বয়সভিত্তিক দলে আলো ছাড়ানো আফঈদা খন্দকার প্রান্তি এখন সিনিয়র জাতীয় দলেরও প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন। এবার প্রথমবারের মতো সিনিয়র সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের অংশ হয়েছিলেন তিনি। প্রথমবারই পেয়েছেন শিরোপার স্বাদ। সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা এই ডিফেন্ডার খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে দল ও নিজের সাফল্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: প্রথমবার সাফ খেলতে গিয়েই চ্যাম্পিয়ন হলেন। কেমন লাগছে?
প্রান্তি: এটা আমার জীবনের প্রথম সিনিয়র সাফ ছিল। আগে তো জুনিয়র পর্যায়ে মোটামুটি সব প্রতিযোগিতাই খেলা হয়ে গিয়েছিল। শুধু সিনিয়র সাফটা বাকি ছিল। ইচ্ছে ছিল যে সিনিয়র সাফ খেলব। প্রথমবার গিয়েই চ্যাম্পিয়ন, এটা খুব আনন্দের।
খবরের কাগজ: সিনিয়র সাফ কতটা কঠিন মনে হলো?
প্রান্তি: অন্যান্য (জুনিয়র) সাফের থেকে এটা তো অবশ্যই আলাদা। বয়সভিত্তিকে আমরা যেগুলো খেলেছি, সেগুলোও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। তবে সিনিয়র সাফে যতটা ছিল, ঠিক ততটা ছিল না। এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচই যেমন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। এরপর ভারতের সঙ্গে… সবার সঙ্গেই। সিনিয়র দলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা বেশি থাকে।
খবরের কাগজ: চাপটাও নিশ্চয়ই অনেক বেশি থাকে?
প্রান্তি: হ্যাঁ, যেহেতু প্রথমবার সিনিয়রদের সঙ্গে সাফ খেলেছি। এর আগে সিনিয়র জাতীয় দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচও খেলেছি। চাপ একটু বেশিই ছিল। আর সবাই বলত, আঁখি আপু (ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন) নেই। আঁখি আপুর জায়গায় আমি খেলছি। আমি কীভাবে ভালো খেলতে পারব, এটা মাথার ভেতরে বেশি কাজ করত। যেন মানুষ খারাপ বলতে না পারে। আমি আঁখি আপুর জায়গা কভার করতে পারিনি, এটা যেন বলতে না পারে। এটাই মাথার মধ্যে ছিল। এখন তো রেজাল্টই বলে দিচ্ছে, অভাব ছিল কি ছিল না।
খবরের কাগজ: সব মিলিয়ে নিজের পারফরম্যান্সে আপনি কতটা খুশি?
প্রান্তি: নিজের পারফরম্যান্সে আমি অনেক খুশি। যতটা আশা করিনি, তার থেকেও অনেক কিছু পেয়েছি। এ জন্য আল্লাহর কাছে সব সময় শুকরিয়া জানাই।
খবরের কাগজ: এবারের আসরে আপনার নিজের কাছে সেরা ম্যাচ কোনটি?
প্রান্তি: ভারতের সঙ্গের ম্যাচটি। যেটা আমরা ৩-১-এ জিতে গ্রুপসেরা হয়ে সেমিফাইনালে উঠলাম।
খবরের কাগজ: এটা কি ওই ম্যাচে গোল করেছেন বলে?
প্রান্তি: ঠিক সে জন্য না। ওই ম্যাচ আসলে আমাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ খেলি আমরা। ম্যাচটা ১-১ গোলে ড্র হয়। ভারতের সঙ্গে ম্যাচটা এমন ছিল যে, আমাদের সেমিফাইনাল অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারত। সব মিলিয়ে পুরো টুর্নামেন্টে ওই ম্যাচটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
খবরের কাগজ: পাকিস্তান ম্যাচের পর অনেক সমালোচনাও তো ঘিরে ধরেছিল আপনাদের। সেখান থেকে বেরিয়ে যে এত সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়া, এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
প্রান্তি: আমরা সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। সবকিছু আসলে মাথার ওপর নির্ভর করে। মাথা যদি দুর্বল থাকত তাহলে আমরা খেলতে পারতাম না। মানসিকভাবে আমরা অনেক শক্তিশালী ছিলাম বলে সব কিছু ভুলে গিয়ে মাঠেই শুধু ফোকাস দিয়েছি। যে কারণে রেজাল্ট বের হয়ে এসেছে।
খবরের কাগজ: দেশে ফেরার পর তো অনেক অভিনন্দন পাচ্ছেন। বাফুফেও আপনাদের অনেক টাকা পুরস্কার ঘোষণা করল। এই যে মানুষের ভালোবাসা, কেমন লাগছে?
প্রান্তি: সংবর্ধনা, অভিনন্দন পেলে তো ভালোই লাগে। যখন আমরা ভালো করি, দেশের মানুষ তখন উৎসাহিত করেন। এটা অবশ্যই ভালো লাগার। নেপাল থেকে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে বাফুফেতে আসার সময় অনেক মানুষ আমাদের দেখতে এসেছিলেন। এগুলো ভালো লাগে। দেশের জন্য কিছু করলে দেশ যেন আমাদের জন্য করে, এটাই তো আমরা চাই।
খবরের কাগজ: দুই বছর আগে বাংলাদেশ যখন প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হলো, তখন সবাইকে ছাদখোলা বাসে বিমানবন্দর থেকে বাফুফেতে আনা হয়। এবার আপনাদের জন্যই একই ব্যবস্থা ছিল। প্রথমবার যখন এটা করা হয়েছিল, আপনার নিজের মধ্যে কি এই স্বপ্নটা তৈরি হয়েছিল যে, পরের বার যেন আমিও এমনটি করতে পারি?
প্রান্তি: এটা তো কাজ করেছেই। মনের মধ্যে ছিল আমরাও সিনিয়র সাফে খেলব। যদি জিততে পারি তাহলে অবশ্যই আমাদের ছাদখোলা বাসে তোলা হবে। এটা আমাদের শখ ছিল যে ছাদখোলা বাসে উঠব। চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি বলে আমরা উঠতেও পেরেছি। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া সব সময়। তিনি চেয়েছেন বলেই হয়েছে। খুশি ছিলাম ওই দিন। ছাদখোলা বাসে আনন্দও করেছি অনেক।
খবরের কাগজ: ফুটবলার হওয়ার পেছনে আপনার বাবার অনেক অবদান। তো বাবা কতটা খুশি?
প্রান্তি: আমার ফুটবলার হওয়ার পেছনে পুরো অবদানই আসলে বাবার। বাবা অনেক খুশি। আমরা যখন ফাইনালে উঠি, তখনই বাবা খুশিতে আমার জন্য, মা ও আপুর জন্য ড্রেস কিনে রেখেছেন। এখনো অবশ্য বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই ড্রেসটা পাওয়া হয়নি। তবে বাবা দেখা করতে এসেছিলেন।
খবরের কাগজ: আপনার বোনও খেলোয়াড়?
প্রান্তি: আমার বড় বোন আফরা খন্দকার বক্সিং খেলোয়াড়। সামনেই ওর প্রফেশনাল বক্সিংয়ে খেলা আছে। আমার মতো আপুও বিকেএসপি থেকে বের হয়েছেন। এখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
খবরের কাগজ: সাফ চ্যাম্পিয়ন হলেন। সামনের লক্ষ্য কী?
প্রান্তি: ফেব্রুয়ারিতে আমাদের অনূর্ধ্ব-২০ দলের সাফ খেলা আছে। সেটার জন্য তৈরি হব। লক্ষ্য থাকবে সেখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার।
খবরের কাগজ: সিনিয়র সাফে খেললেন। বড় মঞ্চটাও বোঝা হলো। নিজেকে নিয়ে সামনের স্বপ্ন কী?
প্রান্তি: দেশের হয়ে আরও অনেক দিন খেলতে চাই। দেশকে আরও ট্রফি দেওয়ার ইচ্ছা আছে। নিজের জন্য চাই বাইরের দেশে লিগ খেলতে। যেমন সাবিনা আপু, ঋতু আপুরা খেলছেন। আমারও এ ধরনের ইচ্ছা আছে। ইন্শাআল্লাহ, আমিও একদিন যাব খেলতে।
খবরের কাগজ: সাবিনা খাতুন আপনার এলাকার। তিনি দীর্ঘদিন দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আপনি বষয়ভিত্তিক দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
প্রান্তি: এটা তো দেখিই। এখন কতদূর হয়…। আল্লাহপাক যদি চান, তাহলে অবশ্যই হবে।