
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। আগের অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রাজস্ব আদায় করেছে সংস্থা দুটি।
রাজস্ব আদায় করতে না পারার অন্যতম কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পাশাপাশি করদাতাদের অনীহাও একটি বড় কারণ। তাদের মতে, রাজস্ব আদায়ের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে পরবর্তী বছরগুলোতেও রাজস্ব আদায় কঠিন হয়ে পড়বে। এতে করপোরেশন দুটি নাগরিকদের সঠিক সেবা দিতে ব্যর্থ হবে।
দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। গত ৩১ মে পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছে ৮০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় করতে পারেনি উত্তর সিটি করপোরেশন।
এদিকে একই সময়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে ৭০৮ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩০ কোটি টাকা।
সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে ‘মে ও জুন’ মাসকে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সময় ধরা হয়। তবে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ মাস মে-তে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কারণ হিসেবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়র পদে বসতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের টানা আন্দোলনের কারণে করপোরেশনের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এতে রাজস্ব বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বড় একটি অংশ আদায় করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্স এবং খাজনা আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে চরম ভাটা পড়ে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে জুলাই ও আগস্ট পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ দুই মাসেরও বেশি সময় আমরা রাজস্ব আদায় করতে পারিনি। এ বছরও মে-জুন মাসে অপ্রত্যাশিত একটি আন্দোলনের (ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি) কারণে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায় করা যায়নি। তাও আমরা চেষ্টা করেছি। হয়তো নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি, তবে রাজস্ব আদায় করা গেছে।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ডিএসসিসির রাজস্ব আদায় কার্যক্রম শতভাগ অনলাইনে করার চেষ্টা চলছে যাতে করে সম্মানিত করদাতারা সহজে সেবা পেতে পারেন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে ৭৯৭ কোটি টাকা। আদায়ের হার ছিল ৫১ শতাংশ। একই সময়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় করেছিল ৮৪০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আদায়ের হার ছিল ৬১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের সময় স্বল্পতা এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারিনি। এ কারণেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি।’
উত্তর সিটি করপোরেশন
সিটি করপোরেশেনের রাজস্বের বড় অংশ আসে কর (হোল্ডিং, পরিচ্ছন্নতা, লাইটিং, স্বাস্থ্য) খাত থেকে। আলোচ্য সময়ে এই খাতে উত্তর সিটির রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। সংস্থাটি আদায় করতে পেরেছে ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। পাঁচটি খাতে সংস্থাটির রাজস্ব আদায় হয়নি। খাতগুলো হচ্ছে বাজার সালামি, রিকশার লাইসেন্স ফি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/ট্রেনিং সেন্টার ফি, মেলা এবং বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর ওপর ফি ও টিউটোরিয়াল স্কুল/কোচিং সেন্টার ফি। বাকিগুলোতেও লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে বাজার ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি, আদায় করতে পেরেছে ৩ কোটি টাকা। ট্রেড লাইসেন্স ১৩০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। প্রমোদ কর ১ কোটি ৫০ লাখের মধ্যে আদায় করতে পেরেছে সাড়ে ৬৭ লাখ। সম্পত্তি হস্তান্তর করের ৪৬০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করা গেছে ১৯০ কোটি ৫০ লাখের কিছু বেশি। করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত তারকাখচিত হোটেল এবং সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থানকারীর ওপর নগর কর ৩০ কোটির মধ্যে আদায় করেছে প্রায় ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপনে ৭ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি টাকা।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫২টি খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। বিদায়ী অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের টার্গেট ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। কিন্তু গত মে মাস পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি ৩০৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে। এই খাতে সংস্থাটির ঘাটতি ২৫২ কোটি টাকা। বাজার সালামি আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১০০ কোটি, আদায় হয়েছে সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা। বাজার ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ খাত ট্রেড লাইসেন্স ফি ১৫০ কোটির মধ্যে আদায় হয়েছে ৯৩ কোটি ৮৩ লাখ। বিজ্ঞাপন খাতে ১২ কোটি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের ১৫০ কোটি টাকা টার্গেট থাকলেও আদায় করা হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। বাস/ট্রাক টার্মিনাল ফি ২০ কোটির মধ্যে আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ। বাকি খাতগুলোতেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি।