বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের রক্ষণভাগের অতন্দ্র এক সেনানী শিউলী আজিম। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। খবরের কাগজের মুখোমুখি দলের সাফল্য ও নিজেকে নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। দুবারই চ্যাম্পিয়ন দলের অংশ আপনি। সাফল্যের অনুভূতি কেমন লাগছে?
শিউলী: খুবই, খুবই ভালো লাগছে। আগেরবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর একটা ভয় ছিল যে আমরা এই ধারা ধরে রাখতে পারব কি না। ধরে রাখতে পেরেছি, এ জন্যই ভালো লাগাটা বেশি। কিন্তু এই ভালো লাগার মধ্যে আরেকটা প্রেশারও এখন কাজ করছে। এখন কিন্তু দেশের মানুষের চাওয়া থাকবে আমরা যেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। তো এই চাপটা এখন আমাদের সামলাতে হবে। এ ছাড়া সবকিছু ভালোই লাগছে। ভালোই চলছে…।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পর দিনগুলো কেমন কাটছে?
শিউলী: সত্যি বলতে আমি সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি। কারণ আমার পরীক্ষা চলছে (হাসি)।
খবরের কাগজ: ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আপনারা নেপাল গিয়েছিলেন। শিরোপা ধরে রাখাটা আসলে কতটা কঠিন ছিল?
শিউলী: আমরা কখনোই অতি আত্মবিশ্বাসী থাকি না। যতই ভালো খেলি না কেন, সব সময় আমরা আমাদের প্রতিপক্ষকে বড় করে রাখি, বেশি সম্মান দিই। সব সময় আমরা ভাবি যে আমাদের প্রতিপক্ষ যারা আছে সবাই ভালো। এমনিতে এবারের টুর্নামেন্ট যথেষ্ট কঠিনই গেছে। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে আমরা ড্র করে বসি। আমারই ভুলে গোলটা হয়েছিল। প্রথম ম্যাচ ড্র করার পর একটা ভয় ছিল যে এবার সেমিতে যাওয়ার আগেই বাড়ি চলে আসা লাগে কি না। তাই ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচে সবাই ওভাবেই নেমেছিল। সবার মধ্যে একটা বিষয়ই ছিল- আমরা সেমিতে ভালোভাবেই যাব। প্ল্যানিং ছিল যে গ্রুপ পর্বে কঠিন ম্যাচ খেলে সেমিতে সহজ দলের সঙ্গে খেলব। যা-ই হোক, ওপরওয়ালা সহায় ছিলেন। তাই বের হয়ে আসতে পেরেছি।
খবরের কাগজ: পাকিস্তানের বিপক্ষে আপনার ভুলে গোল হয়েছে বলছিলেন। ওই ভুলটা পীড়া দিয়েছে খুব?
শিউলী: আমি তো হাফ টাইমের সময় ড্রেসিংরুমে গিয়ে কেঁদে ফেলেছি। কোচ পিটার বাটলার স্যার সাহস দিয়েছেন। বলেছেন, ভুল হচ্ছে খেলার অংশ। এই ভুল যখন তুমি করবে, পরের সেকেন্ড থেকেই তুমি সেটা আর মনে রাখবে না। ভুলে যাবা। স্যার আরও বলেছিলেন, তুমি ভালো খেলছ, এভাবেই ভালো খেলো। আমরা ম্যাচ বের করব। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা আমরা ড্র করেছিলাম। পরের ম্যাচগুলোতে আমি একটু বেশি সতর্ক ছিলাম, যেন কোনো ভুল না হয়। যদিও গ্রুপ পর্বে ভারত ও সেমিফাইনালে ভুটানের সঙ্গে আমরা একটা করে গোল হজম করেছি। ফাইনালেও একটা গোল হজম করতে হয়েছে। আমি আসলে একটু বেশি সতর্ক ছিলাম। কারণ প্রথম ম্যাচেই আমি ভুল করে ফেলেছিলাম। আসলে সিলি মিসটেকগুলো তো আর মাঠে কেউ করতে চায় না। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওটা হয়ে গেছে। এখন সামনে এটাই ভাবতে হবে, এই সিলি মিসটেকগুলো যেন না হয়।
খবরের কাগজ: গতবার আর এবারের সাফের মধ্যে কোনটা বেশি কঠিন ছিল বলে মনে করেন?
শিউলী: গতবারেরটায় আসলে আমাদের মধ্যে অতটা চাপ কাজ করেনি। এবারেরটা আমাদের মধ্যে একটু চাপ কাজ করেছে। কারণ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন তো আমরা।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মাঠে বলেছিলেন, ফাইনালের আগে নাকি খেতেও পারেননি?
শিউলী: আমরা একেকজন একেকজনের চেহারার দিকে তাকাচ্ছিলাম। এমনিতে আমরা সবাই হাসছিলাম, কথা বলছিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই খুব চিন্তিত ছিলাম। তবে নিজেরা নিজেরাই আবার একজন আরেকজনকে সাহস দিচ্ছিলাম যে ভালো হবে। কী হবে, ওপরওয়ালা জানে। তবে আমরা আমাদের খেলাটা খেলব।
খবরের কাগজ: ফাইনালে তো নেপালি দর্শকে গ্যালারি ভর্তি ছিল। সাবিত্রা ভান্ডারিও ভয় ধরাচ্ছিলেন। ভয় কাজ করেনি?
শিউলী: না, কোনো ভয় কাজ করেনি। আমাদের ডিউটি ছিল ওকে (সাবিত্রা) আটকানো। কোনো ভয় কাজ করেনি। ও তো এমনিতেও সুপারস্টার। আমাদের প্ল্যান ছিল ও বল পেলে আমরা দুজন করে যাব। যেন ও কোনোভাবেই বের হতে না পারে।
খবরের কাগজ: একটু আগে যেটা বললেন, এখন চাওয়া হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এই চাওয়া পূরণে আপনাদের খেলোয়াড়দের কী চাওয়া থাকবে?
শিউলী: মানুষের এখন প্রত্যাশা তো থাকবেই। আমরাও চাই হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হতে। এ জন্য এখন আমাদের প্রচুর প্রচুর হার্ডওয়ার্ক করতে হবে। এর সঙ্গে ফেডারেশন যদি আমাদের সাহায্য করে, তাহলে অনেক বেশি ভালো। ওনারা ক্যাম্পিংটা তো রাখেই। সঙ্গে আরও অনেক বিষয় আছে। আমাদের অন্য চাওয়া-পাওয়াগুলো পূরণ করলে ভালো।
খবরের কাগজ: একটু বলবেন, সেই চাওয়া-পাওয়াগুলো কী?
শিউলী: মিডিয়ায় দেখলাম, কিরণ ম্যাডাম (মাহফুজা আক্তার কিরণ) বলেছেন, কোনো ফেডারেশনই খেলোয়াড়দের মাসিক বেতন দেয় না। এটা আসলেই সত্যি। কিন্তু আমাদের দেশে লিগ তো সেভাবে হয় না। তাই আমরা লিগ থেকে সে রকম ইনকাম করতে পারি না। ওনারা যে স্যালারি দেন, সেটা দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। এই স্যালারিটা যদি একটু নিয়মিত হয়, তাহলে ভালো হয়।
খবরের কাগজ: সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই লিগটাও নিয়মিত হোক, এটা চাইবেন?
শিউলী: লিগ তো আমাদের হচ্ছেই না। হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না। আর আমাদের দেশের শীর্ষ ক্লাবগুলো তো নারী লিগে অংশই নেয় না। বসুন্ধরা কিংস এসেছিল, এখন তারাও নেই। এখন ফেডারেশন যদি চেষ্টা করে, ওই ক্লাবগুলোকে আসার জন্য উৎসাহ দেয়, লিগটা যদি ভালোভাবে পরিচালনা করে তাহলে ভালো। আমাদের নারী ফুটবলের জন্য এটা উপকারে আসবে।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টা আপনাদের সংবর্ধনা দিয়েছেন। আপনারা খেলোয়াড়রা নাকি ঢাকায় ফ্ল্যাট চেয়েছেন?
শিউলী: (হেসে) আমার কোনো চাওয়া নেই। আর আসলে উনিও তো নতুন। সম্ভাবনা কতটুকু, আর এটা আসলে বাস্তবসম্মত চাওয়া কি না, সেটা একটা বিষয়। চাইতে হবে এমন কিছু যেটা উনি দিতে পারবেন।
খবরের কাগজ: সামনে আরও ভালো করতে আপনার নিজের কাছে নিজের চাওয়া কী?
শিউলী: নিজের কাছে আমার নিজের চাওয়া- শিউলী তুই আর সিলি সিলি মিসটেক করবি না। আর এমন একটা ডিফেন্ডার হবি, যেন তোর পাশ দিয়ে কেউ বল নিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে।
খবরের কাগজ: শুনেছি আপনার প্রিয় খেলোয়াড় সার্জিও রামোস। তাকেই আদর্শ মানেন?
শিউলী: আমার ওনাকে ভালো লাগে। আমি মনে করি ডিফেন্ডার হলে এ রকমই হওয়া উচিত। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডরা যখন আপনার কাছে প্রথম আসবে, দ্বিতীয়বার এলে যেন আপনাকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবে।
খবরের কাগজ: আপনি তো কলসিন্দুরের মেয়ে। আপনার বাড়ি ও পরিবারের অবস্থার কথা জানতে চাই…
শিউলী: বাবার তো এখন বয়স হচ্ছে। প্রেশারের সমস্যা আছে। মায়েরও একই অবস্থা। এ ছাড়া এমনিতে ভালো আছেন সবাই। আমরা পাঁচ ভাইবোন। আমি দুই নম্বর। এর জন্যই তো এত দায়িত্ব (হেসে)। আমার ভাই আছে তিনজন। তিনজনই আমার ছোট।
খবরের কাগজ: ভাইদের কেউ বোনের মতো ফুটবলার হতে চায় না?
শিউলী: আমার পিচ্চি দুই ভাই খুবই পাগল ফুটবলের জন্য। কিন্তু আমি চাই না। কারণ এটা খুব পরিশ্রমের পেশা।
খবরের কাগজ: খেলার পাশাপাশি আপনি পড়াশোনাতেও এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তো ফুটবলের বাইরেও নিশ্চয়ই অন্য কোনো কিছু করার ইচ্ছা আছে?
শিউলী: ছোটবেলায় আমার শখ ছিল একজন শিক্ষক হব। এখন দেখা যাক। গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করি। ওই ইচ্ছা এখনো মনে পোষণ করছি। সেটা যদি ফুটবলের প্রশিক্ষকও হয়, তাও হব।