
‘মব ভায়োলেন্স’ থামছেই না। নানা রকম অভিযোগ-অজুহাতে একশ্রেণির মানুষ মব সৃষ্টির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। মব সৃষ্টি করে টার্গেট ব্যক্তির বাসাবাড়ি বা অফিসে ভাঙচুর চালাচ্ছেন। মারধর ও হেনস্তার পাশাপাশি কোথাও কোথাও ‘গণপিটুনির’ নামে হত্যার ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। নতুন করে আবারও মব ভায়োলেন্স নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাটি।
যদিও সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কোনো হুঁশিয়ারিতেই বন্ধ হচ্ছে না এই জাতীয় অপরাধ। বরং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অবস্থান বা ভূমিকা। এই পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মব ভায়োলেন্সের এমন বহু ঘটনা ঘটলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নামমাত্রই। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের অভাবে বারবার এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। তারপরও বলতে গেলে আমাদের পুলিশের যে রকম কার্যক্রম, সেটাও শতভাগ চালু হয়নি। রাস্তা অবরোধ করে অনেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছেন, এটাও মব ভায়োলেন্স। পুলিশের সামনেই সেটা করা হচ্ছে। কিছু বলতে গেলেও সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ অবস্থাতেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, যাতে এই ধরনের অপরাধ না ঘটে।’
গত রবিবার মব ভায়োলেন্সর মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে হেনস্তা করে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাটি আরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ওই ঘটনার তীব্র আলোচনা-সমালোচনা হয়। অনেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বেশ কিছু মব ভায়োলেন্সের তুলনামূলক আলোচনা-সমালোচনা করেন। তবে অধিকাংশই যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানান। যদিও এই ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘটনার রাতেই কড়া বিবৃতি দিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
পাশাপাশি গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এমনকি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকেও মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক সিইসির প্রতি অপমানজনক ও সহিংস আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের গত দুটি প্রেস ব্রিফিংয়ে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও মবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তারপরও কেন মব ভায়োলেন্স বন্ধ হচ্ছে না? মব জাস্টিসের নামে আইন হাতে তুলে নিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা যারা বিপন্ন করছেন তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরাধ বিশ্লেষকদের কাছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। ডিএমপির সব থানায় এ বিষয়ে আবারও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে মব ভায়োলেন্স ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। মানবাধিকার সংস্থা ‘আসকের’ তথ্যমতে, গত সাড়ে ১০ মাসে (আগস্ট থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত) সারা দেশে মব সৃষ্টির মাধ্যমে গণপিটুনি বা মারধর করে ১৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের সাড়ে ৫ মাসে নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের বাইরে মব ভায়োলেন্স বা মব সৃষ্টির মাধ্যমে হামলা, ভাঙচুর ও মারপিটের ঘটনা আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্স সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতাকে জানান দেয়। গত ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে মব ভায়োলন্সে যেভাবে বেড়েছিল, সেখান থেকে এখনো যদি একই রকমভাবে চলতে থাকে সেটা অবশ্যই হতাশাজনক। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কথা বললেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ সেভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই জাতীয় অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। ফলে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে আরও সোচ্চার হতে হবে।’
মব ভায়োলেন্স দেশের সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারের মূল্যবোধে সরাসরি আঘাত
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আসক গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি বেআইনিভাবে সমবেত হয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মারধর করে এবং পরে তাকে পুলিশের কাছে সোর্পদ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে প্রকাশিত এই দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।
আসক মনে করে, একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে যদি কোনো গুরুতর অভিযোগ থেকেও থাকে, তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া। বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যেকোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি অধিকারকেই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুষ্কৃতকারীরা যদি এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটিয়ে থাকে, তা বিচারহীনতার একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘মব সংস্কৃতি’কে যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচ্ছন্ন সংকেত দেয়।
আসক আরও বলেছে, শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দু-একবার সতর্কতা উচ্চারণ করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর ও জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং আপাতদৃষ্টিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এসব সহিংস গোষ্ঠীর অপকর্মে পরোক্ষভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
আসক বলেছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা রাষ্ট্রের একজন নাগরিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা শুধু ব্যক্তির অপমান নয়, এটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও আইনের শাসনের অবমাননার শামিল।