‘গত দুই বছর কী, গত দুই মাস থেকে যা ঘটেছে, সেটাও তো কম কিছু না।’ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের দুই দিন আগে টিম হোটেলে বসে কথাটা বলেছিলেন সাবিনা খাতুন। কী ঘটেছিল? পাল্টা প্রশ্ন করলে রহস্যমাখা হাসি নিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘টুর্নামেন্টটা শেষ হোক’।
টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়নের মুকুট ধরে রেখেছে। এরই মধ্যে ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছে লাল-সবুজের স্বপ্ন সারথিরা।সাফল্য যেহেতু এসেছে, সাবিনা-ঋতুপর্ণাদের নিয়ে এখন মাতামাতিও চলছে। কিন্তু এই মাতামাতি আর উন্মাদনার মাঝে সাবিনাদের সঙ্গে কি ঘটেছিল এই প্রশ্নটা কি হারিয়ে যাবে?
সাবিনার সঙ্গে সেই আলাপচারিতাটা হয়েছিল ভুটানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের পর। তার প্রতি প্রশ্নটা ছিল এমন- ‘গত দুই বছরে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল যে ঝড়ঝাপটা পার করেছে, তাতে রানার্সআপ হলেও সেটা নিশ্চয়ই বড় অর্জন হবে? ছোট্ট উত্তরে সাবিনা বলেছিলেন, ‘গত দুই বছর কী, গত দুই মাস থেকে যা ঘটেছে, সেটাও তো কম কিছু না।’
সাবিনা এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি সেদিন। কিন্তু না বলতে চেয়েও বলে দিয়েছিলেন আরও অনেক কথা। পাকিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ড্র করার পর সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে কোচের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে এসেছিল। সাবিনাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে কোনো কিছু লুকাতে পারেননি তিনি। প্রথমে যদিও বলেছিলেন, ‘আমি আসলে এই বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্যই করতে চাই না। টুর্নামেন্টের পর যত প্রশ্ন আছে আপনাদের, আমি উত্তর দেব।’
কিন্তু পাল্টা প্রশ্নে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে কোচ পিটার বাটলারের দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা সাবিনা পরিষ্কার করে দেন। বলেন, ‘প্রথম ম্যাচ যদি দেখেন… সেকেন্ড ম্যাচে তো আমরা ফোর্স করে (টিম) করিয়েছি। তারপরও কোচ টিম করতে চায়নি। আমাদেরকে বলেছিল খেল, সিনিয়ররা যেহেতু খেলতে চাও, রেজাল্ট কীভাবে বের করতে হয়, কর।’ সাবিনা বলে যান, ‘আমরা চেষ্টা করেছি, তবে উনার ওপর ক্ষোভ থেকে না। এ সব ম্যাচে কতটা দায়িত্ব নিয়ে খেলবেন, এটা হচ্ছে ব্যাপার। মেয়েরা খেলতে পারে, মেয়েরা সেটা প্রমাণ করেছে’।
আসলেই তাই। পাকিস্তানের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত ড্রয়ের পর শক্তিশালী ভারতকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। অধিনায়ক সাবিনার কথায়, যে ম্যাচে তারা ‘ফোর্স করে’ টিম করেছিলেন। কিন্তু সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের মতো আসরে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের অন্দরমহলে এ রকমটা কেন ঘটল?
সাবিনারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় হয়তো সবকিছু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। পিটার বাটলারই যেমন পরশু কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের জোড়াজুড়ি করে টিম করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আলাপচারিতায় জানতে চাইলে সরাসরি বলেছেন, ‘এটা পুরোপুরি মিথ্যা একটি কথা। কেউ আমার কাছে আসেনি। আর কাকে খেলাব, সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস তারা পাবে কীভাবে?’ বাটলার জোড় দিয়ে বলেন, ‘যা করেছি, নিজের সিদ্ধান্তেই করেছি আমি’।
তাহলে সাবিনা কি মিথ্যে বলেছেন? সাফ জিতে দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে সাবিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এখনই কিছু বলতে চাননি। আবারও রহস্য রেখে দিয়ে বলেলেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন…।’
সাবিনা যে বাংলাদেশ নারী ফুটবলের কিংবদন্তি এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১০ সাল থেকে টানা জাতীয় দলে খেলে চলেছেন। তার নেতৃত্বেই টানা দুটি সাফ শিরোপা পেল বাংলাদেশ। কিন্তু একজন সাবিনার ফুটবল নিয়ে অভিমানও কিন্তু কম নেই। কথায় কথায় সাবিনা বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে একটা কথা সামনে আসছে। অনেকেই বলছিলেন, সাবিনার পারফরম্যান্স একটু ডাউন হচ্ছে। কিন্তু আমার যেটা দরকার, সেটা যদি আপনি আমাকে না দেন বা না করেন, আপনি আমার থেকে তো আউটকামটা পাবেন না।’
সাবিনা বলে যান, ‘সারা বছর যদি আপনি আমাকে ক্যাম্পে রাখেন, খেলার মধ্যে না রাখেন, তাহলে দুই বছর পর যদি একটা টুর্নামেন্টে গিয়ে বলেন, সাবিনা তোমাকে ১০ গোল করতে হবে, এটা তো সম্ভব না।’
দুই বছর আগে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ফেরার পর সাবিনাদের সঙ্গে এমনটাই হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে থাকতে হয়েছে। সাফের শিরোপা ধরে রাখার মিশনে যাওয়ার আগে একটা প্রস্তুতি ম্যাচও তারা পায়নি। এমনকি দুই মাসের বেতন বয়েকা রেখে তাদের সাফ খেলতে পাঠানো হয়েছে। সাবিনাদের সঙ্গে এই অবিচারের অবসান কী এবার ঘটবে?