বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে যখন সোচ্চার একদল ফুটবল সমর্থক, ঠিক সেই সময়ই নীরবতা ভেঙেছেন কিংবদন্তি এই ফুটবলার। ২০০৮ সাল থেকে বাফুফে সভাপতির পদে থাকা সালাউদ্দিন পদত্যাগের দাবি রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং দুই মাস পর হতে যাওয়া বাফুফে নির্বাচনে টানা পঞ্চমবারের মতো প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। গতকাল সন্ধ্যায় খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি আন্দোলনকারী ও তাদের দাবি, উভয় বিষয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সঙ্গে খেলোয়াড় হিসেবে দেশের ফুটবলে তার অবদানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসিনি।’
কাজী সালাউদ্দিনের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হতে আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। আগামী ৩ অক্টোবরই শেষ হবে তার বর্তমান কমিটির মেয়াদ। এরই মধ্যে নির্বাচনের প্রাথমিক দিনক্ষণও ঘোষণা করেছে বাফুফে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে বাফুফের নির্বাচন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সংস্থায় শীর্ষ পদে হচ্ছে রদবদল। অনেক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব বদলের জন্য চলছে আন্দোলন। সরকার পতনের পর থেকেই ‘বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাস’ ব্যানারে বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে একদল সমর্থক। বাফুফে ভবনের সামনে বিক্ষোভ থেকে শুরু করে ‘মার্চ টু বাফুফে’র মতো কর্মসূচিও তারা করেছে। তাদের দাবি, ফিফার আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে যদি পদত্যাগ করতে না পারেন, তাহলে অন্তত আগামী নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা যাতে দেন কাজী সালাউদ্দিন। এমন প্রেক্ষাপটে রক্ষণাত্মক নয়, আক্রমণাত্মক কৌশলই অবলম্বন করছেন সালাউদ্দিন। সরাসরি বলেছেন, ‘এরা (আন্দোলনকারী) ফুটবলের কেউ না। এরা সাইফ পাওয়ার টেকের লোক। ফুটবল খেলতে এসে যারা চলে গেছে (২০২২ সালে বিলুপ্ত হয় প্রতিষ্ঠানটির ক্লাব সাইফ স্পোর্টিং)। সে (ক্লাবের কর্ণধার তরফদার রুহুল আমিন) এসেছিল ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার জন্য। এরা (আন্দোলনকারী) তো তাদের সাপোর্টার। তাদের লোকজন এরা। ফুটবলের কেউ না।’
আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘তাদের দাবিটা কি দেখুন? আমি যেন পদত্যাগ করি এবং আমি যেন নির্বাচন না করি। আমি পদত্যাগ না করলে আমাকে রাস্তাঘাটে মারবে। আমি নির্বাচন করব কী করব না, এ নিয়ে কি আমাকে কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?’ সালাউদ্দিন বলে যান, ‘আপনি কিন্তু একটা জিনিস ভুলে গেছেন, আমি কিন্তু একাত্তরে স্বাধীন বাংলা ফুটবলের খেলোয়াড় এবং আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমি ১৩ বছর জাতীয় দলে খেলেছি। আমি কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসিনি।’
সালাউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমি ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছি আওয়ামী লীগ ট্যাগের প্যানেলের বিপক্ষে। বাদল রায়, হারুনুর রশিদ, সালাম মুর্শেদী, কাজী নাবিলদের বিপক্ষ প্যানেলে আমি লড়েছি। আমি দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনে (সাফ) চারবার নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়েছি। যেখানে ভারত, পাকিস্তানের সবাই আছে। ওখানেও আমি জিতেছি। তার মানে আমার ফুটবলের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তো কারা এরা, যারা আমাকে মারবে, যদি আমি নির্বাচন করি? আমার তো মনে হয় না আমার এটা মানার কোনো কারণ আছে। আমি নির্বাচনে হারতে পারি, সেটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আমাকে মারবে, এটা কোন ধরনের কথা?’
এ ধরনের হুমকির বিষয় চাইলেই ফিফাকে অবহিত করতে পারেন সালাউদ্দিন। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটবেন না বলে জানালেন, ‘আমি তো চেষ্টা করব আমার দেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমি দেশকে সাসপেন্ড করে টিকে থাকতে চাইব না। আমি তো নির্বাচন দিয়েই দিয়েছি। ২৬ অক্টোবর নির্বাচনের তারিখ দিয়েছি। এখন আপনি যদি বদল চান, তাহলে একটাই উপায়, নির্বাচন।’
টানা চার মেয়াদে বাফুফে সভাপতির পদ সামলাচ্ছেন সালাউদ্দিন। অনেকে বলেন, ফুটবলার হিসেবে কিংবদন্তি হলেও বাফুফে সভাপতি হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তার এক সময়ের সতীর্থরাও দীর্ঘদিন ধরে তাকে ব্যর্থ বলে আসছেন। কিন্তু এরপরও সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থার সবচেয়ে শীর্ষ চেয়ারে আছেন বহাল তবিয়তে। এটাও ঠিক যে তিনি বারবারই নির্বাচিত হয়েছেন। যত সমালোচনাই হোক, কাউন্সিলররা নিজেদের ভোটটা ঠিকই তাকে দিয়েছেন।
অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে বাফুফে চেয়ারে থেকে গেছেন সালাউদ্দিন। কিন্তু সালাউদ্দিন এমন ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, ‘জিয়াউর রহমান সাহেবের সরকার কিন্তু আমাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দিয়েছে। এরশাদ সাহেবের সরকার আমাকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। এরপর বিএনপি সরকার আমাকে দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছে। এরপর এল আওয়ামী লীগ সরকার। তারা আমাকে শেখ কামাল আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দিয়েছে। আমি কোনো রাজনীতিও করিনি। কোনো দিন সংসদ সদস্য হওয়ার জন্যও আবেদন করিনি। আমি সাধারণ একজন ফুটবলার।’ এরপর তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘১৩ বছর আমি জাতীয় দলে খেলেছি, জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলাম। এসবের কি কোনো দাম নেই?’ যোগ করেন, ‘আমি একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলেছি, আমি তো অন্যদের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসিনি।’
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে সমালোচনাকারী একটি গোষ্ঠীই আছে বলা চলে। সেই সব মহল থেকে নানাভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণও করা হয় তাকে। কাজী সালাউদ্দিনকে কি এসব কষ্ট দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি না দেয় তাহলে তো আমি মানুষ না।’ আর আসছে নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি নির্বাচন করতেছি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছে নির্বাচন করব।’