
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সন্দেহভাজন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নজরদারিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, করদাতাকে হয়রানি, প্রভাব খাটিয়ে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি না করলে প্রতিটি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি আরও কম হতো। শুধু তাই নয়, এই অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে সরকার রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনলাইনে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে দুর্নীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে বিধায় এই চক্র নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এই চক্রের দাপটে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। তাদের কারণে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই চক্র বিগত সরকারের সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিকে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ে আসত। পরবর্তী সময়ে সেই ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে একজোট হয়ে এই চক্র দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছে। এসব ব্যক্তি ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ট্রাইব্যুনালে প্রভাব খাটিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দিয়েছেন। সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর ফাঁকির মামলায় অসাধু ব্যক্তিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। মতিউরের অসাধুতায় মাত্র চার মাসে সরকার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক তদন্ত কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে প্রতি অর্থবছরে সরকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়াই শেষ কথা হতে পারে না, তাদের আইনের আওতায়ও আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে আছেন। অন্যদিকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
সৎ কর্মকতা-কর্মচারীদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাপে থাকেন। বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে ঠিকমতো রাজস্ব আদায় হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি অসৎ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনে, তা হলে রাজস্ব খাতে গতি আসবে।’
এদিকে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাজস্বের আওতা বাড়ানোর কথা বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব দপ্তর স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শূন্য পদে নতুন নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
তদন্তে এরই মধ্যে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয়ের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বছরে কোটি টাকা ব্যয় করে একাধিক সন্তানকে বিদেশে পড়াশোনা করাচ্ছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যদের নামে বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত চলছে। তদন্তে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, নিজের বা অন্যের নামে আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা এবং আয়বহির্ভূত সম্পদ আছে কি না। নিজের বা অন্যের নামে দেশে-বিদেশে উচ্চমূল্যের একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, ভিলা, জমি, বাণিজ্যিক স্থাপনা আছে কি না, সেসবেরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সন্দেভাজন কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন কি না এবং ব্যাংকে নিজের ও অন্যের নামে কী পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন, তাও দেখা হচ্ছে। তদন্তের প্রয়োজনে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, রাজস্ব খাতে গতি আনতে এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে কাজ করবেন। তবে দুর্নীতিবাজ, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী, ঘুষখোরদের কোনো জায়গা এনবিআরে হবে না। সাধারণ মানুষকে সেবা প্রদান করাই এনবিআরের দায়িত্ব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের সততা ও জবাবদিহির গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলেই তিনি দুর্নীতিবাজ নন। তদন্ত করে দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করদাতাকে এনবিআরের কোনো অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়রানি করলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। প্রত্যেক করদাতা আমাদের কাছে সম্মানিত করদাতা।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ শতাধিক এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এসেছে। রক্ষকই যদি ভক্ষক হন, তা হলে কীভাবে দেশ চলবে? বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানাব, এনবিআরকে যেন দুর্নীতিমুক্ত করা হয়।’
সচিবালয়ে এক সভা শেষে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি চাই ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা) ও অ্যাকাউন্টিবিলিটির (জবাবদিহিতা) সঙ্গে মানুষের সেবা দেওয়া হোক। এতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যারা সারা জীবন এভাবে কাজ করেছেন, তাদের সমস্যা হতে দেখেছেন? যাদের কাজে বিচ্যুতি ঘটে, তারাই জবাদিহির আওতায় আসেন এক দিন না এক দিন।’
দুর্নীতির অভিযোগে এনবিআরের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে তাদের কয়েকজন হলেন, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুর রশীদ মিয়া; এনবিআরের সদস্য লুতফুল আজীম; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম; যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান,এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম; ঢাকা কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা; বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর উপ-কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান তারেক রিকাবদার; কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু।