সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের বিপক্ষে কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলেও শেষ মুহূর্তে গোল করেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। তাতে ড্র হয় ম্যাচ। তার ওই মহামূল্যবান গোলটির পর টুর্নামেন্টে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেই নেপাল থেকে ফিরেছে মেয়েরা। তবে শামসুন্নাহারকে পুরো আসরে চোটের সঙ্গে লড়াই করে খেলতে হয়েছে। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে কঠিন এই পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প শুনিয়েছেন কলসিন্দুরের কৃতী এই কন্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: এবারের সাফে মাত্র একটি গোল আপনার। তবে সেই গোলটার মূল্য অনেক। আপনার ওই গোলেই প্রতিযোগিতায় টিকে ছিল বাংলাদেশ…
শামসুন্নাহার জুনিয়র: আপনারা তো ছিলেন সেখানে, খেলা দেখেছেন। আমাদের প্রথম ম্যাচটা আসলে খারাপ গেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে এমন কিছু হবে এটা আমরা ভাবিনি। কিন্তু প্রথমে গোল হজম করে বসি আমরা। ধরতে গেলে ম্যাচটা ১-০ গোলে হেরেই যাচ্ছিলাম। ৬ মিনিটের যোগ করা সময়ে প্রথম মিনিটেই গোলটা হয়েছে। আমাদের চেষ্টা ছিল যে আমরা অন্তত ড্রটা যেন করতে পারি। তাহলে ভারতের সঙ্গে ভালো কিছু করলে আমরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারব বা সেমিফাইনাল খেলতে পারব। এমন একটা আশা আমাদের সবার মধ্যে ছিল।
খবরের কাগজ: কিন্তু নির্ধারিত সময়েও তো গোল পেলেন না। ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গেল…। ভয় কাজ করেনি?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: ওই সময়টায় ডিফেন্স লাইন থেকে আমাদের অনেক সাপোর্ট করেছে এবং অনেক প্রেসার দিয়েছে। ডিফেন্স থেকে শুধু বলছিল, গোল করো, গোল করো। সত্যি বলতে খুব চাপ ছিল তখন।
খবরের কাগজ: পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের শুরুর দিকেই চোখের ওপর আঘাত পান। এর পরও ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলে গেছেন এবং গোলও করেছেন। অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। কীভাবে পারলেন এটা?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: খেলার শুরুতেই ব্যথাটা পেয়েছি। আমার মনোবল ছিল, পারব। ফিজিও লাইজু আপু (লাইজু ইয়াসমীন) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি পারবে?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, আমি খেলব।’ আর টিমের সবাই আমাকে খুব সাপোর্ট করছিল। বলছিল, তুমি পারবে। আমি তো কিছুক্ষণ বাইরে ছিলাম, খেলা চলছিল। ফিজিও আপু ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর আমি ওভাবেই মাঠে নেমেছি। পরে কিন্তু আমি হেডেই গোল করেছি।
খবরের কাগজ: দুই বছর আগের আসরে আপনি ফাইনালেও গোল করেছিলেন। এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই গোল পেয়েছেন। কিন্তু পরে চোট আপনার পিছু ছাড়েনি…
শামসুন্নাহার জুনিয়র: পাকিস্তান ম্যাচের শেষ দিকে আমি পায়েও অনেক ব্যথা পাই। অনেক বেশি আঘাত ছিল ওটা। যে কারণে আমি পরের দুই দিন অনুশীলন করিনি। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে ব্যান্ডেজ করে খেলতে নেমেছিলাম। কিন্তু কয়েক মিনিট খেলার পর থেকেই ব্যথা লাগছিল। মাঠেই আমি কান্না করে দিই। আসলে আমি আর পারতেছিলাম না। বলেছিলাম, আমাকে চেঞ্জ করে অন্য কাউকে নামাতে। কারণ শতভাগ দিতে পারছি না। দলের জন্য কিছু করতে পারছি না। খারাপ লাগছিল। মাঠের ভেতর ভেঙে পড়ি আমি। তবে মারিয়া আপু, সাবিনা আপু, শিউলী আপু ওনারা অনেক হেল্প করেছেন। বলেছেন, তুমি পারবে। প্রথমার্ধের আগে চেঞ্জ হলে তো বদলি নামানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তাই আমাকে সবাই বলছিল প্রথমার্ধটা অন্তত খেলো। পরে পায়ে ব্যথা নিয়ে প্রথমার্ধ পর্যন্ত খেলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে ওই ম্যাচের পর আমার ব্যথা আরও বেড়ে যায়। যে কারণে সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে আমাকে অফ করা হয়, যেন ফাইনালে আমি খেলতে পারি।
খবরের কাগজ: ফাইনালে শেষ পর্যন্ত খেলেছেন। গোল না পেলেও আপনার পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো…
শামসুন্নাহার জুনিয়র: ফাইনালেও কিন্তু আমার পায়ে অনেক ব্যথা ছিল। ফিজিও আপু আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। ওনার ভরসায় আমি নেমেছিলাম মাঠে। এর পরও আমার মনে হয়েছে আমি হয়তো পুরোপুরি দিতে পারিনি। তবে সবাই বলেছে, তুই ভালো খেলেছিস। তুই তোর সর্বোচ্চটা দিয়েছিস। তবে সবাই খুশি থাকলেও আমি নিজে খুশি না। ব্যথাটা না থাকলে হয়তো আমি আরও ভালো করতে পারতাম।
খবরের কাগজ: তার মানে এবারের আসরে অভারঅল নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে খারাপ লাগা আছে আপনার?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: হ্যাঁ, কিছুটা খারাপ লাগা আছে। আসলে শুরুর ম্যাচেই ব্যথা পেয়েছিলাম। তাই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারিনি। দেশে এসে এক্স-রে করেছি। ফ্র্যাকচার হয়েছে। আমি আগেও এ রকম ব্যথা নিয়ে খেলেছি। আর খারাপ লাগার কথা যেটা বললেন, এটা তো আমার নিজের ব্যক্তিগত বিষয় বললাম। কিন্তু আমার দলীয় সাফল্যের কথা যদি বলি, আমার কোনো অতৃপ্তি নেই।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশ দুবার সাফে চ্যাম্পিয়ন হলো। আপনি দুটি চ্যাম্পিয়ন দলেরই অংশ। দুটির মধ্যে আপনি কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: প্রথমবার যখন চ্যাম্পিয়ন হই সেটা ছিল আলাদা ভালো লাগার। আমি সেবার প্রথমবার সিনিয়র সাফ খেলতে যাই। প্রথমবারই চ্যাম্পিয়ন হই। তাই সেটার আনন্দটা অন্য রকম ছিল। এবার আবার অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। চ্যালেঞ্জ এ জন্য যে একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এবার যদি না হতে পারি, তাহলে সবাই ভাববে আমরা হয়তো হঠাৎ করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিলাম। এই দিক থেকে এবার অনেক চাপ ছিল। এর মধ্যে আবার প্রথম ম্যাচটা আমরা খারাপ করে ফেলি। সব মিলিয়ে দুটির অনুভূতি দুই ধরনের। একটির সঙ্গে আরেকটি মেলাব না।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছেন। এখন তো চারদিকে মাতামাতি। কিন্তু যেটা হয়, কিছুদিন পরেই আর কেউ খোঁজ রাখে না বা মনে রাখে না। কী বলবেন এ নিয়ে?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: ভুলে যাবে তো, এটাই স্বাভাবিকই। আবার একবারে যে ভুলে যাবে, এমন তো না। অবশ্যই মনে রাখবে। যদি একেবারেই ভুলে যেত তাহলে তো আর এবার বলত না তোমরা দুবারের চ্যাম্পিয়ন। এখন যারা ভুলে যাওয়ার তারা ভুলে যাবে। আর আমরা পরের বারের জন্য প্রস্তুতি নেব। যদি লম্বা সময় আমাদের ক্যাম্পটা চলমান থাকে, তাহলে আশা করি আমরা দেশকে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশিপ দিতে পারব।
খবরের কাগজ: ২০২২ সালে আপনারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পর দেখা গেছে ৯ মাস আপনাদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল না। এবার নিশ্চয়ই এমন কিছু চাইবেন না?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: আমরা তো সবাই টানা ক্যাম্পের মধ্যে থাকি। নিজেরা নিজেরা প্র্যাকটিস করি। যদি আমাদের ফ্রেন্ডলি ম্যাচগুলো বেশি বেশি হয়, আমাদের থেকে শক্তিশালী দলের সঙ্গে যদি আমরা খেলতে পারি, তাহলে আমাদের উন্নতি করার সুযোগ আরও বাড়বে। বড় দলের সঙ্গে হারি বা জিতি, এটা বিষয় নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা তো হবে। সেই সঙ্গে উন্নতিও হবে। নিজেদের ভুলগুলো আমরা বুঝতে পারব। তাই চাইব, এখন থেকে যেন ভালো ভালো দলের সঙ্গে খেলতে পারি আমরা। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দলগুলোর সঙ্গে তো খেলিই। সামনে যেন এশিয়া বা এশিয়ার বাইরের বড় বড় দলের সঙ্গেও খেলতে পারি।
খবরের কাগজ: মাত্র ২০ বছর বয়স আপনার। এরই মধ্যে দু-দুটি সিনিয়র সাফজয়ী দলের অংশ আপনি। জুনিয়র পর্যায়েও অনেক ট্রফি জিতেছেন। নিজেকে নিয়ে আপনি কতটা খুশি?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: ২০১৭ সালে আমি বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে ঢুকি। আমি যতটুকু করতে পেরেছি, তাতে শুকরিয়া আল্লাহর কাছে। আমি নিজে অনেক সন্তুষ্ট। সামনে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা থাকবে।
খবরের কাগজ: কোথায় দেখতে চান নিজেকে?
শামসুন্নাহার জুনিয়র: আমার ইচ্ছা বিদেশের লিগে লেখার। আগে তো আমাদের দেশ থেকে একজন-দুজন করে বাইরের দেশে গিয়ে লিগ খেলত। আমারও ইচ্ছা, ওদের মতো খেলার। আমাদের এখানকার সব খেলোয়াড় যেন এ রকম সুযোগগুলো পায়, এটা চাই। এখন যে পরিমাণ খেলোয়াড় যাচ্ছে, এটা সামনে নিশ্চয়ই আরও বাড়বে।