দেশের দাবার অন্যতম আলোকিত মুখ ফাহাদ রহমান। ২১ বছরের এই তরুণ একেবারে ছোট্টটি থাকার সময় থেকেই আছেন স্পটলাইটে। ১০ বছর বয়সে ফিদে মাস্টার খেতাব পাওয়ার পর ২০১৯ সালে ১৬ বছর বয়সে হয়েছেন আন্তর্জাতিক মাস্টার। অনেক দিন ধরেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্নপূরণের পথে ছুটছেন তিনি। এ বছর অনেক চেষ্টার পর প্রথমবারের মতো গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মও পেয়েছেন। আর দুটি নর্ম পেলে হবে স্বপ্নপূরণ। কিন্তু এত কিছুর পরও ফাহাদ নিজেকে নিয়ে খুশি নন।
কেন খুশি নন? খুশি নন, কারণ এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা মিলছে না। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে চলমান ৪৫তম ফিদে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছেন ফাহাদ। যাওয়ার আগে খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। একান্ত আলাপে সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়ে বেশ আক্ষেপই ঝরেছে ফাহাদের কণ্ঠে। নিজেকে নিয়ে কতটা খুশি, এমন প্রশ্নের তো ফাহাদ রীতিমতো দ্বিধায় পড়ে যান। কী বলবেন যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। প্রশ্নটা তাই ঘুরিয়ে করা, দাবা খেলে কতটা হ্যাপি?
ছোট্ট জীবনের প্রায় পুরোটাই যিনি দাবার চৌষট্টি খোপে কাটিয়েছেন, তিনি আর কী বলতে পারেন এ প্রশ্নের উত্তরে। বলার কথা, ‘অনেক অনেক খুশি আমি…।’ কিন্তু ফাহাদের মতো একজন কি না বলছেন, ‘হ্যাপি বলতে গেছে এখানে মনে হয় সবারই একটা ডাউট থেকে যায় সবকিছু নিয়ে। হয়তো আরও সুযোগ-সুবিধা পেলে…।’ এতটুকু বলে একটু থামেন ফাহাদ। এরপর ফের বলতে শুরু করেন, ‘আমি এখন বাংলাদেশে রেটিংয়ের দিক থেকে এক নম্বর খেলোয়াড়। এরপরও যতটুকু সাপোর্ট পাওয়ার কথা ততটুকু পাচ্ছি না। সম্প্রতি আমি একটা জিএম নর্ম করেছি, এরপর সাপোর্ট আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু আমি এক ধাপ এগিয়েছি, আর মাত্র দুই ধাপ এগোতে হবে। কিন্তু সেভাবে সাপোর্ট পাচ্ছি না। নিজে থেকেই অনেক খেলা খেলতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি অত খুশি না।’
এবারের দাবা অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়েও যেমন আক্ষেপ ঝরে ফাহাদের কণ্ঠে, ‘প্রস্তুতি তো আমাদের নিজেদেরই নিতে হয়। কারণ আমাদের তো বিদেশি খেলোয়াড়দের মতো কোচ নেই। যতকুটু করা যায়, চেষ্টা করেছি। এখন বাকিটা দেখি কি হয়। ফর্মের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। যেহেতু মেন্টাল খেলা। আশা করি ভালো কিছু হবে।’
অলিম্পিয়াড শেষে বুদাপেস্টে আরও তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেবেন ফাহাদ। সব মিলিয়ে হাঙ্গেরি সফরের চারটি প্রতিযোগিতা থেকে অন্তত একটি নর্ম পেতে চান ফাহাদ, ‘গ্র্যান্ডমাস্টার হতে তিনটা নর্ম লাগে। আমার একটা নর্ম আছে, আর দুটি লাগবে। এবার একটা নর্ম করার চেষ্টা করব। এই ট্যুরে ৪টা টুর্নামেন্ট খেলব। ৪টা থেকে দুটি (নর্ম) যদি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাব। অন্তত একটা নর্ম যেন করতে পারি, সেই লক্ষ্য নিয়ে যাচ্ছি।’
গত মার্চে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পান ফাহাদ। সেটাও আসে অনেক অপেক্ষার পর। কারণ নর্ম পাওয়ার খুব কাছে গিয়েও অনেকবারই হতাশ করেছেন তিনি। এই জায়গাতেও কারণ হিসেবে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার বিষয়টিই উঠে আসবে। ফাহাদের নিজের হতাশাও এখানেই। তার মতে ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সব খেলাই অবহেলিত, ‘আসলে ক্রিকেট ছাড়া আমাদের কোনো স্পোর্টসেই সেভাবে ফোকাস দেওয়া হয় না। যেটা লজ্জাজনক একটা জিনিস আসলে। আমার মতে সব খেলাই সমানভাবে ট্রিট করা উচিত। একটু হলে ঠিক আছে, কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য হওয়া ঠিক না।’
ফাহাদের শেষ কথা ধরে আবারও জিজ্ঞেস করা, আপনি কি মনে করেন ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলায় সুযোগ-সুবিধার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য? ফাহাদের চটপট উত্তর, ‘আমি মনে করি, এটা না। যেটা দেখতেছি আমরা, আমি সেটাই বলছি।’ দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার চাওয়া, ‘আমার আশা থাকবে সংশ্লিষ্টরা যেন সব খেলাকে সমানভাবে ট্রিট করেন। কারণ একটা খেলা নিয়ে কখনো একটা দেশ চলতে পারে না। তাহলে তো আর অলিম্পিক তৈরি হতো না। অলিম্পিক এতগুলো খেলা দিত না। সব খেলাকেই সমানভাবে দেখা উচিত। অবশ্যই আপ-ডাউন একটু থাকবেই। তাই বলে পার্থক্য যেন আকাশ-পাতাল না হয়। এটাই আমার দাবি থাকবে।’