
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই (বুধবার)। এই ইস্যুতে বাংলাদেশ কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের আগেই তা জানাতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। এই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখতে পারবে কি না। এ নিয়ে দেশের রপ্তানিকারকরা উদ্বেগে আছেন। তারা বলেছেন, গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে দেশের রপ্তানি খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন গত বুধবার ওয়াশিংটনে গেছেন। এর আগে ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মো. খলিলুর রহমান। তিনি ইউএসটিআরের সঙ্গে দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ইউএসটিআর প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছেন। আলোচনায় অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে আজ যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হচ্ছেন বাণিজ্যসচিব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক চুক্তি করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই চুক্তির অগ্রগতি কত দূর, শেষ পযন্ত চুক্তি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, সরকার চেষ্টা করছে একটা ভালো চুক্তি করার যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও লাভবান হয়। তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে কিছু শর্ত থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তগুলো যদি মানা সম্ভব হয়, তাহলেই চুক্তি হবে। আলোচনা চলছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
সূত্র জানায়, উভয় পক্ষের মধ্যে বেশকিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চু্ক্তির প্রস্তাবিত খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আরও দর-কষাকষি চলবে। ৮ এবং ৯ জুলাই ইউএসটিআরের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা এই ইস্যুতে আরও একটি বৈঠক করবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এতে এমন কিছু শর্ত দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচর্চা এবং দ্বিপক্ষীয় সুবিধার মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে দুই পক্ষের মধ্যে দর-কষাকষির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে। গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন শুল্কহার আরোপ করে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অন্য ৬০টি দেশের ক্ষেত্রে।
বাড়তি শুল্ক আরোপ কার্যকরের কথা ছিল ৯ এপ্রিল। তবে ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্কহার কার্যকরের ঘোষণা তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে। স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। তার আগেই বাংলাদেশকে তার অবস্থান জানাতে হবে টাম্প প্রশাসনকে। যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক না কমায় তাহলে বর্তমানের চেয়ে বেশি হারে (৫২-৫৩ শতাংশ) শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য সে দেশের বাজারে প্রবেশ করাতে হবে। তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বাংলাদেশের জন্য।
সরকারি নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাড়তি শুল্কহার কার্যকরের স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরও পিছিয়ে দিতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। এটি ৬ মাস কিংবা এক বছর পর্যন্ত হতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, একমাত্র যুক্তরাজ্য ছাড়া বাকি কোনো দেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি করতে পারেনি। এ কারণে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি কার্যকর স্থগিতের মেয়াদ আরও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এখন বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি করে। বিপরীতে আমদানি করে কম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ৬ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী দেশটি।
তৈরি পোশাক ও রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু খবরের কাগজকে বলেন, ‘চুক্তি করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তার শর্ত দিয়েছে। শর্তানুযায়ী চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এই শর্তের কারণে আমরা অন্ধকারে আছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি একটা ভালো চুক্তি হবে। যদি সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত- বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প- বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কারণ, ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা কার্যকর হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না বাংলাদেশ।’
উল্লেখ্য, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশ দেশটি থেকে আসে। রপ্তানির ৯৫ শতাংশই তৈরি পোশাক পণ্য।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে ঘাটতি কমাতে হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানি আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমদানি বাড়ানোর সুযোগ তেমন নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সীমিতসংখ্যক পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে, বেসরকারি খাতে আমদানি কম হয়। তবে সরকার যদি আমদানি বাড়ায়, তাহলে বাণিজ্য বাড়বে। কিন্তু এখানে কিছুটা জটিলতা আছে। কারণ সরকার যখন কোনো পণ্য কিনবে তখন ক্রয় নীতিমালা মেনে চলতে হয়। ফলে, সরকার চাইলেই হুট করে আমদানি বাড়াতে পারবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান খবরের কাগজকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সব সময় একরোখা আচরণ করে। ‘আমি যাই বলব, তাই করতে হবে’- এমন চাপিয়ে দেওয়া নীতি ঠিক নয়।” তিনি বলেন, ‘চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দেশের দর-কষাকষি চলছে। বাংলাদেশও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গোপনীয়তার কারণে কী হচ্ছে তা আমরা জানি না। আশা করছি ভালো চুক্তি হবে। তা না হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০০ ধরনের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এদের অর্ধেকই শূন্য শুল্কে আমদানি করা হয়। বাকি যেসব পণ্য আমদানি হয়, তাদের গড় শুল্কহার মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। মোস্তফা আবিদ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে এমনিতেই বাংলাদেশ কম শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। শুল্ক আরও কমালে তেমন লাভ হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল তার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি তিন লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি টনে ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার বেশি লাগলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এ গম আমদানি করা হবে। বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোয়িং উড়োজাহাজ আমদানির। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির পরিমাণ বাড়াতে কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে মোস্তফা আবিদ বলেন, একমাত্র তুলা আমদানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এ জন্য দেশের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে বন্ডেড ওয়্যার হাউস গড়ে তুলতে হবে। আরেকটি পথ খোলা আছে, সরকারিভাবে ক্রয় বাড়ানো। কিন্তু তাতেও জটিলতা রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ চাইলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম, জাপান ইত্যাদি দেশ পাল্টা শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে এ বিষয়ে তারা কোনো ধরনের আলোচনায় আর বসবে না। মোস্তফা আবিদ মনে করেন, উল্লিখিত দেশগুলো কী করছে তা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে। সেটা হলে দর-কষাকষি করতে সুবিধা হবে।