
আগামী জুলাই মাস থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করাতে চায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এটি হবে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। চালু হবে কার্গো ফ্লাইটও। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রী টানতে কতটা প্রস্তুত পর্যটন নগরী কক্সবাজার, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত না করেই কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা দেখতে পারে লোকসানের মুখ।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে যেটুকু অবকাঠামো রয়েছে, বিশেষ করে পুরোনো বিল্ডিং, সেটি ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি এখান থেকে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠকও হয়েছে।’
রানওয়ে এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, আগামী জুলাই মাসেই কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করা।’
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কেবল এয়ার অ্যারাবিয়া কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। পাশাপাশি বেবিচক থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
তবে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য তো তাকে প্রস্তুত করতে হবে। কারণ এখন তেমন কোনো অবকাঠামো নেই। বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজারে তেমন আসেন না। ফলে এখান থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, কক্সবাজারকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত না করলে এখান থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বা কার্গো ফ্লাইট কোনোটাই কাজ করবে না। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজারকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। তা না হলে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হবে ঠিকই, কিন্তু বেশি দিন চলবে না।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও পাহাড়ঘেরা অপার সৌন্দর্যের অধিকারী কক্সবাজার। কিন্তু তার পরও বিদেশি পর্যটক তেমনভাবে টানতে পারছে না কক্সবাজার। এর কারণ হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেছেন, ‘দেশের পর্যটনশিল্প সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেভাবে প্রচারিত না হওয়ায় বিদেশি পর্যটকদের আগমন অনেক কম। তিনি বলেন, যারা কক্সবাজারে ভ্রমণে আসেন, তাদের অনেককেই নানা ধরনের ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। পর্যটন মৌসুমে দীর্ঘ যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অনেক পর্যটন এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলিত হয়ে আছে।’ তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে এখনো আন্তর্জাতিক মানের কোনো অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা জমজমাট নাইটলাইফ নেই, যা আধুনিক পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এ কারণে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহও তুলনামূলকভাবে কম।
আবদুস সালাম আরেফ মনে করেন, কক্সবাজারসহ দেশের প্রধান পর্যটন এলাকাগুলোর আধুনিকায়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি বিদেশে পর্যটন খাতের ব্যাপক প্রচার চালানো সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহির মোহাম্মদ জাবের খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে না- এই ধারণা সঠিক নয়। তবে যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, সেই হারে বাড়ছে না, সেটি সত্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটন একটি সমন্বিত খাত, যার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ, যানবাহন সুবিধা, বিশ্রামের জায়গা, বিনোদনের সুযোগ, টয়লেট, মানসম্মত খাবার ও সুলভ আবাসনব্যবস্থার মতো নানা বিষয় জড়িত। পর্যটনের টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব প্রতিটি ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
আবু তাহির মোহাম্মদ জাবের জানান, কেবল দেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ানোই নয়, বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতেও সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এবং এ নিয়ে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ চলমান রয়েছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রস্তুতি
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য ২০২১ সালে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় রানওয়ে সম্প্রসারণ ও একটি অত্যাধুনিক নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর সম্প্রসারিত ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ের নির্মাণকাজ আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে, ফলে মোট রানওয়ের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট (৩.২৬ কিলোমিটার), যা দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে হিসেবে নতুন রেকর্ড গড়বে।
প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বর্তমান টার্মিনাল ভবন থেকেই পরিচালিত হবে। পরবর্তী সময়ে নির্মিতব্য আধুনিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবনটি সব ধরনের ওয়াইড-বডি উড়োজাহাজ পরিচালনার উপযোগী হবে। যদিও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর জন্য প্রস্তুতি চলছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের কাজ শেষ হতে আরও ৯ মাস লাগবে। এ ছাড়া ৪ দশমিক ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা এবং এ জন্য ৩ হাজার ৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা এখনো সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) অনুমোদনও এখনো মেলেনি।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, কক্সবাজার নিয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিলে এটি আঞ্চলিক পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। নেপাল, ভুটান, উজবেকিস্তান এবং চীনের ইউনান প্রদেশের মতো ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য কক্সবাজার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রগন্তব্য, যার পর্যটন সম্ভাবনা অপার। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।