‘যদি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এই সিরিজটা খারাপও হয়ে যায় তার মানে এই না যে আমাদের দলটা খারাপ হয়ে গেছে, আমাদের রেকর্ড কিন্তু অনেক ভালো।’
মেহেদী হাসান মিরাজের এই কথাগুলো নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ২০২৩ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে তার বলা কথাগুলো সেবার সিরিজ হেরে আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী সেই মিরাজের কথার প্রতিফলন দেখা যায়নি ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হওয়ার দিনে। বাংলাদেশ ৫ উইকেটে হেরে সিরিজটাও হারিয়েছে ২-১ ব্যবধানে। যা কি না আফগানদের কাছে ছিল টাইগারদের টানা দ্বিতীয় সিরিজ হার।
সামর্থ্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী মেহেদী হাসান মিরাজকে একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ঘরের বাইরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে যে সংস্করণে যেখানেই প্রথম সিরিজ খেলা হয়েছে সেখানেই বাংলাদেশ হেরেছে। এমনকি ঘরের মাঠে পর্যন্ত প্রথম টেস্টে হেরেছিল বাংলাদেশ। দেরাদুনে ২০১৮ সালে টি-টোয়েন্টি সিরিজে অসহায় আত্মসমর্পণের কথা তো মনেই আছে সবার। ৩ ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল বাংলাদেশ। ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেনি সেবার সাকিবরা। অবশ্য মনে করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই, সেই সিরিজের শেষ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন মিরাজ। সে বছর এশিয়া কাপে দুই দলের প্রথম লড়াইয়ে ১৩৬ রানে হারে বাংলাদেশ। পরে অবশ্য সুপার ফোরের ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও ইমরুল কায়েসের ব্যাটিংয়ের পর মোস্তাফিজের শেষ ওভারের চমকে ৩ রানের কষ্টার্জিত জয় পায় বাংলাদেশ।
দুই দলের প্রথম মুখোমুখি লড়াইয়েও হেসেছিল আফগানিস্তান। ২০১৪ সালে ফতুল্লায় এশিয়া কাপে সামিউল্লাহ শিনওয়ারির ৮১ রানের ঝোড়ো ইনিংসে ২৫৪ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় আফগানিস্তান, যেখানে ২০০ রান করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতেই স্পষ্ট যে প্রথম সাক্ষাতেই বাংলাদেশকে নিজেদের কমফোর্ট জোনে নিয়ে এসেছিল আফগানরা। এরপর ব্যাটিং ধসের পর জিয়াউর রহমানের ইনিংস দর্শকদের আনন্দ দিলেও বাংলাদেশ হেরেছিল ৩২ রানে। আগেই যেহেতু ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের কথা চলে এসেছে, এর মানে দাঁড়াল এশিয়া কাপের প্রথম তিন লড়াইয়ের দুটোতেই বাংলাদেশের লজ্জাজনক হার।
রঙিন পোশাকে না হয় আফগানিস্তান বাংলাদেশের বিপক্ষে পেরেছে। সাদা পোশাকের ক্রিকেটের খেলায় সদ্য অভিষিক্ত দলটা বাংলাদেশের সামনে আর কতটুকুই বা পারবে? সমর্থকদের মনের এই প্রশ্নের জবাবটা চট্টগ্রামে দুই দলের একমাত্র টেস্টের আগে পাওয়া গেছে আফগানদের তৎকালীন কোচ অ্যান্ডি মোলের কথাতেই ‘বাংলাদেশের প্রতি আমাদের অনেক সম্মান থাকলেও আমরা তাদের ভয় পাই না।’ তার কথার প্রতিফলন দেখা গেছে মাঠে। বৃষ্টিবিঘ্নিত সেই টেস্ট ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হার মেনেছিলেন সাকিব আল হাসানরা। মোহাম্মদ নবীর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট জয় দিয়ে স্মরণীয় করে রাখেন রশিদ খানরা। ২০১৯ সালের সেই টেস্ট তাই বিশেষ কিছু আফগানিস্তানের কাছে।
এবার আরও একবার ফিরে আসা যাক ২০২৩ সালের সেই সিরিজে। চট্টগ্রামে বৃষ্টিবিঘ্নিত সেই ম্যাচে হারের পরদিন আকস্মিকভাবে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন তৎকালীন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। পরের দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে অবসর ভেঙে ফিরে আসেন তামিম। তবে সিরিজ চলাকালীন তার এমন অপেশাদারি আচরণ দলের ভেতর রীতিমতো প্রভাব ফেলেছিল। পরের ম্যাচে ১৪২ রানের হার। প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ পরাজয়। এই সিরিজ হারলেও বাংলাদেশ তো খারাপ দল হয়ে যায়নি, মিরাজের কথায়তো ছিল তেমনই সুর। কিন্তু আদৌ কি সেই সুযোগটা আছে?
সর্বশেষ দুই আইসিসি বিশ্বকাপের দুই দলের পারফরম্যান্সের দিকে তাকালেই উত্তর অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল আফগানরা। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও জিততে চলেছিল তারা। কিন্তু আহত ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ডাবল সেঞ্চুরির মনমুগ্ধকর ইনিংসে হেরে যায় আফগানরা। ফলে সেমিতে আর ওঠা হয়নি রশিদ-নবীদের।
অথচ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জয় ছিল সাকুল্যে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কা আর অন্যটি সেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে। তবে মোহাম্মদ নবী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের কাছে হারা উচিত হয়নি।’ ধর্মশালায় সেই ম্যাচ জিতে গেলে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল নবীদের। যদিও পয়েন্ট টেবিলে তারা বাংলাদেশের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে ছিল। তবে সেই প্রতিশোধ তারা নেয় সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ দুই দলকেই হারিয়ে জায়গা করে নেয় তারা তাদের স্বপ্নের সেমিফাইনালে।
আফগানিস্তানকে মাত্র ১১৫ রানে আটকে দেওয়ার পর সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিতে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১২.১ ওভারে জয়। কিন্তু সেটি হয়নি সাহসের ঘাটতিতে, এমনকি জয়ের দেখাও বাংলাদেশ পায়নি। ক্ষুদ্র এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেও বাংলাদেশ হেরেছিল বৃষ্টি আইনে ৮ রানে। সহজ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। যে ব্যর্থতার কোনো যৌক্তিক জবাব জানা নেই কারোই।
এই হলো আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়কার দৈন্যদশা। ২০২৩ সালে সিরিজ হারের পর পাকিস্তানের মাটিতে এশিয়া কাপে তাদের বিপক্ষে জয় পেলেও ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হতাশ করেছে। যেখানে আফগানিস্তান নজর কেড়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের। ২০২২ সালে ফজলহক ফারুকীর পেসে বিভ্রান্ত হয়ে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য এক জয় পেয়েছিল মেহেদী হাসান মিরাজ ও আফিফ হোসেনের ১৭৪ রানের জুটিতে। সেই সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল বাংলাদেশ। অথচ একটু এদিক ওদিক হলেই তিন সিরিজই হাতছাড়া হতে পারত বাংলাদেশের। সেই সিরিজে মিরাজই একপ্রকার বাংলাদেশকে ফিরিয়েছিলেন। আবার ২০২৩ সালে আত্মবিশ্বাসী মিরাজই নিজেদের অবস্থান শক্ত আছে বলেই দাবি করেছিলেন। আফগানিস্তান অবশ্য র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ায় এখন আর মুখ ফুটে জবাব দেওয়ার অবকাশ নেই।