বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার মাছুরা পারভীন। এবারের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন আলোচনায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে একাদশেই জায়গা হয়নি তার। পরে সুযোগ পেয়ে উজাড় করে দেন নিজেকে। দেশকে উপহার দেন শিরোপা। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন নিজের এই লড়াইয়ের আদ্যোপান্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: দেশকে পরপর দুটি সাফ শিরোপা এনে দিলেন। শুরু করি এই সাফল্যের অনুভূতি দিয়েই, কেমন লাগছে?
মাছুরা: ভালো তো লাগছেই। যেহেতু আমরা পরপর দুবার ট্রফি আনতে পেরেছি। এটা তো ভালো লাগারই ব্যাপার। কারণ এটা আমাদের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। খুব ভালো লাগছে।
খবরের কাগজ: দুই বছর আগে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এবার শিরোপা ধরে রাখাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
মাছুরা: পুরোটাই চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ এবার প্রত্যেকটা দল ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে এসেছিল। ভারত, নেপাল প্রচুর প্রীতি ম্যাচ খেলে এসেছিল। এশিয়ার বাইরেও ক্যাম্পিং করেছে কয়েকটি দল। শুধু আমরাই মনে হয় সাফের আগে কোনো প্রীতি ম্যাচ খেলিনি। সাফের তিন মাস আগে ভুটানের বিপক্ষে খেলেছিলাম, কিন্তু ওদের সঙ্গে খেলে আমাদের কোনো উপকারই হয়নি। এসব কারণে অন্যান্য দল থেকে আমরা একটু পিছিয়ে ছিলাম। এর ওপর যেকোনো কারণে হোক, কোচ পিটার বাটলারের সঙ্গেও আমাদের দ্বন্দ্ব ছিল। খেলার মাঠে তো যুদ্ধ হয়েছেই, (দলের) ভেতরেও যুদ্ধ হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের সাফটা আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। এতকিছু যে আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।
খবরের কাগজ: কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা বললেন। সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে ওনার দ্বন্দ্বের বিষয় টুর্নামেন্ট চলাকালেও প্রকাশ্যে এসেছে। এই বিষয়টা তাহলে পুরোপুরি সত্য?
মাছুরা: অবশ্যই সত্য।
খবরের কাগজ: কোচ তো টুর্নামেন্ট শেষে এসব দ্বন্দ্বের বিষয় পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন…
মাছুরা: ওনাকে তাহলে আপনারা কেন এই প্রশ্ন করছেন না, মাছুরাকে আপনি কেন পাকিস্তান ম্যাচে নামাননি? হ্যাঁ, কাকে খেলাবেন আর কাকে খেলাবেন না, একজন কোচ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত তিনি নিতেই পারেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তান ম্যাচের পর সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন? বলেছেন, মাছুরার পারফরম্যান্স নেই, মারিয়ার পারফরম্যান্স নেই। তাই খেলাননি। তাহলে তিন দিনের মাথায় কীভাবে আমার ও মারিয়ার পারফরম্যান্স ভালো হলো এবং আমাদের দুজনকে ভারত, ভুটান ও ফাইনালে নেপালের সঙ্গে খেলালেন। এটা কি প্রশ্ন হতে পারে না? তিনি খেলাননি ঠিক আছে। আমি কিছুই বলতাম না। কিন্তু তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার পারফরম্যান্স নেই। পারফরম্যান্স যেহেতু নেই, তাহলে তিনি কেন আমাকে টিমে রেখেছিলেন? আর আমাকে কেনইবা পরের ম্যাচগুলোতে খেলানো হলো?
খবরের কাগজ: এই বিষয়গুলো আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে?
মাছুরা: কষ্ট দেয়নি? আমার জীবনে এ রকম একটা দিন আসবে, এ রকম কিছু শুনতে হবে, এটা আমি কখনোই ভাবিনি।
খবরের কাগজ: পরে তো এই হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে দারুণ খেললেন। এই যে ফিরে আসা, এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
মাছুরা: সাবিনা আপু ও সিনিয়র খেলোয়াড়রা মিলে বিষয়টা সামাল দিয়েছেন। আপনারা তো দেখেছেন, মনিকা পাকিস্তান ম্যাচের পর কী বলেছিল। বলেছিল, কোচ সিনিয়রদের পছন্দই করে না। নিশ্চিয়ই এর মধ্যে কোনো কিছু আছে। এখন কোচ যতই মিথ্যা কথা বলুক না কেন, এতে কিছু যায়-আসে না। কারণ আমরা জানি, কিছু মানুষ ওখানে ছিল, তারা জানে, আসলে আমাদের সঙ্গে কী হয়েছে। এখন উনি যদি সম্পূর্ণ নির্দোষ হতে চান তাহলে আর কী বলব…। এই যে আমরা সাফ জিতেছি, ভারতের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে একটা মিটিং পর্যন্ত করেননি উনি। সাবিনা আপুরা চেয়েছিলেন, আমাকে ও মারিয়াকে ভারত ম্যাচে খেলাতে। উনি রাগ করে রাতের মিটিং বাতিল করে দেন। এত বড় একটা ম্যাচের একাদশ তিনি ঘোষণা করেছেন মাঠে গিয়ে। আমি খেলব কি খেলব না, এটা আমি জানি না। তাহলে আমি আমার প্রস্তুতিটা কীভাবে নেব? মাইন্ড সেটেরও তো একটা ব্যাপার থাকে। সেটাও আমি নিতে পারিনি। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ওপর এবার প্রচুর চাপ ছিল। তবে আল্লাহপাকের ইচ্ছা এবং আমাদের মনোবল ছিল, বিধায় আমরা এই ট্রফিটা আনতে পেরেছি।
খবরের কাগজ: ওভারঅল এবারের আসরে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনি কতটা খুশি?
মাছুরা: আমার পারফরম্যান্স কেমন, সেটা আমার ছোটন স্যার (নারী দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন) বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমি এতেই খুশি। আমার আর কোনো কোচের ভালো বলার দরকার নেই।
খবরের কাগজ: ছোটন প্রসঙ্গে যেহেতু এলই, একটা প্রশ্ন না করে পারছি না। ভুটান ম্যাচের আগে আপনাদের কোচ বাটলার অভিযোগ করেছিলেন, সাবেক কোচ মেয়েদের প্ররোচিত করছে। নাম না বললেও তার ইঙ্গিত ছিল ছোটনের দিকে। তার এই অভিযোগ নিয়ে কী বলবেন আপনি?
মাছুরা: উনি তো বললেনই। কারণ যেভাবে উনি আমাদের মানসিকভাবে ভেঙে ফেলেছিলেন, সেখান থেকে যে আমরা এত শক্তিশালী হয়ে মাঠে ফিরেছি, এতে তো তার অবাক হওয়ারই কথা। এখন তিনি তো নিজের হারটা মেনে নেবেন না। এটাই স্বাভাবিক না? কোচ আমাদের ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকে আমরা শক্তিশালী কীভাবে হলাম? এ কারণে হয়তোবা তার মধ্যে একটু জেলাসি হয়েছে। আর শুধু আমরা কেন, বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড় কখনো তাদের অতীত ভোলে না। অতীত ভোলা কখনোই উচিত না। আমার ক্যারিয়ারের পেছনে ছোটন স্যারের অনেক অবদান। আমি তো তাকে ভুলতে পারি না। আমার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অবশ্যই আমি তাকে স্মরণ করব, তার সঙ্গে কথা বলব, এটাই তো স্বাভাবিক।
খবরের কাগজ: এখন বাটলারের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?
মাছুরা: সাফ জিতে ফেরার পর এখনো তার সঙ্গে আমাদের সেভাবে কথা হয়নি।
খবরের কাগজ: আপনি তো অনেক দিন ধরেই খেলছেন। ২০১৪ সাল থেকে মোট পাঁচটি সাফ খেললেন। বাংলাদেশের নারী ফুটবল নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই…
মাছুরা: আমাদের দলটাকে যদি সেভাবে গোছানো হয়, তাহলে আমি মনে করি এই সাফের ট্রফি আমরা পরের বারও রেখে দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। ভারত যেমন টানা পাঁচবার শিরোপা জিতেছিল। আমাদেরও এ রকম লক্ষ্য হতে পারে। এই দলটাকে নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে বেশি বেশি প্রীতি ম্যাচের কথা বলব। আপনি যত বেশি প্রীতি ম্যাচ খেলবেন, তত আপনার অভিজ্ঞতা বাড়বে। আমাদের অনেক বেশি প্রীতি ম্যাচ খেলতে হবে এবং বড় বড় দলের সঙ্গে খেলতে হবে। হ্যাঁ, বড় দলের সঙ্গে হয়তো আমরা পারব না। কিন্তু আমরা তো বুঝতে পারব আমাদের দুর্বল জায়গাটা কোথায়। যদি আমরা একসঙ্গে থাকি, দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্পটা চলমান থাকে, তাহলে আমাদের এই টিমটা অনেক দূর যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
খবরের কাগজ: আপনার বয়স তো সবে ২৩। এর মধ্যেই আপনি বাতিলের খাতায় পড়ে গিয়েছিলেন…
মাছুরা: আপনারা কি ভারতের বালা দেবিকে চেনেন? ওনার বয়স কত? ৩৪ বছর বয়সেও তো তিনি খেলছেন এবং দুর্দান্ত খেলছেন। পাকিস্তানের অধিনায়ক মারিয়া খানের বয়সও প্রায় একই (৩৩)। ওর সঙ্গে এবার আমাদের অনেক গল্পও হয়েছে। আপনি জানেন না, পাকিস্তান ম্যাচে আমি ও মারিয়া নামিনি বলে ও কত খুশি হয়েছিল। ম্যাচের পর তো ওর সঙ্গে আমাদের অনেক আলাপ হয়েছে। ও তখন বলেছে। ও নাকি শুধু আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ বলেছে। আমরা কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় না থাকায় ও অনেক খুশি হয়েছিল।
খবরের কাগজ: যেটা বলছিলাম… মাছুরাকে তো বাতিলের খাতায় ফেলা হয়েছিল। মাছুরা নিজে তার ক্যারিয়ার নিয়ে কী ভাবছেন?
মাছুরা: পাকিস্তান ম্যাচে আমাকে নামানো হয়নি বলে আমি কিন্তু অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। আমি তখন ছোটন স্যারের সঙ্গে কথা বলি। স্যার শুধু বলেছেন, ‘তুমি তো প্রায় ১০ বছর বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলছ। আমরা জানি, তুমি কেমন। তুমি সেরা, তুমি এটাই ভাববে। তোমাকে যদি সে (পিটার বাটলার) নামায়, তুমি তোমার সেরাটা দিয়ে খেলবে।’ যেখানে স্যার আমাকে সেরা বলেন, সেখানে তো আমার মন খারাপ করার প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে যখন মাঠে নামিয়েছেন, আমি নিজের খেলাটা খেলার চেষ্টা করেছি। আর আল্লাহকে বলেছি, আল্লাহ, আমি যে এত কষ্ট পেয়েছি, এটার যেন জবাব দিতে পারি। আমি যদি ভারত ম্যাচে খেলতে না পারতাম, অবশ্যই তিনি (বাটলার) আমাকে অনেক কথা শোনাতেন। সব মিলিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমি আমার পারফরম্যান্স মেলে ধরতে পেরেছি। শুধু একটা ম্যাচ না, পরের সবগুলোও খেলেছি। আমি আমার সেরাটা দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছি।
খবরের কাগজ: কতদিন খেলে যেতে চান?
মাছুরা: বয়স তো মাত্র ২৩। এখনো তো অনেক সময় পড়ে আছে। বালা দেবির কথা তো বললাম। এখনো মাঠে আছেন তিনি। তার বয়স কত? পাকিস্তানের অধিনায়কের বয়স কত? আমি তো বলতে গেলে ওনাদের হাঁটুর বয়সী এখনো। এখন দেখা যাক, কতদিন আল্লাহ আমাকে ফুটবলের সঙ্গে রাখেন।
খবরের কাগজ: আপনি তো কাবাডি জাতীয় দলেও খেলেছেন। ২০১৬ এসএ গেমসে রুপাজয়ী দলের অংশ ছিলেন। আর কাবাডিতে ফেরার ইচ্ছা নেই?
মাছুরা: যদি কখনো ফুটবল ছেড়ে দিই, তাহলে হয়তো ফিরব (হাসি)…। আসলে এখন ফুটবলই আমার ধ্যান-জ্ঞান।