খেলোয়াড় গড়ার কারখানা বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। সেই প্রতিষ্ঠানটিকেই ফুটবলের সব কার্যক্রম থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলোয়াড় নিবন্ধনে জালিয়াতির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ডিসিপ্লিনারি কমিটি। গত রবিবার তাই বিকেএসপিকে নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানা করে সংস্থাটি। সঙ্গে জালিয়াতিকাণ্ডে জড়িত দুজন কোচ ও সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে বাফুফে। কোচদের এক বছরের জন্য ও সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের ৬ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠানকে এই শাস্তি দেওয়া বা প্রতিষ্ঠানটির এই শাস্তি পাওয়া- দুটিই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তোলপাড় ফেলার মতো খবর। হয়েছেও তাই। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে অনেকের মনে।
বাংলাদেশের নিচের সারির লিগগুলো নিয়ে অভিযোগের আসলে অন্ত নেই। যে কাণ্ডে বিকেএসপি নিষিদ্ধ হলো, সেই ঘটনাও আসলে নতুন কিছু নয়। তবে বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠান যখন এমন ঘটনায় জড়িয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তো আঙুল উঠবেই। ডিসিপ্লিনে যাদেরকে আদর্শ মানে সবাই, সেই তারাই এমন ঘটনায় জড়ালে সেটা শুধু হতাশাজনকই নয়, পুরো ক্রীড়াঙ্গনের জন্যই বড় বিপর্যয়।
বাফুফে বিকেএসপির বিরুদ্ধে যে প্রমাণ পেয়েছে, তাতে বলা হয়েছে তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে প্রতিষ্ঠানটির নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের চকবাজারের হয়ে খেলার বিষয়ে দুই পক্ষের চুক্তি হয়। কিন্তু তিনজন খেলোয়াড়ের জায়গায় নাম পরিচয় বদলে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য খেলোয়াড়রা খেলেছেন। এই খেলোয়াড়রা পরে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে বিকেএসপির হয়ে নিজেদের প্রকৃত নাম-পরিচয় ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে গেলে বিষয়টি বাফুফের নজরে আসে। পরে এই খেলোয়াড়দের দ্বিতীয় ফুটবলে খেলতে দেওয়া হয়নি। এই সব খেলোয়াড় বিষয়টি বাফুফের কাছে স্বীকার করে নেয়। তারা এও স্বীকার করে যে, পুরো বিষয়টি অবগত ছিলেন বিকেএসপির কোচ রবিউল ইসলাম। যিনি চকবাজার কিংসের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া দলটির প্রধান কোচ ও ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন বিকেএসপির সিনিয়র প্রশিক্ষক শাহীনুল হক। বাফুফে এই দুজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে। ফুটবল কার্যক্রম থেকে তাদের এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সঙ্গে আর্থিক জরিমানাও করেছে।
বাফুফে বলছে, তিন খেলোয়াড়ের ঘটনায় বিকেএসপিকে সতর্ক করার পরও নাম-পরিচয় বদলে তৃতীয় বিভাগে খেলা আরও একজন খেলোয়াড়কে দ্বিতীয় বিভাগে খেলিয়েছে তারা। এ নিয়ে আরামবাগ ফুটবল একাডেমি গত ২৪ নভেম্বর বাফুফের কাছে প্রতিবাদ দাখিল করে। আর এরপরই বাফুফে নিয়েছে কঠোর সিদ্ধান্ত।
বিকেএসপি অবশ্য বাফুফের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আপিল করেছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ট্রেনিং) কর্নেল মো. মিজানুর রহমান গত সোমবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেখুন কোনো ব্যক্তির দোষ তো আর প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না। আমরা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপলি করেছি।’ ঘটনার সংশ্লিষ্টতায় প্রতিষ্ঠানটির দুই কোচের নাম এসেছে। তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিষয়টি তদন্ত করব। যদি তারা দোষী প্রমাণিত হন, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
পুরো ঘটনা নিয়ে দেশের একজন শীর্ষ কোচ নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাফুফে বিষয়টি অন্য ভাবে দেখতে পারত। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি বিকেএসপি। দেশের খেলাধুলায় তাদের অবদান অনেক। শুধু ফুটবল নয়, অন্য অনেক খেলায় তারা খেলোয়াড় সাপলাই দিচ্ছে বছরের পর বছর। বাফুফে হয়তো এই সিদ্ধান্তের জন্য এখন বাহবা পাবে। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বড় ঘটনাও তো তারা দেখছে না।’ তিনি প্রশ্ন তুলেন, ‘চকবাজার এখানে ছাড় পেল কীভাবে? দলটির কোচদের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু কোচরা তো আর কর্মকর্তা নন। দলটির বা দলটির কোনো কর্মকর্তার এখানে শাস্তি হলো না কেন?’
বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলামও একই প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমরা যারা বিকেএসপির শিক্ষার্থী, বিকেএসপিতে বড় হয়েছি, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রতিষ্ঠানদের প্রতি আলাদা আবেগ বা ভালোবাসা তো কাজ করেই। গণমাধ্যমে যে বিষয়গুলো দেখলাম, যে খেলোয়াড়রা অন্যায় করেছে, তারা শাস্তি পেয়েছে। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা কোচিং ম্যানেজমেন্টে ছিল তাদেরও শাস্তি হয়েছে। তৃতীয় বিভাগের একটি ক্লাবের হয়ে তারা জালিয়াতি করেছে। কিন্তু এখানে বিকেএসপির শাস্তির বিষয়টি ক্লিয়ার না। যারা বিচারক তারা নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে শাস্তিটা দিয়েছেন। কিন্তু বিকেএসপি এক বছর নিষিদ্ধ হওয়ার মতো অপরাধ করেছে কি না, সে বিষয়টি মনে হয় আরেকটু ভাবা উচিত। কারণ তৃতীয় বিভাগে তো বিকেএসপি খেলেনি। আর দ্বিতীয় বিভাগে যে খেলোয়াড় নিয়ে অভিযোগ, সে তো প্রকৃত নামেই খেলেছে। তাহলে কেন একটা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়া হয়। বিকেএসপিতে অনেক খেলোয়াড় খেলছে। তারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসে। এখন যদি এক বছর খেলা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
তবে ভিন্ন মতামতও রয়েছে। বিকেএসপির সাবেক প্রধান হকি কোচ কাওসার আলী যেমন বললেন, যে ফেডারেশন এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিশ্চয়ই তারা আবেগবশত এটা দেয়নি। নিশ্চয়ই এখানে বিকেএসপির দোষ রয়েছে। আমি ৩২-৩৩ বছর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ছিলাম। আমার অনেক খেলোয়াড় জাতীয় দলে খেলেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, এখানে বিকেএসপির অবশ্যই মিসটেক আছে। সেটা ব্যক্তিগতভাবে আছে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আছে।’
বিকেএসপির এই নিষেধাজ্ঞার খবরে এই কোচ খুবই ব্যথিত, ‘বিকেএসপির একটা অন্ধকার দিক প্রকাশ হয়ে গেল। আমি অত্যন্ত লজ্জিত। আমাদের জন্য এটা বড় ক্ষত। কোনো ফেডারেশন আমাদের কখনো ব্লেম করতে পারেনি। সেখানে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। বিকেএসপির এখানে যে মিসটেকগুলো আছে, সেগুলোর যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে সেটা বিকেএসপিরই বদনাম হবে।’