
এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই রাজধানী ঢাকার সড়কে প্রায় প্রতিদিনই গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা-যানজটের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। তার মাঝেই আবার কৌশলে রুট পরিবর্তন করে ঢাকার সড়কে নামানো হচ্ছে নতুন আরও ২ হাজার ৬১৫টি বাস। এর ফলে রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও যানজটের পরিস্থিতি আরও মারাত্মক বা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক অনুসারে বর্তমানে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে রাজধানীর যানজট নিরসন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ঠিকমতো আনতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। তার মাঝেই নতুন করে আড়াই হাজারের বেশি বাস নামানো হলে সেই বাড়তি চাপ সামাল দেওয়াটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি গণপরিবহনের ব্যবস্থাপনা-শৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৪৬টি বাস কোম্পানির ব্যানারে ঢাকার সড়কে ৫ হাজার ৫৪২টি বাস চলাচলের অনুমোদন দিয়েছিল আরটিসি। তবে এর বাইরেও ওই সব বাস কোম্পানির ব্যানারে রুট পারমিটবিহীন ১ হাজার ৮০টি বাস চলছে ঢাকার সড়কে। তার সঙ্গে নতুন রুট পারমিটের মাধ্যমে নতুন আরও আড়াই হাজারের বেশি নামবে রাজধানীর সড়কে।
জানা গেছে, নতুন করে আরও বাস নামানোর বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটিতে (আরটিসি) জোরালো আপত্তি জানিয়েছিল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর। তার পরও দায়িত্বশীলরা নতুন করে ২১টি বাস কোম্পানিকে ২৩টি রুটে বাস পরিচালনার অনুমোদন (রুট পারমিট) দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, আরটিসির কতিপয় সদস্যকে (সংস্থার প্রতিনিধি) ‘ম্যানেজ’ করে বেসরকারি বাস কোম্পানির মালিকরা ওই সুযোগ নিয়েছেন।
আপত্তি সত্ত্বেও ১৯টি বাস কোম্পানিকে নতুন ২৩টি বাস রুট
গত মে মাসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে আরটিসির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকায় আপাতত নতুন করে বাস রুট না দিতে সুপারিশ জানান। কিন্তু পরিবহন মালিকদের চাপে সেই সুপারিশ গ্রাহ্য করা হয়নি। অভিযোগ উঠে, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে ডিএমপি কর্মকর্তারা নতুন করে ২৩টি বাস রুটের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছেন। এসব অনুমোদন নিয়েও আরটিসি সদস্যদের মধ্যেও বিতর্ক হয়েছে। যে ২১টি বাস কোম্পানি অনুমোদন পেয়েছে, তাদের মধ্যে ঢাকা চাকা লিমিটেড ও মাশাল্লাহ্ এক্সপ্রেস কোম্পানি লিমিটেড শুধু এসি বাস পরিচালনার প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া শাহ পরান এন্টারপ্রাইজ ও আলিফ এন্টারপ্রাইজ শুধু মিনিবাসের মাধ্যমে রুট পরিচালনা করতে চায়। তাদের সবগুলো রুটই দৈর্ঘ্যে ২০ কিলোমিটারের বেশি। ঢাকা মহানগরীতে মিনিবাসের মাধ্যমে ২০ কিলোমিটারের বেশি লম্বা রুট পরিচালনা সমীচীন নয় বলে আরটিসি সভায় অভিমত এসেছিল। কিন্তু সেই আপত্তি উপেক্ষা করে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটেও বাস পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহ পরান এন্টারপ্রাইজ ও আলিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক একই কোম্পানি। এখন তাদের কোনো বাস নেই। তারা যেসব মিনিবাস নামাতে চাইছে, সড়কে সেগুলো প্রস্তুত করতে চার-পাঁচ মাস সময় লাগবে। অন্যদিকে ইউনাইটেড সার্ভিস, চ্যালেঞ্জার লাইনের নিজস্ব কোনো বাস নেই। তারা যেসব রুটে বাস পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছে, সেসব রুটে অন্য কোম্পানির বাস চলাচল করছে। ইউনাইটেডের নিজস্ব ৮০টি নন-এসি বাস প্রস্তুত থাকলেও তাদের রুটেও অন্য বাস চলছে। এই তিন কোম্পানির রুট পারমিট পুনরায় বিশ্লেষণের আবেদন জানানো হয়েছিল।
ঢাকা চাকা লিমিটেড আজিমপুর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ১০০টি, গাবতলী থেকে ভুলতা পর্যন্ত ১০০টি, মাশা আল্লাহ এক্সপ্রেস গাবতলী থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী পর্যন্ত ১০০টি বাস পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছে। এসি বাস পরিচালনায় আপত্তি আসে পুলিশের পক্ষ থেকেই। ডিএমপির একজন যুগ্ম পুলিশ কমিশনারও আরটিসি সভায় আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘নতুন নন-এসি বাস ও বর্তমানে চলাচলকারী বাসগুলো আরও বেশি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে আগে বাস রুটগুলোকে ‘র্যাশনালাইজ’ ও সমন্বয় না করে রুট পারমিট দেওয়া সমীচীন হবে না।’
এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটি’র কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় রুট পারমিট দেওয়া হলে তা হতো সাংঘর্ষিক। তাই ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নতুন কোনো রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। এতে নতুন বাস পরিচালনা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক বাসের রেজিস্ট্রেশনের টাকা জমা রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন রুট পারমিটবিহীন অবস্থায় ঢাকা মহানগরীতে অনেক বাস চলছে।’
রুট পারমিট নিয়ে শত জটিলতা
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকায় চলমান ৯৫টি বাস রুটে সাড়ে পাঁচ হাজার বাস চলাচলের অনুমতি দিয়েছিল আরটিসি। তবে ঢাকায় নির্ধারিত রুটে চলে মাত্র ২ হাজার ৯৫৩টি বাস। নির্ধারিত রুট ছেড়ে অন্য রুটে চলাচল করে ১ হাজার ৫৭৪টি বাস। ওই সব প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রুট পারমিটবিহীন অবস্থায় ঢাকায় এখনো চলছে ১ হাজার ১১৭টি বাস।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাসব্যাপী বাস রুট ভেরিফিকেশন শীর্ষক ট্রাফিক জরিপ শেষে ‘ডিটিসিএ’ জানিয়েছে, ঢাকায় যে ৯৫টি বাস রুট সচল রয়েছে এর মধ্যে ৫টি রুট ২০২১ সালে সচল ছিল না। এগুলো পরবর্তী সময়ে চালু হয়েছে। ৩৪টি রুটে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি বাস চলছে। ১২টি রুটের কোনো অনুমোদন নেই। ১৪টি বাস রুটে বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি অনুমোদন করা হয়েছে। পাশাপাশি দুটি রুট নাম পরিবর্তন করে চলছে।
ডিটিসিএ আরও জানিয়েছে, ১৯টি কোম্পানি ২০২৪ সালে তাদের নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করে ফেলেছে অনুমতি ছাড়া। ২০টি বাস কোম্পানি নির্দিষ্ট সিলিং নাম্বারের বাইরে অতিরিক্ত বাস পরিচালনা করছে। ৯টি বাস কোম্পানির মালিক প্রভাব খাটিয়ে আরটিসি কমিটি থেকে সিলিং নাম্বার বাড়িয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া কয়েকটি বাস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বা আমদানিকারকের নামে বাস রুট দেওয়া হলেও চলছে ভিন্ন নামে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘অধিকাংশ বাসের রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাই বিভিন্ন বাস তাদের নির্ধারিত রুট থেকে অন্য রুটে চলে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যেসব বাস কেনা হয়, সেগুলোর নিবন্ধন ঋণগ্রহীতার নামে হয়নি। ফলে বাসগুলোর নিবন্ধন কোম্পানির নামেও করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার সব বাস মালিক কোম্পানি গঠন করে রুট পারমিট গ্রহণ করেননি। এগুলো বড় জটিলতার সৃষ্টি করেছে।’
কর্তৃত্ব নিয়ে মুখোমুখি ডিটিসিএ, বিআরটিও ও ডিএমপি
আরটিসি কমিটির একাধিক সদস্য খবরের কাগজকে বলেছেন, রাজধানীর রুট পারমিট নিয়ে কোনো সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ডিটিসিএর সদস্যরা যখন গণপরিবহনের হালহকিকত নিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন, তখন পরিবহন মালিকরা হইচই শুরু করেন। রুটে নতুন করে বাস নামানোর যৌক্তিকতা না থাকলেও তারা চাপ দিতে থাকেন ডিএমপি কমিশনারকে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও তারা বিভিন্ন তদবির-সুপারিশ নিয়ে আসছেন। ডিএমপি কর্মকর্তারা ডিটিসিএ, বিআরটিএর কর্মকর্তাদের মতামত অগ্রাহ্য করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ডিএমপি কমিশনার এককভাবে তার সিদ্ধান্তের কথা সভায় জানান।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ডিটিসিএকে অগ্রাহ্য করে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করি না। আরটিসির সব সদস্য একমত হলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। নতুন বাস রুটের বিষয়ে অধিকাংশ সদস্য মতামত দেওয়ায় ১৯টি কোম্পানিকে ২৩টি বাস রুটের পারমিট দেওয়া হয়েছে। ডিএমপি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।’
আরটিসির সদস্য ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘ঢাকার সড়কে রুট পারমিট দেওয়ার কাজটি ডিটিসিএর হাতেই থাকা উচিত। তবে তারা বিআরটিএ, ডিএমপির পরামর্শ মোতাবেক কাজ করবে।
কিন্তু বর্তমানে সড়ক শৃঙ্খলার বিষয়ে ডিটিসিএ, বিআরটিএ ও ডিএমপির মুখোমুখি অবস্থান বা দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে এই দ্বন্দ্ব মোচন করতে হবে আগে। তারপর রুট পারমিট, বাসের ফিটনেস সবকিছুই একটা শৃঙ্খলায় চলে আসবে।’