খেলার সঙ্গে খেলোয়াড়দের ইনজুরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খেলা কিংবা অনুশীলন- যেকোনো মুহূর্তে খেলোয়াড়দের সঙ্গী হতে পারে চোট। ক্রিকেট মাঠও এর ব্যতিক্রম নয়। ক্রিকেটে ব্যাটারদের চেয়ে বোলারদের সখ্য ইনজুরির সঙ্গে বেশি। আবার বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইনজুরিপ্রবণ পেসাররা। যার প্রমাণ পাকিস্তানি গতি তারকা শোয়েব আখতার ও বাংলাদেশি পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্যারিয়ারে সাতবার শল্যবিদের ছুরির নিচে যেতে হয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করতে পারেননি বলে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় বলেন পাকিস্তানি পেসার শোয়েব আখতার। ইনজুরির সঙ্গে লড়তে পারেননি বলে অস্ট্রেলিয়ান পেসার শন টেইট ক্রিকেটকে বিদায় জানান ৩৩ বছর বয়সে।
বিশ্বজুড়ে পেসারদের এমন ইনজুরি প্রবণতা ছুঁয়েছে বর্তমান বাংলাদেশকেও। জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করে খেলে যাচ্ছেন। এ ছাড়া জাতীয় দলের পাইপলাইনে থাকা অন্তত ৪ পেসার রহনতদৌল্লা বর্ষণ, মুশফিক হাসান ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, অভিষেক দাসের পাশাপাশি ইবাদত হোসেন আছেন ইনজুরিতে। বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীর মতে, ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট, ক্রিকেট ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সঠিক শিক্ষার অভাব বাংলাদেশের পেসারদের অনেক বেশি ইনজুরিপ্রবণ করে তুলেছে।
২০১১ সালে মাত্র ১৮ বছরে অভিষেক হয় অস্ট্রেলিয়ান পেসার প্যাট কামিন্সের। ইনজুরিপ্রবণ হওয়ায় অভিষেক ম্যাচের পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই পেসারকে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলায়নি অস্ট্রেলিয়া। তার মতো ইনজুরিপ্রবণ হওয়ায় মাঝেমধ্যেই ম্যাচ মিস করেন আরেক অজি পেসার মিচেল স্টার্ক। বিশ্বজুড়ে পেসারদের এই ইনজুরিপ্রবণতা বাংলাদেশকেও স্পর্শ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে মানসম্পন্ন পেসার বাড়ায় তাদের ইনজুরির ব্যাপারটি চোখে লাগছে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। কেন বাংলাদেশি পেসাররা এমন ইনজুরিপ্রবণ হচ্ছেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট ও ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকা অপুষ্টি বেশি ভোগাচ্ছে বাংলাদেশি পেসারদের। গ্রামাঞ্চল ও দেশের দরিদ্রতম পরিবার থেকে উঠে এসেছেন বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটার। ফলে শৈশব থেকে ক্রিকেটারদের সঙ্গী অপুষ্টি সমস্যা।
দেশের পেসারদের ইনজুরির অন্যতম কারণ এই অপুষ্টি। এমনটা জানিয়ে বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বড় ব্যাপার হলো অপুষ্টি। একটা ছেলে যখন আসে তখন সে ছোটবেলায় কেমন পুষ্টিসম্মত খাবার পেত বা গর্ভে থাকাকালীন সময়ে তার মা কি রকম পুষ্টিসম্মত খাবার খেত, যা দরুণ তারা এখন ইনজুরিতে ভুগছে। এগুলো আসলে অপুষ্টির কারণ। খেলার জন্য তো শরীর গঠন করতে হবে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের শারীরিক গঠন ওই রকম না। আমরা ১৫-১৬ বছর বয়সে যখন ওদেরকে পাচ্ছি তখন কিছুটা সমর্থন বা সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু যখন তাদের বয়স ৪-৫ বছর তখন তো সেটা পায়নি। গর্ভাবস্থায় থাকার সময় থেকে হিসাব করলে বোঝা যায় পুষ্টির ব্যাপার অনেক বড় বিষয়।’
পেসারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কে কত জোরে বল করতে পারে। এই প্রবণতা ক্রিকেটারদের অনেক বেশি ইনজুরিপ্রবণ করে তোলে। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে জোরে বল করার প্রবণতা দেখা যায় পেসারদের মধ্যে। ওই বয়স থেকেই ইনজুরি বাসা বাঁধে পেসারদের শরীরে। মাংসপেশি গঠনের বয়সে পেসাররা ইনজুরিতে পড়াও সমস্যা বলে মনে করেন দেবাশীষ। তার কথায়, ‘আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সমস্যাগুলো (ইনজুরি) তৈরি হয় বয়সভিত্তিক দল থেকে। মূলত পেসাররা পিঠের ইনজুরিতে ভোগে। ১২-১৩-১৫ বছর বয়স থেকে ইনজুরি সমস্যা শুরু হয়। ওই বয়সে একটা ছেলেকে নির্বাচন করা হয় কত জোরে বল করতে পারে সেটা দেখে। ১৩-১৪ বছর বয়সে জোরে বল করে। এটা তো জোরে বল করার বয়স না। ওই সময় মাংসপেশির গঠন করার বয়স। তবুও তারা জোরে বল করছে। সমস্যাটা তখনই শুরু হয়। আর তখন ওদের সমস্যাগুলো দ্রুত ধরা সম্ভব হয়।’
কেন শৈশবে ইনজুরিতে পড়া ক্রিকেটারদের সমস্যা ধরা পড়ে না, সেটাও ব্যাখ্যা করেন দেবাশিস। তার মতে, দেশে প্রচুর তরুণের মধ্যে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন লুক্কায়িত থাকে। ওই বয়সে ক্রিকেটাররা জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ে খেলে বলে সেটা সামনে আসে না। বিসিবির অধীনে আসার আগে পর্যন্ত অনেক তরুণ পেসারের মধ্যে থাকে ইনজুরি সমস্যা। তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকা এই পুরোনো ইনজুরিগুলো দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা তৈরি করে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ পেসাররাও হয়ে পড়ে ইনজুরিপ্রবণ। পাশাপাশি তরুণ পেসাররা শুরুতে ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট শব্দের সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করে বলে জানান। তার কথায়, ‘পেস বিভাগটাই ইনজুরিপ্রবণ। গত ৫-৭ বছর ধরে সারা বিশ্বের এগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। গবেষকরা বের করেছেন বোলিং ওয়ার্কলোড একটা বড় ব্যাপার। বোলিং ওয়ার্কলোড যদি বেশি হয়ে যায়- সেটা একটা কারণ হতে পারে ইনজুরির জন্য। এটা আগে আমরা জানতাম না। আমরা এটা নতুন করে শিখেছি। আমরাও এখন বোলিং ওয়ার্কলোড ম্যানেজ করার চেষ্টা করি।’
পেসারদের ওয়ার্কলোড নিয়ে আরও বলেন, ‘আমার শরীরটা আমি বুঝতেছি কি না, বোলিংয়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কি না, এই দুই বিষয় যত ভালোভাবে বোঝা সম্ভব হবে, তত নিজের সম্পর্কে জানতে পারবে ক্রিকেটাররা। তারা জোরে বল করতে চায়। জোরে বল করতে হলে শরীরের ভেতর থেকে শক্তি দরকার, বায়ো মেকানিক্স ঠিক হতে হবে। এটা নিয়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে ঘাটতি রয়ে গেছে।’
এ ছাড়া তৃণমূলে কাজ করা কোচদের মধ্যে ওয়ার্কলোড ও ইনজুরি সম্পর্কে জ্ঞানের ঘাটতি থাকাও তরুণ পেসারদের ইনজুরির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘গ্রুমিং করা, ক্রীড়াবিজ্ঞান আমাদের তৃণমূলে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।’ তৃণমূলে খেলা ক্রিকেটারদের পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না বলে জানান তিনি। তার কথায়, ‘উন্নত দেশগুলোতে হয়তো এই রকম ব্যাপার একটু কম হয়। আমাদের এখানে যখন খেলোয়াড় খুঁজতে যায় তখন অনেক পাওয়া যায়। যারা সবাই ক্রিকেট খেলতে চায়। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে ১০০ জন পাওয়াও কঠিন। যেহেতু ওরা কম খেলোয়াড় পায় তাই ওরা সবাইকে নজরদারি করতে পারে। আমাদের এখানে একদম তৃণমূল পর্যায়ে সবাইকে নজরদারি করা অনেক কঠিন কাজ।’