এ বছরের শুরুতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন মোছাম্মৎ সাগরিকা। যৌথভাবে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন তিনি। বাংলাদেশও হয়েছিল যৌথ চ্যাম্পিয়ন। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে কদিন আগে নেপালে অনুষ্ঠিত সিনিয়র সাফেও বাংলাদেশ দলের গর্বিত সদস্য তিনি। প্রথমবারই পেয়েছেন শিরোপার স্বাদ। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে নিজের ও দলের সাফল্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এই ফরোয়ার্ড। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: প্রথমবারের মতো সিনিয়র সাফে খেলেই শিরোপার স্বাদ পেলেন। এই অনুভূতির কথা জানতে চাই প্রথমে। কেমন লাগছে?
সাগরিকা: অনেক ভালো লাগছে। সিনিয়র আপুদের সঙ্গে প্রথমবার সাফ খেললাম, প্রথমবার গিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সত্যিই এটা অনেক ভালোলাগার অনুভূতি।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
সাগরিকা: অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কেননা আমরা বেশ কজন জুনিয়র খেলোয়াড় এবার প্রথম গেলাম। সিনিয়র আপুদের সঙ্গে আমার প্রথম ট্যুর ছিল এটা। অনেক চাপ ছিল। আপুদের সঙ্গে ভালো খেলতে পারব কি না, দলে থাকব কি না, এগুলো মনে কাজ করত।
খবরের কাগজ: সব মিলিয়ে আপনি তিনটি ম্যাচ খেলেছেন। একটিতে শুরুর একাদশে, অন্য দুটিতে বদলি হিসেবে। নিজের খেলা নিয়ে কতটা খুশি আপনি?
সাগরিকা: আমি খুশি। সিনিয়র দলে প্রথমবার গিয়ে তিনটি ম্যাচ খেলতে পেরেছি। অনেক অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এখন সামনে আরও ভালো কিছু করতে চাই।
খবরের কাগজ: এর আগে বয়সভিত্তিকে ভালো খেলেছেন। এবার সিনিয়র সাফে খেললেন। বয়সভিত্তিক আর সিনিয়র পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য কি দেখলেন?
সাগরিকা: পার্থক্য এটাই, আপুরা সিনিয়র খেলোয়াড়। উনাদের সেন্স ও বুদ্ধি আলাদা। জুনিয়রে যখন খেলেছি, তখন আমার নিজের মতো করে খেলতে পেরেছি বা স্যাররা শিখিয়ে দিয়েছেন সেভাবে খেলতে পেরেছি। সিনিয়র পর্যায়ে আপুরা যেভাবে খেলেন, সেভাবে খেলার চেষ্টা করতে হয়েছে। এটা খুব ভালোভাবেই বুঝেছি যে, সিনিয়র দলে থাকতে হলে আরও ইমপ্রুভ করতে হবে।
খবরের কাগজ: টুর্নামেন্ট চলাকালে তো অনেক বিষয়ে সমালোচনা হয়েছে। যার একটি সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে আপনি কি বলবেন?
সাগরিকা: এগুলো আসলে কিছুই না। এগুলো এমনিতেই উঠেছে। আমাদের আপুরা সব সময় আমাদের সাপোর্ট করেছে। এখনো আমাদের আপুরা অনেক সাপোর্ট ও আদর করে। যেটা বললেন, এগুলো আসলে কিছুই না। এ ধরনের কিছু ঘটেনি।
খবরের কাগজ: সিনিয়র সাফে খেলার অভিজ্ঞতা সামনে কীভাবে কাজে লাগাতে চান?
সাগরিকা: সামনে আমাদের আরও খেলা আছে। বয়সভিত্তিক পর্যায়েও খেলা আছে। সাফে আমরা কেমন খেলেছি, সেটা যদি মাথায় থাকে, যদি এই খেলাটা ধরে রাখতে পারি, তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে।
খবরের কাগজ: এই যে প্রথমবার সাফে খেললেন। ভারত, নেপালের মতো দলের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা হলো। ভয় কাজ করেনি?
সাগরিকা: একটু তো ভয় কাজ করছিলই। ভারত, নেপাল বা পাকিস্তানের মতো সিনিয়র দল কেমন খেলে, সেটা তো সেভাবে জানতাম না। একটু তো ভয় কাজ করছিলই।
খবরের কাগজ: এই ভয়টা জয় করলেন কীভাবে?
সাগরিকা: সিনিয়র আপুরা সাহস দিচ্ছিল যে, ভয় করার কিছু নেই। আমরা আছি। বলতেন, তোমরা যখনই মাঠে নামবে, তখনই মনে করবে আমরা আছি। তোমাদের সেরাটা দিয়ে তোমরা খেলবে।
খবরের কাগজ: এবার জুনিয়র হিসেবে খেললেও পরবর্তী আসরে আপনাদের ওপরই বেশি দায়িত্ব থাকতে পারে। সে জন্য নিশ্চয়ই নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে চাইবেন?
সাগরিকা: ইনশাআল্লাহ। সামনে এগিয়ে যেতে এখন আরও অনেক কিছুই করতে হবে। আমরা চাই যেভাবে খেলে আমরা সাফ জিতেছি, এই খেলাটা যেন সামনেও ধরে রাখতে পারি। যদি সেটা পারি, তাহলে অবশ্যই আরও ভালো কিছু হবে।
খবরের কাগজ: এ পর্যায়ে আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পটা একটু শুনি। কেমন ছিল আপনার উঠে আসা?
সাগরিকা: আমি ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকরের মেয়ে। ছোটবেলায় দেখতাম, আমাদের এলাকার অনেকজনই খেলতে যেত। কিন্তু আমি আসলে সেভাবে ফুটবল খেলা বুঝতাম না। আপুদের বলতাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? আপুরা বলত, খেলতে যাচ্ছি। আমি তো বুঝতাম না। তাই বলতাম, আপনারা কি খেলেন? তখন বলত ফুটবল খেলতে যাই। আমারও তখন যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। মাঠে গিয়ে দেখি অনেক আপুরা ফুটবল খেলছে। আমার দেখে ভালো লাগে। বাসায় এসে বলি, আমিও খেলতে চাই। কিন্তু আমাকে খেলতে দিতে চায়নি।
খবরের কাগজ: এরপরও কীভাবে খেলায় এলেন?
সাগরিকা: পরের পথ পাড়ি দেওয়াটা অনেক কঠিন ছিল। পরিবার তো চায়ইনি। সঙ্গে পাড়াপ্রতিবেশীদের কটু কথা তো ছিলই। মেয়ে মানুষ কেন খেলবে, এসব বলত সবাই। যে কারণ বাবা কিছুতেই রাজি ছিল না আমি ফুটবল খেলি। কিন্তু আমি জেদ করেছি। মনে এটাই ছিল, মানুষ এখন বাজে কথা বলছে। কিন্তু আমি যদি ভালো কিছু করি, তাহলে একদিন তারাই হাততালি দেবে। জোর করে খেলতে যেতাম বলে আমার বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তবে মা সাপোর্ট করত। আমাকে সাপোর্ট করত বলে মার সঙ্গেও বাবা তেমন কথা বলত না। মাকে তখন বলতাম, সমস্যা নেই। একদিন এমন ভালো কিছু করব, আমার বাবাকে দেখিয়ে দেব যে মানুষের কথাতে না, আগে নিজের মেয়ের কথা শোনো। এভাবেই আমার খেলা শুরু হলো। মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিস করতাম। একদিন আমার কোচ বললেন, সাগরিকা ঢাকায় লিগ হবে, তোমার নাম দিয়েছি। তোমাদের বাছাই করতে আসবে। আমি টিকেও যাই। এফসি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার হয়ে ২০২৩ সালে প্রথমবার লিগ খেলি। এরপর সেখান থেকে ছোটন স্যার (গোলাম রব্বানী ছোটন) ও লিটু স্যার (মাহবুবুর রহমান লিটু) আমাকে বাছাই করে বাফুফের ক্যাম্পে ডাকেন। ছোটন স্যার আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। ছোটন স্যার যদি সাপোর্ট না করতেন, তাহলে এতদূর আমি আসতে পারতাম না।
খবরের কাগজ: আপনি কি শুরু থেকেই ফরোয়ার্ডে খেলেন?
সাগরিকা: হ্যাঁ। শুরু থেকেই ফরোয়ার্ডে খেলি।
খবরের কাগজ: আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে বা কাকে আদর্শ মানেন?
সাগরিকা: আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়াড় নেইমার। দেশের ভেতরে ছেলেদের মধ্যে রাকিব ভাইকে ফলো করি। আর মেয়েদের মধ্যে সাবিনা আপু প্রিয়।
খবরের কাগজ: শেষ প্রশ্ন। নিজেকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
সাগরিকা: ভবিষ্যতে বাইরের দেশে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে চাই। এটাই এখন সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।