লবীতে গিয়ে দেখা গেছে, ড্রেন ও সড়কে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও ড্রেন পরিষ্কার না করায় পানি আটকে পানি আর ময়লার স্তূপ এক হয়ে আছে। 

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই সময়টা এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। তবে সেই তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম। আমরা চেষ্টা করছি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখার। সমস্যা হচ্ছে- বিভিন্ন জায়গায় ময়লা জমছে এবং ড্রেন পরিষ্কার করা হয় না। ড্রেনের পানি প্রবাহমান না থাকলে মশা নিধন করা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ বদ্ধ পানিতে মশা ডিম পাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে, যা মশার উপদ্রব বাড়িয়ে দেয়।

ড্রেনের পানি প্রবাহমান না থাকলে মশা নিধন করা সম্ভব হয় না। আর মশকনিধন কর্মীরা মাঠপর্যায়ে কাজ না করলে আমাদের মনিটরিংয়ে ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
 
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নির্মাণাধীন ভবন, ভবনের ছাদ, ড্রেন বা পরিত্যক্ত পাত্রে জমে থাকা পানিতে লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হয়। কিন্তু গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় আগের মতো পুলিশ পাচ্ছে না সিটি করপোরেশন।

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর পুলিশের উপস্থিতি কম রয়েছে। এই কারণে আমাদের মোবাইল কোর্ট তুলনামূলক কম পরিচালনা করা হচ্ছে- এটা সত্য। তার পরও আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। এ ক্ষেত্রে কোনো বাসাবাড়িতে আমরা মশার লার্ভা পেলে প্রথমে নোটিশ দিয়ে সতর্ক করি। পরে একই স্থানে লার্ভা দেখলে আমরা সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি এবং জরিমানা করি। তবে উত্তরা ও গুলশান-বনানীর বাড়িগুলোর ছাদে উঠতে দেওয়া হয় না। ফলে সেখানে মশা নিধনও করা যায় না। এটাও একটা সমস্যা।

ঢাকা দক্ষিণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা তুলনামূলক কম হচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা আঞ্চলিক কর্মকর্তারা পরিচালনা করেন। এটা ঠিক গত তিন দিন কোনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হয়নি। তবে একদমই যে বন্ধ রয়েছে তা নয়। আমাদের করপোরেশন থেকে আনসার সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়।’ 

পুলিশের কাজ আনসার দিয়ে কতটা সম্ভব? এ বিষয়ে তিনি বলেন, এখন যা রয়েছে তা দিয়ে তো কাজ চালিয়ে নিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা দুভাবে মশক নিধন কার্যক্রম চালাচ্ছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে এবং সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে। প্রতি শনিবার ওয়ার্ড পর্যায়ে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিমূলক প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এই কার্যক্রমে স্থানীয় ৩০০ থেকে ৪০০ লোক অংশ নেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে যতই মশার ওষুধ ছিটানো হোক না কেন, তা কাজে আসবে না।’

দোষারোপের রাজনীতি: দলীয় ব্যবস্থা দুর্বল হলে কার লাভ, কার ক্ষতি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১০:১৫ এএম
আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১০:১৭ এএম
দোষারোপের রাজনীতি: দলীয় ব্যবস্থা দুর্বল হলে কার লাভ, কার ক্ষতি
খবরের কাগজ ইনফো

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতি স্থিতিশীল এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে বলে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল জনমনে। কিন্তু সরকার পতনের এক বছর পার না হতেই দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা স্পষ্ট হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ বাড়তে থাকায় দলগুলোর মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি তীব্র আকার ধারণ করেছে।

সর্বশেষ গত ৯ জুলাই মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিএনপির বিরুদ্ধে শক্তভাবে মাঠে নেমেছে। পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপিও। বর্তমানে একদল অন্য দলকে রাজনীতির মাঠে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন বিদ্বেষপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হলে তার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে সুধী সমাজের পাশাপাশি পর্যবেক্ষক মহলে নানা আলোচনা উঠছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলে গণতন্ত্রের জন্য সেটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারও মতে, এ ধরনের পরিস্থিতি অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দলটির নিবন্ধনও স্থগিত রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিসহ ১৪-দলীয় কয়েকটি দলের কার্যক্রমও একরকম বন্ধ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, এবি পার্টিসহ কিছু দল সক্রিয় রাজনীতি নিয়ে মাঠে রয়েছে। কিন্তু এ দলগুলোর মধ্যে বিরোধ যেভাবে তীব্র হচ্ছে তাতে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কেউ পলিটিক্যাল পার্টি সিস্টেম বা রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার আলামত দেখছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘একটি দল স্লোগান দিচ্ছে- আওয়ামী লীগ গেছে যে পথে, বিএনপি যাবে সেই পথে। অত সহজ নয়।’

গতকাল পটুয়াখালীতে দেওয়া এক বক্তব্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি এখন একটি চাঁদাবাজদের দলে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে যখন একটা আশার সঞ্চার হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই কয়েকটি রাজনৈতিক দল, কয়েকটি চক্র বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এই ষড়যন্ত্র নতুন নয়। এই চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশকে আবার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে যাতে নির্বাচন না হয়, সেই চেষ্টা তারা করছে। এই পরিকল্পনাকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত আমি মনে করি, বিএনপিকে একেবারে ধ্বংস বা শেষ করে দেওয়া সম্ভব না। হয়তো সাময়িকভাবে দুর্বল করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, একটি গোষ্ঠী ভাবছে, বিএনপিকে এবার শেষ করে দিতে পারলে তারা একক কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারবে। তাহলে তারা ভুল ভাবছে- এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনেও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়তে থাকবে। একে অপরকে বাতিল করতে চাইবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইদানীং নানা রকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমার মনে হয়, শুধু বিএনপি দল হিসেবে অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে না, বাংলাদেশের পার্টি সিস্টেম ভেঙে দিতে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেশের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভঙ্গুর। এমন পরিস্থিতিতে দেশের পার্টি সিস্টেম ভেঙে দিলে ওয়ান-ইলেভেনের মতো সরকার আসার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এটা দেশের জন্য ক্ষতি, তখন দেশের ভবিষ্যৎ অবস্থা অন্ধকার।’

‘বিএনপির ভুলত্রুটি রয়েছে। যারা অপকর্ম করছে তাদের বহিষ্কার করেছে। কিন্তু তাদের যারা দলে জায়গা দিয়েছেন তাদের বহিষ্কার করছে না। আমি শুনেছি, মিটফোর্ডের ব্যবসায়ী নাকি একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। ৫ আগস্টের পর তাকে বিএনপির দলে জায়গা দিল কারা? রাজনৈতিক দলগুলোর দোষত্রুটি যাই-ই থাকুক না কেন, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে দেশের গণতন্ত্র ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। রাজনীতিতে নোংরা ভাষা ব্যবহার থেকে সব দলকেই বিরত থাকতে হবে’ যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলীয় সিস্টেম যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তৃতীয় শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার শঙ্কা থাকে। এখন এই দিকে যাচ্ছে কি না স্পষ্ট না; তবে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রত্যেকটা দলই কোনো না কোনোভাবে দুর্বল অবস্থায় আছে বা তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। নতুন দলগুলোও ভালোভাবে অবস্থান করতে পারছে না। এটা দেশের জন্য অশনিসংকেত।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তো নিষিদ্ধ। সে কারণে প্রকাশ্যে নেই। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা গোলমাল লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। জামায়াত বিএনপির সহযোগী ছিল, সেখান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। ভেতরে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে এবং সেটি তৈরি করা হচ্ছেও।’

‘এনসিপি বা অন্যান্য নতুন দল হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম সেভাবে হচ্ছে না। চিত্রটা স্থির না, একটা অস্থির অবস্থা। এ রকম অস্থির অবস্থা যখন হয়, তখন জরুরি অবস্থা আসার আশঙ্কা থাকে। তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হতে পারে। গণতান্ত্রিক একটা দেশে এই অবস্থাটা ভালো না। আমরা খুব ভালো দিকে যাচ্ছি না। প্রত্যেক দলকে লক্ষ করা উচিত, নিজেদের মধ্যে গোলমাল মিটিয়ে ফেলা উচিত। যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়। সরকারেরও সেদিকে খেয়াল করা উচিত। প্রত্যেককে এখন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সব দলের নেতাদের এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের এখনই নজর দেওয়া উচিত’ যোগ করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপ-উপাচার্য। 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো ঐক্যবদ্ধ নীতির বাস্তবায়ন বা নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন কোনোটাই সম্ভব হয় না রাজনৈতিক দল ছাড়া। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় নীতি নির্ধারণ করে এবং জনগণের স্বার্থের জন্য জনমত গঠন করে এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থায় এর বিকল্প নেই। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক এডমন্ড বার্কের মতে, রাজনৈতিক দল হলো একটি সুসংগঠিত জনসমষ্টি, যারা কোনো নির্দিষ্ট নীতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে। 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলকে কেবল দেশের ক্ষমতা দখলের জন্য উৎসুক সংগঠনরূপে গণ্য করলে ভুল করা হবে। রাজনৈতিক দল বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতা সংরক্ষণ অথবা তার ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের পথ ও প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। ভারত, পাকিস্তান, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের সিস্টেম দেখা যায়। ফলে এসব দেশে সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন দলের সমর্থন প্রয়োজন হয়। আর সেই দলীয় ব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমে যাওয়া স্বৈরশাসনেরও সূচনা করে। অনেকের মতে, এসব কারণেই হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। 

৫ আগস্ট-পরবর্তী বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দলের হাইকমান্ড। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে গত ৯ জুলাই মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার পর থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা মতের মানুষ। দলের শীর্ষ নেতাকে নিয়েও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসগুলোও উত্তাল হয়ে ওঠে। এগুলো বিএনপিকে দুর্বল করার চক্রান্ত বলে মনে করছে দলটি। এ ঘটনায় বিএনপির দৃঢ় অবস্থান থাকার পরও একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিতভাবে বিএনপি এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের শালীনতা ও চরিত্রহননের দুঃসাহস প্রদর্শন করছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেন।

ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বিএনপির সমালোচনা করলে দেশের ক্ষতি হবে, গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে। তবে বিএনপিকে পার্টির মধ্যে জমে থাকা ময়লা, যারা দলের ক্ষতি করছে এসব অবাঞ্ছিত লোকদের পরিষ্কার করতে হবে। সমাজের মধ্যে চরিত্রহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও সুবিধাবাদী লোক থাকে। এরা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়ে। শুধু বিএনপি নয়, অন্যান্য দলে রয়েছে। যত দ্রুত করা যাবে, ততই দেশ ও দলের মঙ্গলজনক। দলের মধ্যে আদর্শগত প্রচার চালাতে হবে। 
অন্যদিকে বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করছেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপি অনেক ঘটনায় বহিষ্কার করেও অনেক স্থানে নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই আরও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। দেশের কল্যাণের জন্যও বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। অন্যথায় জামায়াত কিংবা অন্য দলগুলোর পক্ষে অভ্যুত্থানের বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি অনেক বড় দল। সবাই মনে করে আগামীতে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এ জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সক্রিয় হয়েছে। সুযোগ বুঝে ওই সব দল বিএনপির ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তবে গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা বিএনপিকে শেষ বা ধ্বংস করতে পারেনি। আগামী দিনেও কেউ পারবে না।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা রকম সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর। গণ-অভ্যুত্থানের আসল নায়ক ছাত্ররা। তাদের নামে বহুমাত্রিক শক্তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদিন বিপরীত শক্তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।’ 

তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর নানা শক্তির তৎপরতা বেড়েছে। আমার মনে হয়, এসব শক্তির বিরাজনীতিকীকরণের একটা প্রবণতা থাকতে পারে। দৃশ্যমান রাজনীতির একটা শক্তি এর সঙ্গে লিপ্ত থাকতে পারে। নোংরা ভাষা পরিহারের জন্য রাজনীতিবিদদের সম্মিলিতভাবে আচরণ বিধি থাকা জরুরি। নো মব জাস্টিস, দলে কোনো চাঁদাবাজকে রাখা যাবে না- এটা প্রত্যেক দলকে মেনে চলতে হবে। হালুয়া-রুটির রাজনীতি ও আদর্শিক রাজনীতির পার্থক্য সবাইকে বুঝতে হবে।