বয়স সবে ১৮। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে দু-দুটি সাফ শিরোপা উপহার দেওয়ার অন্যতম সারথি স্বপ্না রানী। বিকেএসপির এই শিক্ষার্থী মাঠে তার ফুটবলশৈলীতে আলাদা করে নজর কাড়েন সবার। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে দলীয় সাফল্য ও নিজেকে নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে পর পর দুই আসরে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। আর এই দুবারই চ্যাম্পিয়ন দলের অংশ আপনি। কেমন লাগছে?
স্বপ্না রানী: অবশ্যই এটা ভালো লাগার অনুভূতিটা। যেহেতু পর পর দুবার চ্যাম্পিয়ন এবং দুবারই আমি চ্যাম্পিয়ন দলের অংশ, তাই অনেক ভালো লাগছে। এই সাফল্য আসলে আমাদের অনেক কষ্টের ফল। আমাদের চেষ্টা, এক্সট্রা অ্যাফোর্ড, দেশবাসীর দোয়া ও সৃষ্টিকর্তার কৃপায় হয়েছে সবকিছু।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পর দিনগুলো কেমন কাটছে?
স্বপ্না রানী: দিনগুলো ভালোই কাটছে…
খবরের কাগজ: ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আপনারা নেপাল গিয়েছিলেন। শিরোপা ধরে রাখা কতটা কঠিন ছিল?
স্বপ্না রানী: আসলে একবার চ্যাম্পিয়ন হলে পরবর্তী সময়ে সবার অন্য রকম চাওয়া থাকে। আমাদের কাছেও সবার প্রত্যাশা বেশি ছিল। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করি। ওই ম্যাচটা ড্র হওয়ায় আমরা সবাই একটু চাপে ছিলাম। আমরা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন, এটা ভেবে সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পরবর্তী সময় ভারতের সঙ্গে কীভাবে জেতা যায়, সেই পরিকল্পনা শুরু করি আমরা। সবার চেষ্টা ও জেদ ছিল যে ম্যাচটা জিততেই হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যেও এই বিশ্বাস ছিল যে, ভারতের বিপক্ষে আমরা জিতব। আমি মাঠে নামার সময় বলেছিলাম, আজকে আমরা ৩ গোলে জিতব। পরে তো আমরা সত্যি সত্যি ওদের ৩ গোল দিয়েছি। খুব খুশি হয়েছিলাম তখন। যাই হোক, আমরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলাম। এরপরের ধাপ আরও বড়। সেমিফাইনাল জিতে ফাইনালে পা রাখতে হবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে ভুটানের সঙ্গে সেমিফাইনাল জিতব। সেটাও জিতলাম এবং ফাইনালে পা রাখলাম। নেপালের সঙ্গে ফাইনালে তো মাঠে প্রচুর স্বাগতিক দর্শক ছিল। এত এত ক্রাউড, যা অবিশ্বাস্য। আমরা এর মধ্যেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছি এবং জিতেছি। আমি নিজে উপভোগ করেছি খুব। একটু ভয়ে ভয়েও ছিলাম।
খবরের কাগজ: ভয় লাগছিল কেমন?
স্বপ্না রানী: ম্যাচের রেজাল্ট শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা নিয়ে ভয়ে ছিলাম। আমি তো ফাইনালে বদলি হিসেবে নেমেছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি কি পারব মাঠে নেমে এক্সট্রা অ্যাফোর্ড দিয়ে খেলতে। পরে তো মনে সাহস নিয়ে নামলাম। সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ম্যাচ শেষের দিকে যখন আমরা ২-১ গোলে এগিয়ে, তখন শুধুই মনে হচ্ছিল, রেফারি কখন শেষ বাঁশি বাজাবে, আর আমরা খুশির উল্লাস করব। শেষ পর্যন্ত রেফারি যখন সেই বাঁশি বাজালেন, কি যে আনন্দ হয়েছে। আমরা পর পর দুবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হলাম। ওই মুহূর্তটা বর্ণনা করতে পারব না। তবে যাই বলুন না কেন, ২০২২ সালের থেকে এবার একটু কমই ভয় পেয়েছি। কারণ সেবার তো আমার এসব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এবার যেমন খুশিতে কাঁদিওনি। আগেরবার কিন্তু কেঁদেছিলাম।
খবরের কাগজ: গতবারে আপনি আনন্দ বেশি পেয়েছেন। স্বাভাবিক প্রথম বলে কথা…
স্বপ্না: হ্যাঁ। এবারও কিন্তু ছাদখোলা বাস ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মতো কোনো ফিলিংস ছিল না বা সেবারের মতো মানুষও ছিল না এবার। সেবার তো অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
খবরের কাগজ: যদি বলি গতবার আর এবারের সাফের মধ্যে কোনটা বেশি কঠিন ছিল, তাহলে কী বলবেন?
স্বপ্না রানী: সেটা বলতে পারব না। তবে আমি মনে করি চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা এত সহজ না। বললেই চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না।
খবরের কাগজ: প্রথম ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন। এরপর তো বাকি ম্যাচগুলোতে বদলি হিসেবে খেলতে হয়েছে। বেশি ম্যাচ টাইম না পাওয়ায় আক্ষেপ নেই?
স্বপ্না রানী: না, কোনো আক্ষেপ নেই।
খবরের কাগজ: আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে চাই। ছোট করে যদি বলতেন?
স্বপ্না রানী: ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙাটুঙ্গী ইউনাইটেড নারী ফুটবল একাডেমির হয়ে আমার ফুটবল শুরু। সেখান থেকে বিকেএসপি হয়ে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলি। এরপর মূল জাতীয় দল। বিকেএসপিতে ভর্তি হতে জয়া ম্যাডামের (জয়া চাকমা) অনেক অবদান। জয়া ম্যাডাম আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। যা কখনো ভুলতে পারব না। আমার উঠে আসার দিনগুলোতেও বেশ কয়েকজন স্যারের অনেক অবদান আছে। তাদের কথাও ভুলব না কখনো। এখন বিকেএসপিতে আমি একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি।
খবরের কাগজ: পরিবারের কথা একটু বলুন…
স্বপ্না রানী: বাড়িতে মা-বাবা আছেন। আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমি সবার ছোট। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই ডিগ্রি পাস করেছেন। মেজো বোন এইচএসচি পাস করার পর আর ভর্তি হননি। এখন বাসায় মায়ের কাজে সাহায্য করেন। বাবা আগে দিনমজুরের কাজ করতেন। হার্টের সমস্যার কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। বাসাতেই থাকেন।
খবরের কাগজ: ফুটবল মাঠের স্বপ্না মাঠের বাইরে কেমন?
স্বপ্না রানী: প্রথমেই বলি, খুবই সাধারণ একটা মেয়ে আমি। তবে খুবই ইউনিক। (হাসি)। রাগ ও জেদ বেশি। নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয় সেটা করতে আনন্দ পাই। মানুষের কথায় খুব একটা কান দেওয়ার চেষ্টা করি না। কে কি বলল, না বলল, এসব নিয়েও ভাবি না।
খবরের কাগজ: সব শেষে স্বপ্নার স্বপ্নের কথা জানতে চাই?
স্বপ্না রানী: আমার খুব বেশি স্বপ্ন নেই। তার পরও যদি বলি, মেয়েদের সব থেকে বড় স্বপ্ন হলো তার বাবা-মাকে কীভাবে সুখী রাখা যায়, সেটা। বাবা-মা ও ভাই-বোনদের পাশে থাকা, এটা আমার বড় স্বপ্ন। আর ফুটবলার হিসেবে স্বপ্ন বিদেশের লিগে খেলা। এ ছাড়া বিদেশে পড়াশোনারও ইচ্ছে আছে আমার। চাই নিজের যে ইচ্ছেগুলো আছে, সেগুলো ধীরে ধীরে পূরণ করতে। আর ভালো খেলোয়াড়ের পাশাপাশি ভালো মানুষ হতে চাই।