ঢাকা ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

নজরদারিতে এনবিআরের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১১:২৯ এএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১১:৩০ এএম
নজরদারিতে এনবিআরের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী
ফাইল ছবি, খবরের কাগজ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সন্দেহভাজন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নজরদারিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, করদাতাকে হয়রানি, প্রভাব খাটিয়ে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি না করলে প্রতিটি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি আরও কম হতো। শুধু তাই নয়, এই অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে সরকার রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনলাইনে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে দুর্নীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে বিধায় এই চক্র নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এনবিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এই চক্রের দাপটে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। তাদের কারণে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই চক্র বিগত সরকারের সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিকে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ে আসত। পরবর্তী সময়ে সেই ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে একজোট হয়ে এই চক্র দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছে। এসব ব্যক্তি ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ট্রাইব্যুনালে প্রভাব খাটিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দিয়েছেন। সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর ফাঁকির মামলায় অসাধু ব্যক্তিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। মতিউরের অসাধুতায় মাত্র চার মাসে সরকার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক তদন্ত কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে প্রতি অর্থবছরে সরকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। 

এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়াই শেষ কথা হতে পারে না, তাদের আইনের আওতায়ও আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে আছেন। অন্যদিকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

সৎ কর্মকতা-কর্মচারীদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাপে থাকেন। বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে ঠিকমতো রাজস্ব আদায় হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি অসৎ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনে, তা হলে রাজস্ব খাতে গতি আসবে।’ 

এদিকে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাজস্বের আওতা বাড়ানোর কথা বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব দপ্তর স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শূন্য পদে নতুন নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

তদন্তে এরই মধ্যে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয়ের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বছরে কোটি টাকা ব্যয় করে একাধিক সন্তানকে বিদেশে পড়াশোনা করাচ্ছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যদের নামে বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত চলছে। তদন্তে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, নিজের বা অন্যের নামে আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা এবং আয়বহির্ভূত সম্পদ আছে কি না। নিজের বা অন্যের নামে দেশে-বিদেশে উচ্চমূল্যের একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, ভিলা, জমি, বাণিজ্যিক স্থাপনা আছে কি না, সেসবেরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সন্দেভাজন কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন কি না এবং ব্যাংকে নিজের ও অন্যের নামে কী পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন, তাও দেখা হচ্ছে। তদন্তের প্রয়োজনে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। 

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, রাজস্ব খাতে গতি আনতে এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে কাজ করবেন। তবে দুর্নীতিবাজ, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী, ঘুষখোরদের কোনো জায়গা এনবিআরে হবে না। সাধারণ মানুষকে সেবা প্রদান করাই এনবিআরের দায়িত্ব।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের সততা ও জবাবদিহির গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলেই তিনি দুর্নীতিবাজ নন। তদন্ত করে দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করদাতাকে এনবিআরের কোনো অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়রানি করলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। প্রত্যেক করদাতা আমাদের কাছে সম্মানিত করদাতা।’ 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ শতাধিক এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এসেছে। রক্ষকই যদি ভক্ষক হন, তা হলে কীভাবে দেশ চলবে? বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানাব, এনবিআরকে যেন দুর্নীতিমুক্ত করা হয়।’ 
সচিবালয়ে এক সভা শেষে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি চাই ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা) ও অ্যাকাউন্টিবিলিটির (জবাবদিহিতা) সঙ্গে মানুষের সেবা দেওয়া হোক। এতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ 

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যারা সারা জীবন এভাবে কাজ করেছেন, তাদের সমস্যা হতে দেখেছেন? যাদের কাজে বিচ্যুতি ঘটে, তারাই জবাদিহির আওতায় আসেন এক দিন না এক দিন।’

দুর্নীতির অভিযোগে এনবিআরের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে তাদের কয়েকজন হলেন, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুর রশীদ মিয়া; এনবিআরের সদস্য লুতফুল আজীম; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম; যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান,এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম; ঢাকা কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা; বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর উপ-কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান তারেক রিকাবদার; কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু। 

কৃত্রিম পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ২৮ জুলাইযোদ্ধার

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১১:১৫ এএম
আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১১:১৮ এএম
কৃত্রিম পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ২৮ জুলাইযোদ্ধার
ছবি: খবরের কাগজ

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে কৃত্রিম পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছেন জুলাইযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম। তিনি হাঁটেন আর চিকিৎসকরা তা পর্যবেক্ষণ করেন। ঠিকঠাক হাঁটার জন্য একজন তাকে ‘ব্রিফ’ করেন। কৃত্রিম পায়ে ভালোভাবে হাঁটা-চলা রপ্ত করতে পারলেই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন শফিকুল।

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে ‘ব্র্যাক কৃত্রিম পা সংযোজন ও চিকিৎসাকেন্দ্রে’ (বিএলবিসি) গিয়ে এমনটি জানা যায়। এখানে কেবল শফিকুল নন, তার মতো আরও অনেকেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পঙ্গুত্ববরণ করার পর কৃত্রিম হাত ও পা বা অঙ্গ সংযোজন করে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা খবরের কাগজকে বলেন, পা হারিয়ে তাদের মনে হয়েছিল আর কখনোই তারা হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু ব্র্যাক তাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাদের চিকিৎসা ও নিবিড় যত্নে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ব্র্যাকের ওই প্রতিষ্ঠানটি। 

ব্র্যাক কৃত্রিম পা সংযোজন ও চিকিৎসাকেন্দ্রের তথ্যমতে, জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই সহিংসতায় হাত বা পা হারানো ৩৪ জনকে চিকিৎসা ও সহায়তা দিয়েছে ব্র্যাক। এদের মধ্যে কৃত্রিম হাত সংযোজন করা হয়েছে ৬ জনের এবং পা সংযোজন করা হয়েছে ২৮ জনের। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বাড়ি ফিরে গেছেন, কেউবা শিগগিরই যাবেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৬ জুলাই গাজীপুরের সফিপুর আনসার-ভিডিপি একাডেমির সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন শফিকুল ইসলাম। এরপর তার ডান পা কেটে ফেলা হয়। ব্র্যাক শফিকুলকে কৃত্রিম পা দিয়েছে। এখন তিনি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। আবারও ফিরে যেতে চান কর্মজীবনে। শফিকুলের ডান পা এখন অনেকটা রোবটের পায়ের মতো। তার কথা বলতে গেলে তিনি কৃত্রিম পা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করে দেখালেন। 

আলাপকালে শফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনি প্রথমে গাজীপুরের শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখান থেকে পঙ্গু জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) হাসপাতালে পাঠানো হয়। পঙ্গুতে দুই মাস চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় চলে যান। কিছুদিন পর অবস্থার অবনতি হলে আবারও পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, শফিকুলের পায়ে পচন ধরেছে, কেটে ফেলতে হবে। পরে চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়। 

তিনি বলেন, ‘পঙ্গুতে থাকতেই ব্র্যাকের চিকিৎসকরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তাদের সহায়তায় ব্র্যাক সেন্টারে চিকিৎসার জন্য আসি। এখন পায়ে থেরাপি দেওয়া হচ্ছে ও কৃত্রিম পা লাগিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি। কৃত্রিম পা দেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসার সব খরচ বহন করেছে ব্র্যাক।’

পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে শফিকুলের। তিনি বলেন, ‘দুজন কন্যাসন্তান আছে, একজন কলেজে পড়ে।’ জানান, তিনি ইজিবাইক চালাতেন। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আয় বন্ধ। দুই ভাই মাসে কিছু টাকা দেন তা দিয়ে একবেলা খাবার জোটে সন্তানদের।’ এসব করুণ অবস্থা বলতে গিয়ে শফিকুলের দুই চোখ ভিজে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এ সময় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। 

এই চিকিৎসাকেন্দ্রে আরও যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জাহিদ খান, জহিরুল ইসলাম ও জোবায়ের হাসান। জুলাই আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তারা। ১৯ জুলাই রামপুরায় বাম হাতের কবজিতে গুলি লাগে জাহিদের। জাহিদ বরিশাল সরকারি কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। জহিরুল ৫ আগস্ট উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হন ও জোবায়ের ১৯ জুলাই রামপুরায় গুলিবিদ্ধ হন। তাদের দুজনের ডান হাতে গুলি লাগে। 

জাহিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের জন্য রাস্তায় নামি। পুলিশের গুলি আমাকে দমাতে পারেনি। ওই দিন দুপুরে রামপুরায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। একটি গুলি বাম হাতের কবজিতে লাগে।’ 

তিনি বলেন, ‘শিক্ষাজীবন নিয়ে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা। আমাকে কে চাকরি দেবেন। পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। এখন চোখে-মুখে শুধু অন্ধকার দেখি!’ 

আহত জহিরুল ও জোবায়ের খবরের কাগজকে জানান, দুজনই বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন। তারা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাদের পরিবারের সদস্যদের। ওই দুই তরুণ আরও জানান, সরকারের কাছ থেকে এই এক বছরে এক লাখ টাকা ও হেলথ কার্ড পেয়েছেন। এই টাকায় কিছুই হয় না। ব্র্যাকের চিকিৎসা না পেলে তারা সেরে উঠতে পারতেন না।

ব্র্যাক জানায়, জুলাই আন্দোলনের সময় থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাদের কয়েকটি টিম কাজ করেছে। আন্দোলনে যারা গুলিবিদ্ধ বা বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন তারা তাদের তালিকা করে চিকিৎসা দিয়েছে। এই তালিকায় ঢাকার ১৩টি হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতাল রয়েছে। প্রথমে তারা ৪১৬ জনের একটি তালিকা করে। তাদের ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়। হাত বা পা হারানো ৩৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া ছাড়াও ৬১ জনকে চিকিৎসা উপকরণ, ৪৮ জনকে ফিজিওথেরাপি, ৮০ জনকে ওষুধসহ মেডিকেল সার্ভিস ও সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হয়েছে। 

এ বিষয়ে ব্র্যাক কৃত্রিম পা সংযোজন ও চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. শাহিনুল হক রিপন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্র্যাকের উদ্যোগে বিনামূল্যে তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাত বা পা হারানো ৩৪ জনকে চিকিৎসা ও সহায়তা দিয়েছে ব্র্যাক।’ 

তিনি বলেন, ‘দেশের যেকোনো দুর্যোগে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য। ব্র্যাক দেশ ও মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এ-সংক্রান্ত ৫ বছরের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন যারা চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তারা আগামী পাঁচ বছর সব ধরনের ফলোআপ সেবা পাবেন।’ 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন হয়। ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বলা হয়। সরকার প্রতিবছর ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে। দিনটিতে সাধারণ ছুটি থাকবে।

নতুন কর্মকর্তাদের দিয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চায় সরকার

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৪ এএম
নতুন কর্মকর্তাদের দিয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চায় সরকার
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

দক্ষ ও পেশাদার কর্মকর্তা দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। স্বচ্ছ, কর্মঠ, পেশাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ দিতে কর্মকর্তাদের ভাইভা নেওয়া শুরু হয়েছে।

মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ডিসিরাই নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। একজন ডিসি সংশ্লিষ্ট জেলার শীর্ষ নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটকেন্দ্র স্থাপনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রধান করে কমিটি করার বিধান ইতিমধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব। এমন সব সংশোধনী এনে গত ৩০ ‍জুন ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। 

সরকার এসএসবির মাধ্যমে এমন কর্মকর্তা বাছাই করতে চাইছে, যাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হলে ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ বা ‘দিনের ভোট রাতে’ এমন অভিযোগ বা বিতর্ক না ওঠে এবং নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। উল্লেখ্য, দেশে অনুষ্ঠিত বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সর্বাগ্রে নিরপেক্ষ মাঠ প্রশাসন প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিসি নির্বাচন ঘিরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে চাইছে প্রশাসন।

সরকারের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন রয়েছে প্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নসংক্রান্ত জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের জীবনবৃত্তান্ত, অতীত কর্মক্ষেত্রে ভূমিকা, পারিবারিকসহ ছাত্রজীবনের ইতিহাস ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তারই ভিত্তিতে নির্বাচন করা হবে ডিসিদের। এ কারণেই ইতোমধ্যে ডিসি ফিটলিস্টে উত্তীর্ণ ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদেরও তথ্যও নতুন করে মাঠ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে। চার মাস আগে বর্তমানে ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী ২৪ ব্যাচের ২১ জন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। তবে সেসব জেলায় তাদের পরিবর্তে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। সরকারের  চলমান এসব প্রক্রিয়া শেষ হলেই প্রত্যাহার করা ডিসিদের পদে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়ার আদেশ জারি করবে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই গত সেপ্টেম্বরে নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম দফায় প্রণীত তালিকায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ১০৬ জন কর্মকর্তাকে রাখা হয়। এর মধ্যে ৬৪ জনকে ডিসি করা হয়। পরে পুরোনো তালিকা অনুসরণ না করে নতুন ফিট লিস্ট করে ডিসি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে ১১ জানুয়ারি নতুন তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। ২৪ ব্যাচের ২১ জন ডিসি চার মাস আগে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেলেও তাদের জেলা থেকে এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।
 
২০০৬ সালের ২১ আগস্ট ২৫তম এবং ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে নিয়োগ পান। তারাই এখন ডিসির দায়িত্বে রয়েছেন। প্রথম দফায় ২৪, ২৫, ২৭ ব্যাচের উপসচিবদের ডিসি মনোনয়নে ফিটলিস্ট প্রস্তুত করা হয়। তাদের বিভিন্ন সময়ে এসএসবির মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ডাকা হয়। পরে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের নিয়োগ দেওয়া সব জেলার ডিসিদের প্রত্যাহার করে এই তিন ব্যাচ থেকেই ডিসি পদে নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। 

ইতোমধ্যে উপসচিব (ডিসি) থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ২১ কর্মকর্তাকে মাঠ থেকে উঠিয়ে এনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফলে সেই সব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ প্রয়োজন। এই জেলাগুলো হলো ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ঝালকাঠি, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, পঞ্চগড়, মাগুরা, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, পিরোজপুর, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, মাদারীপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ডিসি পদে নিয়োগে যাতে কোনো বিতর্ক না হয়, সে জন্য এবার অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তাই কর্মকর্তাদের নিবিড়ভাবে বাছাই করা হচ্ছে। সৎ, যোগ্য, পেশাদার কর্মকর্তাদের বিশেষ বিবেচনায় আনা হবে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে বিবেচনায় আনা হবে না। নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বিধায় নতুন ডিসি নিয়োগে কিছুটা সময় লাগছে। বাছাই তালিকা চূড়ান্ত শেষে পদোন্নতি পাওয়া ডিসিদের স্থলে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে।

মব সন্ত্রাস: পরিস্থিতি নিয়ে ধূম্রজালে পুলিশ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০১:৫৪ পিএম
মব সন্ত্রাস: পরিস্থিতি নিয়ে ধূম্রজালে পুলিশ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ হামলা-নৃশংসতার ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমাজে ক্রমশ বাড়ছে। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক ধরনের ‘শৈথিল্য’ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে অনেকে অভিযোগ তুলছেন। যদিও সরকার, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, মব সন্ত্রাসের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। কিন্তু তারপরও থামানো যাচ্ছে না মব সন্ত্রাস। প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনা সামনে আসছে। এতে জনমনে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়টিও মানুষকে ভাবাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠছে, মব ভায়োলেন্স থামানোর ব্যাপারে পুলিশ আসলে কতটা সক্রিয়। পাশাপাশি এ বাহিনীর সক্ষমতা কতখানি এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারের পতনের আন্দোলনে পুলিশের ওপর দিয়ে যে বিপর্যয় গেছে, সেই ট্রমা কতখানি দূর হয়েছে আলোচনা আছে এ নিয়েও। অনেকের মতে, পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। নিরপেক্ষভাবে পুলিশের দায়িত্ব পালনের মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি আছে কি না, তা নিয়েও অনেক বিশ্লেষক কথা বলছেন। তাদের মতে, প্রতিদিনই যেসব মব ভায়োলেন্সের খবর আসছে এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যায়, এটি পুলিশের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়ে। যদিও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু কয়েক যুগ ধরে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিগত হাসিনা সরকারের নির্দেশনায় দায়িত্ব পালন করায় পুলিশের বিরুদ্ধে জনমনে ব্যাপকভাবে ক্ষোভ তৈরি হয়। এরই বিস্ফোরণ ঘটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এখন জনগণের পক্ষে দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও পুলিশের কোনো ভূমিকা বা সিদ্ধান্ত কার বিরুদ্ধে যায়, তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বেগ রয়েছে। বর্তমান সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে এবং ভবিষ্যতে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে এ বিষযটিও তাদের বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হয়। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ছাড়াও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছেন জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল। এই দলগুলোর তৎপরতার দিকেও চোখ রেখে চলতে হচ্ছে পুলিশকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বাহিনীর সদস্যরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছেন। 

কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই ও পটিয়া থানায় হামলাসহ সম্প্রতি বেশ কিছু মব সন্ত্রাসের ঘটনায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সচেতন মহলে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মব ভায়োলেন্স বা ‘গণপিটুনির’ ঘটনায় কমপক্ষে ৯৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। 

অপরাধ বিশ্লেষকরা এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বল ভূমিকা বা তৎপরতার অভাবকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে গিয়ে পুলিশ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করছে। বেশির ভাগ মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটছে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে। ফলে নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় যাবে, কারা এখন মাঠে শক্তিশালী সেসব হিসাব কষছেন পুলিশের অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে আবার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে পুলিশ নিজেরাও মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। নানা ‘ট্যাগ’ দিয়ে অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এসব পরিস্থিতির কারণেও পুলিশ অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্ত বা ধূম্রজালের মধ্যে পড়ছেন। ঘটনার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে তাদের কী করা উচিত বা কোনটি সঠিক- অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেটি বুঝতে পারছে না। 

এই প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব ভায়োলেন্স বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে মূলত পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বল ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে দায়ী। মব ভায়োলেন্স বা এই জাতীয় বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। যারা কমান্ড বা নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তারাও ঠিকমতো সেটা দিচ্ছেন না। আবার যারা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন, তারাও মাঠপর্যায়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে মব ভায়োলেন্সের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশকে আইন অনুসারে চলতে হবে। এসব বিষয়ে কঠোর অ্যাকশনের কোনো বিকল্প নেই।’

মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা বা যোগসূত্র টানছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই ধরনের পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এসব বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। 

এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন যা হচ্ছে সেগুলোকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মব ভায়োলেন্স বলবো না। এগুলো মব ভায়োলেন্সের সংজ্ঞায় পড়ে না। এগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক মব। এই মব অপরাধ ঠেকাতে বা রুখতে সরকারের মধ্যে আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। যেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট অনেকের বক্তব্যেও ফুটে উঠছে। পুলিশকে আগের সরকারও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি, এখনো তেমনই অবস্থা রয়ে গেছে। এই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারকে এখনই কঠোর হতে হবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিতে হবে বা আলোচনায় বসতে হবে। কঠোর বার্তা ও যথাযথ আইন প্রয়োগ ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

এদিকে মব ঠেকানো বা বড় সংকট নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ কতটুকু সক্ষম বা তাদের মনোবল কোন পর্যায়ে রয়েছে সে প্রশ্নও দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাঠামো বাংলাদেশ পুলিশ এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পুলিশও হরহামেশা প্রতিনিয়ত মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। তারাও মব সন্ত্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর দুই শতাধিক হামলা বা মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে। 

এই প্রসঙ্গে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী যেসব মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক যোগসাজশে বা পূর্ব বিরোধের সূত্র ধরে। মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা যেমন বাড়ে, তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ে। এই অবস্থায় বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে, সেখানে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই জাতীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারছে না। পুলিশও কোনো কোনো সময় বিষয়গুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় নিচ্ছে। অনেক সময় কী করবে সেটা নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই পুলিশ শক্তভাবে ঘুরে না দাঁড়ালে সাধারণ মানুষের আস্থা আরও নষ্ট হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা রাষ্ট্রকেই মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (গণমাধ্যম) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময়ই সজাগ ও সোচ্চার রয়েছে। যখনই অভিযোগ পাওয়া যায় তখনই পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পুলিশকে সহযোগিতা করাও নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব। কেউ কোনো বিষয়ে অপরাধী হয়ে থাকলে সেটা পুলিশকে জানান, পুলিশ যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু কোনোভাবেই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

মানবাধিকার সংস্থা- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায়, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে ৯৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। “গণপিটুনি বা ‘মব সন্ত্রাস’ একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। রাষ্ট্র যদি এই ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে নিশ্চিতভাবেই এ দায় রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় এবং উচ্ছৃঙ্খল ও বর্বরতাকে আশ্রয় দেয় বলে বিবেচিত হয়। চলমান এই সহিংসতা রুখতে রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর, কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এদিকে পটিয়া থানা, পাটগ্রাম থানা, ফরিদপুরে ব্যবসায়ী এ কে আজাদের বাসভবনে হামলা, কুমিল্লার মুরাদনগরে বাড়ি ঘেরাও করে পিটিয়ে মা-ছেলেসহ অনেককে হত্যাসহ নারী-শিশু নিপীড়নের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। গত শুক্রবার বাম জোটের নেতারা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘সরকারের প্রেস সচিব যেভাবে মবকে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তথ্য উপদেষ্টা যেভাবে মবকে গণআদালত, গণজাগরণ মঞ্চসহ অন্যান্য গণআন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন এতে করে জনমনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে সরকার কি মবকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?’

তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে একদল লোক মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে রোকসানা আক্তার রুবি, তার ছেলে রাসেল মিয়া ও মেয়ে জোনাকি আক্তারকে নিজ বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনায় র‌্যাব গতকাল পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তার আগে গত ২৬ জুন রাতে মুরাদনগরে একটি গ্রামে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি আটক ও পিটুনির শিকার হয়। কিছু ব্যক্তি ওই ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। এ ঘটনাতেও জড়িত একাধিক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।

অপরদিকে গত ১ জুলাই রাতে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে পটিয়ার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা। পরে তাকে থানায় নিয়ে গেলে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ শুরুতে গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে বিপুল লোকজন জড়ো হয়ে থানা ঘেরাওসহ ওসিকে অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। একপর্যায়ে ২ জুলাই রাতে রাতে ওসিকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। 

গত বুধবার রাতে পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামিকে থানা থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার আগের রাতে মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীর জাকারিয়া হোটেলে দল বেঁধে ঢুকে দুই নারীর ওপর হামলা করেন যুবদলের নেতা-কর্মীরা। বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেনের নেতৃত্বে এই হামলার ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনার ভিডিও প্রকাশ হলে দল থেকে মনির হোসেনকে বহিষ্কারসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ জানায় বিএনপি।

এর আগে সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরানো এবং লালমনিরহাটে সংখ্যালঘু বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে হেনস্তা, ধানমন্ডিতে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিককে মব সৃষ্টির মাধ্যমে হেনস্তার ঘটনাগুলোয় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

নতুন টেলিকম নীতিমালা ঘিরে বিতর্ক প্রকাশ্যে

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১১:৫৭ এএম
নতুন টেলিকম নীতিমালা ঘিরে বিতর্ক প্রকাশ্যে
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

টেলিযোগাযোগ খাতে লাইসেন্স কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা নিয়ে আপত্তি উঠেছে। নীতিমালাটি প্রকাশের পর পরই অংশীজন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে তা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের শঙ্কা, প্রস্তাবিত এই সংস্কার বাস্তবায়িত হলে দেশীয় উদ্যোগ এবং ছোট অপারেটররা অস্তিত্বসংকটে পড়বেন। নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কর্মসংস্থানেও। তারা অভিযোগ করেছেন, আধুনিকায়নের নামে এখানে নিয়ন্ত্রণের নতুন ফাঁদ পাতা হয়েছে।

অন্যদিকে সরকার বলছে, নতুন এই নীতিমালার মূল লক্ষ্য গ্রাহকদের ভয়েস কল ও ডেটা সেবার খরচ কমানো এবং সেবার মান উন্নয়ন করা। সরকারের ভাষ্যমতে, অতীতে যেসব প্রতিষ্ঠান বহু স্তরবিশিষ্ট লাইসেন্স কাঠামোর সুবিধা নিয়ে মুনাফা করেছে, তারাই এই সংস্কারের বিরোধিতা করছে। কারণ এতে তাদের একচেটিয়া অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্স কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মোবাইল এবং ফিক্সড টেলিকম সেবার জন্য ‘অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার (ANSP)’ নামে নতুন ধরনের লাইসেন্স চালু করা হবে। এই লাইসেন্সধারীরা সরাসরি গ্রাহকদের কাছে ভয়েস ও ডেটা সেবা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।

অন্যদিকে ফাইবার অপটিক, টেলিকম টাওয়ার ও ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মতো জাতীয় পর্যায়ের নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য প্রবর্তিত হচ্ছে ‘ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (NICSP)’ লাইসেন্স। আন্তর্জাতিক ভয়েস কল, ইন্টারনেট এবং ডেটা সংযোগ সেবার জন্য থাকবে ‘ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (ICSP)’ লাইসেন্স।

সেই সঙ্গে স্যাটেলাইট, নন-টেরিস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্ক (NTN) এবং উচ্চ-উচ্চতায় স্থাপিত প্ল্যাটফর্ম (HAPs)-ভিত্তিক সংযোগ সেবার জন্য ‘নন-টেরিস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্কস অ্যান্ড সার্ভিস প্রোভাইডার (NTNSP)’ লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এ ছাড়া এসএমএস অ্যাগ্রিগেটর, ওটিটি বা অন্য টেলিকমনির্ভর ডিজিটাল সেবার জন্য সংশ্লিষ্টদের ‘টেলিকম অ্যানাবলড সার্ভিস প্রোভাইডার (TESP)’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে।

নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে পুরোনো লাইসেন্স কাঠামো- যেমন IGW, IIG, ICX, NIX ও MNP লাইসেন্স ধাপে ধাপে বাতিল হয়ে যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে ২০২৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নতুন কাঠামোর আওতায় লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। ফলে এটি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
 
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-এর সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২১ সালে আইএসপিদের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা ২০২২ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়। সেই নীতির ভিত্তিতে আমরা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজিয়েছি। কিন্তু এখন ২০২৫ সালে এসে আবার নতুন একটি নীতিমালার প্রস্তাব এসেছে। সামনে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে আগামী বছর আরও একটি নতুন নীতি আসবে না- এ নিশ্চয়তা কোথায়?’

তিনি আরও বলেন, ‘টেলিকম খাত কোনো উৎপাদন খাত নয়। এখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। নীতিমালায় ঘন ঘন পরিবর্তন আমাদের মতো স্থানীয়, বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফিক্সড টেলিকম অপারেটরদের ৯৫ শতাংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা; তাদের জন্য নীতির অস্থিরতা টিকে থাকার জন্য হুমকিস্বরূপ।’

আইএসপিএবির সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো উন্মুক্ত ও অস্পষ্ট নীতিমালা চাই না। স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে- লাস্ট মাইল ফাইবার সংযোগ দেবে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড অপারেটররা এবং ওয়্যারলেস সংযোগ দেবে টেলিকম অপারেটররা।’ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন টেলিকম অপারেটর কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই বড় বিনিয়োগ করেছি। এখন নতুন লাইসেন্স নিতে গিয়ে আবার বিশাল অর্থ ও সময় ব্যয় হবে। এটি বাস্তবায়নের আগে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল।’

এদিকে খসড়া এই নীতিমালা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও এই মুহূর্তে এ ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করছি।’ তিনি বলেন, ‘এই নীতির উদ্দেশ্য হলো লাইসেন্সিং পদ্ধতি সহজ করা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি উৎসাহিত করা এবং গ্রামীণ জনগণের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো; যা অবশ্যই ইতিবাচক একটি বিষয়। তবে খসড়া নীতিমালাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এতে কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে, যা টেলিকম খাতে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নে বাধা দিতে পারে। এই নীতিমালায় ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান (SME) এবং স্থানীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ 

এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘এ ধরনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ এবং মতামতকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখি। তবে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। আমাদের ধারণা, কিছু মহলের প্রভাবে বিএনপি মহাসচিবের মাধ্যমে একটি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’

লাইসেন্স জটিলতা ছাড়াও এই নীতিমালার মাধ্যমে টেলিকম খাতকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘বিদেশিরা অভিযোগ করছেন, বিনিয়োগে নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে (এফডিআই) বাধা তৈরি করা হচ্ছে। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করার পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরও সুরক্ষা দিতে চাইছি। অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার সবকিছুই বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই দুটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, বাস্তবতা আসলে কোনো একক দিক নয়-আমরা একধরনের মধ্যম পরিস্থিতির মধ্যেই অবস্থান করছি।’

আইসিটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিমালাটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর জন্য যুগোপযোগী। তবে বাস্তবায়ন ও ন্যায্যতা না থাকলে এটি ভালো উদ্দেশ্য নিয়েও ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া এ বিষয়ে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত টেলিকম নীতিমালায় বড় কোম্পানির একচেটিয়া সুবিধা থাকলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও গ্রামীণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক পরামর্শ ও উদ্ভাবনবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি এখানে অনুপস্থিত। আমরা ‘লাইসেন্সিং’, গ্রামীণ সম্প্রসারণের বাধ্যবাধকতা, স্বচ্ছ পরামর্শ প্রক্রিয়া এবং একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠনের দাবি জানাই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক নীতিমালা অপরিহার্য।’

এদিকে সরকার জানিয়েছে, দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে আধুনিকতা, প্রতিযোগিতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘টেলিকম নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রিফর্ম পলিসি-২০২৫’-এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এই নীতির মূল লক্ষ্য হলো, জটিল ও পুরোনো লাইসেন্স-ব্যবস্থাকে সহজ করা, উদ্ভাবন ও বিনিয়োগে সহায়ক পরিবেশ তৈরি, প্রতিযোগিতা বাড়ানো, সাশ্রয়ী দামে উন্নত মানের টেলিকম সেবা নিশ্চিত করা এবং একটি নিরাপদ ও টেকসই ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলা।

এ বিষয়ে বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন এই নীতিমালার মূল লক্ষ্য হলো গ্রাহকদের জন্য ভয়েস কল ও ডেটা সেবার খরচ কমানো এবং সেবার মান উন্নয়ন। অতীতে যেসব প্রতিষ্ঠান বহু স্তরবিশিষ্ট লাইসেন্স কাঠামোর সুবিধা নিয়ে মুনাফা করেছে, তারাই এই সংস্কারের বিরোধিতা করছে, কারণ এতে তাদের একচেটিয়া অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, খসড়া এই নীতি নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক ওঠা ও এই নীতিতে অংশীজনদের মতামত নিতে শিগগিরই নীতিটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। সেখানে সর্বসাধারণ তাদের মতামত জানাতে পারবেন, যা নীতিটিকে আরও জনবান্ধব করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গেও কথা বলা হবে। এতে নীতিমালায় কোনো প্রতিবন্ধকতা বা কোনো জটিলতা থাকলে তা কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

এ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেলিকম নীতিমালার উদ্দেশ্য যদি হয় উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল প্রবৃদ্ধি, তবে তা যেন নতুন জটিলতা না আনে। নীতিমালার বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, অংশীদারত্ব এবং ধাপে ধাপে রূপান্তর না হলে এটি ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনার চেয়ে বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

অতিবর্ষণে রাজধানীর সড়ক যেন উপকূলীয় এলাকা

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৬ এএম
অতিবর্ষণে রাজধানীর সড়ক যেন উপকূলীয় এলাকা
ছবি: খবরের কাগজ

একটু বেশি বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক উপকূলের নিম্নাঞ্চলের মতো প্লাবিত হয়। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থায় গলদ থাকায় এসব সড়কে দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থাকে। আর এতে মানুষের এবং যানবাহন চলাচলে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। হাঁটু পর্যন্ত পোশাক তুলে ও জুতা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে হয়। সড়কের পাশের বাসাবাড়ির নিচতলা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে বসবাসকারী বিভিন্ন এলাকার মানুষ যেন মাঝে মাঝে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চলে বসবাসের অনুভূতি পাচ্ছেন। চরম ভোগান্তি পোহালেও এসব এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না স্থায়ী সমাধান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং সেসব এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জুরাইনের একটি মিষ্টির দোকানের ব্যবসায়ী বলেন, ‘বেশি বৃষ্টি হলে দোকানে পানি ঢুকে যায়। সড়কের পাশের বাসাগুলোর নিচতলায়ও পানি ঢুকে পড়ে। সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় সৃষ্ট ঢেউয়ে আরও বেশি পানি ঢুকে পড়ে। বৃষ্টি থামলে বালতি বা গামলা দিয়ে পানি সেচে বের করতে হয়। একটু বেশি বৃষ্টি মানেই আমাদের জন্য চরম দুর্ভোগ।’

রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পূর্ব জুরাইনের ২৪ ফিট থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি, কমিশনার মোড়, মিষ্টির দোকান হয়ে জুরাইন মেইন সড়ক পর্যন্ত কয়েকটি স্থানে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যায়। পানি নামতে দীর্ঘ সময় লাগে। শনির আখড়া থেকে ২৪ ফিট যেতে জাপানি বাজারের পর ৬ নম্বর সড়কের মুখের একটু আগে থেকেই ৭, ৮ এবং ৯ নম্বর সড়কে প্রবেশমুখসহ ২৪ ফিট পর্যন্ত সড়ক বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়।

পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা সবুজ বলেন, ‘বৃষ্টি হলে বাইক নিয়ে বের হওয়া মুশকিল। যদি দিনভর বৃষ্টি হয়, তখন হাঁটুসমান পানি হয়ে যায়। সে জন্য বৃষ্টি হলে ভয়ে থাকি।’ 

জুরাইন রেলগেট থেকে দয়াগঞ্জ যেতে গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের সামনের সড়কের খানাখন্দে বেশির ভাগ সময়ই পানি জমে থাকে। এখানকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। সড়কের পানি শুকায় সূর্যের তাপে আর গাড়ির চাকায়। রেলস্টেশনের দিকে যেতে এখানে একটি আন্ডারপাসের কাজ চলমান। এর একটু সামনে দয়াগঞ্জের দিকে যেতে দেখা গেছে- পানি নিষ্কাশনের মুখগুলো সড়কের চেয়ে উঁচু। ফলে বৃষ্টির পানি নামতে পারে না। যেদিক দিয়ে পানি নামে, সেসবের মুখ কাদায় আটকে গেছে।

জুরাইনের রেলগেট থেকে গুলিস্তান সড়কে চলাচলকারী লেগুনাচালক হাসান বলেন, ‘গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের সামনের এই সড়কের পানি খুব কম সময়ই শুকায়। খানাখন্দের এই পানি হয়তো শুকনা মৌসুমে কিছুদিন থাকে না। আর বছরের ১০ মাসই এখানে পানি থাকে। এই জায়গা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে আমাদের খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বেশি পানি হলে তখন রাস্তা বোঝা যায় না। অনেক সময় খানাখন্দে গাড়ির চাকা আটকে যায়। তখন পানির মধ্যে যাত্রী নামিয়ে দিতে হয়। যাত্রীরাও বকাঝকা করেন। পরে আমাদের লোকজন নিয়ে এসে গাড়ি ঠেলে তুলতে হয়। ওই পাশে পাইপ-রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ।’

ইত্তেফাকের মোড় থেকে মানিকনগরের দিকে যেতে গোপীবাগের একটি অংশে, টিকাটুলী ফুটওভার ব্রিজ থেকে বামের সড়কে কিছু দূর যাওয়ার পর সোজা সেন্ট্রাল উইমেন কলেজ রেখে সামনের মোড়ে পানি জমে থাকে। বেশি বৃষ্টি হলে ব্যাংকপাড়া হিসেবে পরিচিত মতিঝিলের মূল সড়কেই পানি জমে যায়। নিউ মার্কেট সড়কে জমে হাঁটুসমান পানি। প্লাবিত হয় শাহজাহানপুরের বিভিন্ন অলিগলি।

আগারগাঁওয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাসিমা রাজ্জাক যুঁথি বলেন, ‘আমার বাসা মীরপুর-১ নম্বরে। আমি মীরপুর-১০ নম্বর হয়ে যাতায়াত করি। বৃষ্টি হলে শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ নম্বর মোড় থেকে ২ নম্বরের দিকে যেতে, মীরপুর-১ নম্বরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে, মিরপুর নিউ মার্কেটের সামনে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা সালমা শান্তা জানান, একটু বৃষ্টি হলেই মিরপুর রোডের ধানমন্ডি‑২৭ নম্বরের সিগনালে পানি জমে যায়। এ ছাড়া পান্থপথের দিকেও পানি জমতে দেখেছেন তিনি। 

কাঁঠালবাগান ঢালে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আর বেশি বৃষ্টি হলে নিচতলার বাসাগুলোতে পানি ঢুকে যায়। এখানকার বাসিন্দা মুন বলেন, ‘আমার বাসায় তো সামান্য বৃষ্টি হলে পানি ঢুকে যায়। তখন আমাদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়।’ 

উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, জয়নাল মার্কেটের পাশে, রেললাইনের পাশে, ফায়দাবাদ ও আটিপাড়ায় পানি জমে যায়।

রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টির কারণে সড়কে কোথাও সামান্য, কোথাও বেশি কাদা থাকে। রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক পরিষ্কার নয়। এর চেয়ে গ্রামের অনেক সড়কও বেশি পরিষ্কার। এসব কাদামাটি ও রাস্তায় ফেলে দেওয়া পলিথিন একসময় গিয়ে পানি নিষ্কাশনের মুখ বন্ধ করে দেয়। নিয়মিত রাজধানীর সড়ক পরিষ্কার করলে কাদা কম হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পানি জমে থাকার কারণ হচ্ছে খালগুলোর ন্যাচারাল সংযোগ নেই। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে খালগুলো ‘কাগজ থেকে বাস্তবে’ ফিরিয়ে আনতেই হবে। তা না হলে জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু, পরিবেশ দূষণ- সব সমস্যাই বাড়বে।

তাদের মতে, খাল পুনরুদ্ধার ছাড়া ঢাকার জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। খাল বাঁচানো গেলে শুধু পানি নিষ্কাশনই নয়, শহরেও প্রাণ ফিরবে। 

জানা গেছে, ঢাকায় একসময় ৫০টিরও বেশি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান ভরসা ছিল এই খালগুলো। কিন্তু দখল, দূষণ, অব্যবস্থাপনা আর নজরদারির অভাবে বর্তমানে অনেক খাল শুধু নামেই টিকে আছে। বাস্তবে সেখানে উঠে গেছে মার্কেট, গুদাম, ভবন কিংবা বস্তি! একসময় খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ওয়াসার হাতে। বছরের পর বছর ধরে এই সংস্থা কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় খাল রক্ষায় বড় ব্যর্থতা দেখা দেয়। ২০২০ সালের দিকে ওয়াসা থেকে খাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

সিটি করপোরেশনের হিসাবে এখন দখল-দূষণে সংকটাপন্ন ২৬টি খাল টিকে আছে। তাহলে বাকি খালগুলো কোথায় গেল? গেন্ডারিয়া খাল, মুগদা খাল, ধোলাই খাল ও শ্যামপুর খাল এখন কাগজে রয়ে গেলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। রূপনগর খাল, প্যারিস খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, কালশী খাল, কাঁটাসুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর খাল এবং বাউনিয়া খাল- এগুলোর অধিকাংশই এখন আর তাদের স্বরূপে নেই। একসময় যৌবন ছিল পান্থপথ খালের, যা ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিলকে সংযুক্ত করত। এই খালটি এখন শুধুই অতীত। 

দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাকে জলাবদ্ধতার একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। 

তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বস্তুত খাল, জলাশয় বা জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আমাদের নগর কর্তৃপক্ষগুলো বিগত দিনে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লোকবলের অভাবসহ নগর সংস্থাগুলোর অন্যান্য যুক্তির কোনো অভাব ছিল না। অথচ আধুনিক প্রযুক্তি, জিআইএস, স্যাটেলাইট ইমেজ অ্যানালাইসিস, ওয়াটার মডেলিং প্রভৃতি নগর পরিকল্পনার আধুনিক ধারণা প্রয়োগের মাধ্যমে খাল দখলদারদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া নগর কর্তৃপক্ষগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উদাসীনতা, দখলদারদের সঙ্গে গোপন আঁতাত কিংবা শক্তিশালী বলয়ের প্রভাবে নির্লিপ্ত আচরণ- এসব ছিল তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ।’

তিনি আরও বলেন, অপ্রতুল নগর অবকাঠামো নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শহর ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ ভবন ও মানুষকে ধারণ করে আছে, বিপরীতে জলাশয় ও সবুজ এলাকার পরিমাণ অতি অল্প। ফলে নগর পরিকল্পনার প্রকৃত অনুশীলনের মাধ্যমেই সিটি করপোরেশন ও নগর সংস্থাগুলোকে জলাবদ্ধতার সমাধান খুঁজতে হবে। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নগরসংশ্লিষ্ট যেকোনো সমস্যা সমাধানের অনেক উপাদান থাকে।

এই পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, ঢাকার খালগুলো সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত ঢাকার জলজট সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। পাশাপাশি ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা, প্রকৌশল, ব্যবস্থাপনা, সামাজিক, আইনগত, পরিবেশগত, জনমিতিগত, জনসচেতনতামূলক, সুশাসন, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি অনুষঙ্গভিত্তিক সমাধানের বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ ও তদনুযায়ী বাস্তবায়নের মধ্যেই ঢাকার জলজট সমস্যার কার্যকরী সমাধান নিহিত। সিটি করপোরেশনের কার্যকর নেতৃত্বে ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমেই ঢাকার জলজট সমস্যা সমাধানের এসব উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কার্যকর সম্ভব।

এদিকে খাল উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও বাস্তবে এসব অভিযান সীমিত এবং অকার্যকর বলেই অভিযোগ স্থানীয়দের। কেউ কেউ মনে করেন, এখন ওয়াসার স্যুয়ারেজের লাইন বসানোর কাজ জলাবদ্ধতার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যদি ড্রেনেজব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ থাকে বা কাজের সময় সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা হয়।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের ক্ষেত্রে ওয়াসার তেমন কার্যক্রম নেই। স্যুয়ারেজ লাইনে কোথাও জ্যাম থাকলে তা নিরসন করে ক্লিয়ার করা হয়। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে তিনি বলেন, নিউ মার্কেট ও শাজাহানপুর এলাকায় বৃষ্টি হলেই পানি জমে। নিউ মার্কেটের একটি ড্রেনেজ লাইন ছিল, যা বিডিআর বন্ধ করে রেখেছে। সেই ড্রেনেজ দিয়ে নিউ মার্কেটের পানি নিষ্কাশন হতো। আমরা তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। সেই লাইন আবার চালু হলে পানি আর জমে থাকবে না।’ শাজাহানপুরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে কিছু ড্রেন বন্ধ ছিল। সেগুলো খুঁড়ে চালু করার কাজ চলছে। চালু হয়ে গেলে পানি আর জমে থাকবে না।

জলাবদ্ধতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের আওতাভুক্ত প্রধান সড়কে এখন আর পানি জমে না। কারণ সংশ্লিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করে পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করা হয়েছে। এ জন্য ১২২ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার ও খনন করা হয়েছে। আরও ৫০-৬০ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে। তবে অলিগলির জলাবদ্ধতা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। বহু খাল উদ্ধার করতে হবে।’ 

জলাবদ্ধতার নিরসনে রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, গলিতে পানি জমার প্রধান কারণ মানুষজন ও হকাররা পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজের ঠিক মুখে ময়লা-অবর্জনা ফেলে রাখে। মাঝেমধ্যে ড্রেনের ভেতরও আবর্জনা ঢুকিয়ে রাখে। তাদের উচ্ছেদ করলে রাজনৈতিক প্রভাবে তারা আবার সেখানে বসে এবং ড্রেনেজ ময়লা করে। বিনিময়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা সুবিধা নেন। এসব নিরসনে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।