বাংলাদেশ বিমানের ‘বিজি-৩৭২’ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতেই তুমুল করতালি। এই করতালি যাত্রী আসনে বসে থাকা সদ্য সাফজয়ী মেয়েদের। সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্দা, ঋতুপর্ণা চাকমাদের অভিনন্দনে সিক্ত হন পাইলটরা।
আগের দিন সাবিনারা স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতেছেন। দুই বছর আগে যে ট্রফি তারা প্রথমবার জিতেছিলেন, এবার সেটা নিজেদের কাছেই রেখে দিতে পেরেছেন। ট্রফি নিয়েই সাবিনারা বাংলাদেশ বিমানের ‘বিজি-৩৭২’ ফ্লাইটে করে ঢাকায় এসেছেন। ট্রফিসহ সাবিনা ব্রিগেডদের নিরাপদে দেশে আনার দায়িত্ব তো ছিল পাইলটেরই। সাবিনাদের সঙ্গে ছিলেন বাফুফের কর্মকর্তা, সাফ কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকসহ সাধারণ অনেক যাত্রীরাও। তাই বিমান ঢাকার মাটি ছুঁতেই পাইলটদের সাবিনাদের এমন স্বীকৃতি।
কাঠমান্ডু টু ঢাকা, বাংলাদেশ বিমানের গতকালের দুপুরের ফ্লাইটটি আসলে অন্য রকমই ছিল। সাধারণ যাত্রীদের অনেকেই তো রীতিমতো বিস্মিত। সদ্য সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী দল যে তাদের সহযাত্রী। পাইলট, কেবিন ক্রুরাইবা বাদ থাকলেন কই। সাবিনারা বিমানে উঠতেই ট্রফি সঙ্গে নিয়ে ছবির জন্য পোজ দিলেন দুই পাইলট। পরে খেলোয়াড়রা একে একে গিয়ে দুই পাইলটের সঙ্গে ছবি তুললেন। বিমানের ভেতর তখন উৎসবের আমেজ।
আর এই বিমানটি কাঠমান্ডুর আকাশে ওড়ার ২০ মিনিটের মধ্যে সবার আনন্দ আরও বেড়ে গেল। ঘোষণা এল, বাঁ পাশের জানালা দিয়ে দেখা যাবে মাউন্ট এভারেস্ট। এক দিন আগে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হওয়া সাবিনারা সেই মাউন্ট এভারেস্ট দেখলেন বেশ রোমাঞ্চ নিয়ে। ডান পাশের রোতে যারা বসে ছিলেন, তারাও তাকিয়ে রইলেন বাঁ পাশের জানালার দিকে। খেলোয়াড়দের কেউ কেউ তো ডান পাশ থেকে বাঁ দিকেই চলে এলেন। প্রকৃতির অপূর্ব এই দৃশ্য এত সুন্দর করে দেখার সুযোগ করে দেওয়াতেই কি পাইলটদের উদ্দেশে সাবিনাদের করতালির আওয়াজ জোরালো ছিল!
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চ্যাম্পিয়নদের সহযাত্রী হয়ে এই প্রতিবেদকের সাফ কাভার করে ফেরা। চ্যাম্পিয়নরা কীভাবে বিমানে ওঠেন, কীভাবে তারা বিমানে সময় কাটান মনে রাখার মতো এক অভিজ্ঞতাই হলো।
রোমাঞ্চিত ছিলেন সাবিনা, ঋতুপর্ণারাও। সেটা শুধু টানা দ্বিতীয়বার সাফের শ্রেষ্ঠত্ব জিততে পারার জন্যই নয়। দেশের মানুষকে দেওয়া কথা রাখতে পারার জন্য। ট্রফি নিয়ে তারা ফিরতে চেয়েছিলেন। সব বাধা অতিক্রম করে সেই ট্রফি নিয়েই তারা কাল কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় পা রেখেছেন।
চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা ঢাকায় পা রাখলে উৎসবের মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সাবিনারা বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর পান ফুলেল শুভেচ্ছা। তাদের জন্য বিমানবন্দরের বাইরে আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ছাদখোলা বাস। মেয়েদের বহনকারী বিমান ৩টা নাগাদ ঢাকায় পা রাখলেও বিমানন্দরে নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেয়েরা ছাদখোলা বাসে ওঠেন ৪টা নাগাদ। বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি তো ছিলই, সাধারণ মানুষেরও উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাদখোলা বাসে করে সাবিনারা বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে বের হলে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ; চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ স্লোগান দিয়ে তাদের স্বাগত জানায় উচ্ছ্বসিত জনতা।
বিজয়ী মেয়েদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরের সামনের সড়কে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক শ মানুষ। হাত নেড়ে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন। নিচ থেকে কেউ কেউ ছুড়ে দেন ফুল। ছাদখোলা বাস থেকে ঋতুপর্ণা, সাবিনা, মনিকারাও পতাকা নেড়ে সাড়া দেন।
বিমানবন্দরে থেকে সেই ছাদখোলা বাসে করে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সাবিনাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাফুফে ভবনে। দুপুর থেকেই বাফুফে ভবন ঢাকঢোল, আর বাদ্যবাজনায় মুখর ছিল। সাবিনারা বাফুফে ভবনে পা রাখতে রাখতে সন্ধ্যা। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা করে এক কোটি টাকার চেক তুলে দেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
সাবিনারা ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও। টিম বাসে করে হোটেল থেকে তারা বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ট্রফি নিয়ে বাংলাদেশ দলের চেক-ইন করার দৃশ্যটাও ছিল দেখার মতো। শুধু চ্যাম্পিয়নের ট্রফিই নয়। ঋতুপর্ণা টুর্নামেন্টসেরা ও রুপনা হয়েছেন সেরা গোলরক্ষক। এই দুটি ট্রফিও ছিল বাংলাদেশ দলের সঙ্গী। ঋতুপর্ণা ও রুপনা সর্বক্ষণ তাদের ব্যক্তিগত স্মারকটা নিজেদের কাছে রেখেছেন। বিমানবন্দরে অনেকের ছবির আবদার মিটিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো মালদ্বীপ দলও একই দিন কাঠমান্ডু ছেড়েছে। মালদ্বীপের খেলোয়াড়দের সঙ্গেও সাবিনারা আনন্দঘন সময় কাটিয়েছেন ত্রিভুবন বিমানবন্দরে।
এবারের সাফে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা তহুরা খাতুন। মোট ৫ গোল করেন তিনি। গ্রুপ পর্বে ভারতের বিপক্ষে জোড়া গোল করার পর সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে করেন হ্যাটট্রিক। তবে ফাইনালে গোল পাওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় তৃতীয় স্থানে থেকে তাকে আসর শেষ করতে হয়েছে। ৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন ভুটানের ডেকি হাজম। ৭ গোল করে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নেপালের রেখা পৌদেল। যিনি কার্ড নিষেধাজ্ঞায় খেলতে পারেননি ফাইনালে। তহুরা শেষ পর্যন্ত ডেকি ও রেখার চেয়ে গোল সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও দলীয় সাফল্যে যোজন যোজন এগিয়ে। তাই সর্বোচ্চ গোলদাতা না হওয়া নিয়ে কোনো আক্ষেপই নেই তার। তবে ত্রিভুবন বিমানন্দরে চেক-ইন করার সময়ে তহুরা আক্ষেপ করলেন ফাইনালের দ্বিতীয় মিনিটেই তার শট বারে লাগা নিয়ে। তার কথায়, ‘শট বারে লাগাটা আসলে কুফা। বারে লাগলে আর গোল হয় না।’
বিমানে ওঠার পর তহুরাকে এ বিষয়ে মনে করিয়ে দিতেই হেসে বললেন, ‘আসলে গোল পেতে কিন্তু কপালও লাগে। ফাইনালে আমার কপাল ভালো ছিল না। তাই গোল পাইনি।’ তবে দল তো জিতেছে। তহুরা বলছিলেন, ‘এ জন্যই ট্রফিটা নিয়ে ফিরতে পারছি। না হলে এই ট্রফি রেখেই বিমান ধরতে হতো।’
বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য বিমান ওঠা, বিমান থেকে এভারেস্ট দেখাটা নতুন কিছু নয়। এবার সাফ খেলতে নেপালে যাওয়ার সময়ও তারা এভারেস্ট দেখতে দেখতে গিয়েছেন। কিন্তু ট্রফি নিয়ে ফেরার সময় মাউন্ট এভারেস্ট দেখাটায় তাদের মধ্যে ছিল অন্য রকম তৃপ্তি। তাদের ভেতর কাজ করছিল অন্য রকম আত্মবিশ্বাসও। ঋতুপর্ণা যেমন বললেন, ‘এভারেস্ট দেখতে সব সময়ই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। নেপালে যাওয়ার সময়ও দেখেছি। এই এভারেস্ট জিততে মানুষ কত কষ্ট করে। অনেক কষ্ট শেষে যখন কেউ এভারেস্ট জিততে পারে, তখনই না পরিশ্রম সার্থক হয়। এভারেস্ট দেখলে তাই সব সময় অন্য রকম আত্মবিশ্বাস কাজ করে। মনে হয় আমরাও পারব।’
এই যে বিশ্বাস, এটাই আসলে বাংলাদেশের মেয়েদের শক্তি। এই বিশ্বাস থেকেই তারা জয় করে চলেছে সব। সাফের ট্রফি জয় শেষে মাউন্ট এভারেস্ট দেখতে দেখতে দেশে ফেরা ঋতুপর্ণারা যেন নিজেদের আরও উঁচুতে তুলে নেওয়ারই ছবি আঁকলেন!