সদ্যই বাংলাদেশের হকিতে এসেছে দারুণ এক সাফল্য। ওমানে অনুষ্ঠিত ছেলেদের জুনিয়র এশিয়া কাপে পঞ্চম হয়ে ফিরেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ দল। এর মধ্য দিয়ে আগামী বছর ডিসেম্বরে হতে যাওয়া জুনিয়র বিশ্বকাপের টিকিটও পেয়েছেন তারা। এই প্রথম হকির কোনো বিশ্বকাপে থাকবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব। এই অর্জনকে কাজে লাগিয়ে দেশের সামগ্রিক হকিকে এগিয়ে নেওয়ার এখনই সময় বল মনে করছেন যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব পালন করা মওদুদুর রহমান শুভ। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে জাতীয় দলের সাবেক এই খেলোয়াড় কথা বলেছেন আরও অনেক প্রসঙ্গেই। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।
এই প্রথম হকির কোনো বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করল বাংলাদেশ। দলটির কোচ হিসেবে কেমন লাগছে?
অবশ্যই খুব ভালো লাগছে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ হকির কোনো বিশ্বকাপে খেলবে। এই ছেলেরা ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে থাকল। আমার মনে হয় এটাকে পুঁজি করে হকিকে এগিয়ে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এখন। ক্রিকেটের কথাই বলি। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয় ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাইয়ের মাধ্যমে দেশে ক্রিকেট জোয়ার তৈরি হয়েছিল। সেই থেকেই কিন্তু ক্রিকেটের এগিয়ে চলা। হকিতেও আমাদের ছেলেদের এই সাফল্যকে পুঁজি করে পরবর্তী পরিকল্পনা হওয়া উচিত। আমি মনে করি এই সাফল্যকে হকিকে এগিয়ে নেওয়ার টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নেওয়া উচিত। যেহেতু আমরা যুব বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছি। এখন উচিত হবে আমাদের স্ট্যান্ডার্টটা ওই পর্যায়েই নিয়ে যাওয়া যে জুনিয়ররা গিয়েছে, পরবর্তীতে সিনিয়ররাও বিশ্বকাপে যাবে। সেভাবে যদি আমরা না আগাই, তাহলে সাফল্যটা এক জায়গাতেই আটকে যাবে।
আসরের আগে থেকেই আলোচনা ছিল, এবার বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার ভালো সুযোগ আছে। যেহেতু বিশ্বকাপে দল সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগানো কতটা চ্যালেঞ্জের ছিল?
এশিয়া কাপে আমরা সপ্তম হতে পারলেই বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই করতাম। তবে আমাদের দলের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনালে যাওয়ার। সেমিফাইনালে যাবো, এটা ছিল প্রথম লক্ষ্য। আর ষষ্ঠ স্থানের নিচে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। ছেলেরা নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলেছে। কিছু ক্ষেত্রে ভাগ্য সহায় ছিল। আবার কিছু ক্ষেত্রে ছিল না। খুবই টাইট শিডিউল ছিল। সব মিলিয়ে সহজ ছিল না কাজটা। তবে আমি বলবো সেমিফাইনাল খেলার মতো দল ছিলাম আমরা। মালয়েশিয়ার সঙ্গে ম্যাচটা জিতলে (২-২ ড্র) কিন্তু আমরা সেমিফাইনালে থাকতাম।
যখন আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো তখন কী পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করেছিলেন?
আমার লক্ষ্য ছিল দলটাকে একটা টিম হিসেবে তৈরি করার। যাতে একটা ইউনিট হয়ে আমরা খেলতে পারি। তাদের প্রতি আমার প্রথম মেসেজ ছিল- তোমরা এখন ফেডারেশনের অধীনে আছ, দেশের হয়ে খেলবে। তোমরা কে কোন ক্লাবের বা কে কোন জেলার, এটা মনে রাখবে না। হকি ফেডারেশনের অধীনে তোমরা বাংলাদেশ টিম, এই একটা নীতিতে চলবে। তারা সেটাই মেনে চলেছে, খুব ডিসিপ্লিনড ছিল। গত তিন মাস আমি যা বলেছি, এর বাইরে এক লাইনও যায়নি তারা। পুরোপুরি ডেডিকেটেড এবং মোটিভেটেট ছিল যে বিশ্বকাপ আমাদের খেলতেই হবে। লক্ষ্য পূরণের জন্য এই ছেলেরা যে পরিমাণ কষ্ট করেছে, তা ভাষায় প্রকাশের না।
এই সাফল্যে আপনার কোচিং ক্যারিয়ারেও নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ হলো?
তা তো বটেই। কারণ এটা তো ইতিহাস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ এরপর যত বিশ্বকাপেই খেলুক, বলবে এই দলটার কোচ শুভ ছিল। আমার কোচিং ক্যারিয়ারে অবশ্যই এটা এখন পর্যন্ত সেরা অর্জন। এই দলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি আমাদের ফেডারেশন সভাপতি ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। গত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আরিফুল হক প্রিন্সের কথা বলতেই হবে। আমাকে কোচ করার পেছনে তার বড় ভূমিকা ছিল। অনুশীলন ক্যাম্পের জন্য বিকেএসপি পুরো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এজন্য ডিজি মহোদয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রতিটি খেলার পর তিনি ছেলেদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছেন। মোটিভেটেড করেছেন। ফেডারেশন সভাপতিও সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিয়েছেন। যা ছেলেদের অনুপ্রাণিত করেছে।
বিশ্বকাপে কোচ হিসেবে কাজ করা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে আপনার সঙ্গে?
সেভাবে কোনো আলোচনা হয়নি। যদি ফেডারেশন আমার ওপরে আস্থা রাখে, তাহলে কাজ করব। আর ফেডারেশন যদি আরও বেটার কিছু চিন্তা করে, সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। আমার সঙ্গে তাদের কথা ছিল জুনিয়র এশিয়া কাপ পর্যন্ত। এই মিশনে ছেলেরা অনেক কষ্ট করেছে। সবাই মিলে নিজেদের টার্গেটটা ফুলফিল করতে পেরে আমি আনন্দিত।
বিশ্বকাপের আগে ১ বছরের মতো সময় আছে। এই সময়ে ছেলেদের কীভাবে তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন?
এখানে (যুব এশিয়া কাপে) খেলার পর প্রত্যেকটা দল বাংলাদেশের খেলা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে ড্র করেছি আমরা, চীনের বিপক্ষে একবার ড্র করেছি, একবার জিতেছি। ছেলেদের মধ্যে যোগ্যতা বা সামার্থ্য সবই আছে। শুধু ঘাটতি যেটা, সেটা হলো ম্যাচ টেম্পারমেন্ট বা ম্যাচ অভিজ্ঞতা। তাদেরকে এই ১ বছর যদি দেশে-বিদেশে ভালো ভালো দলের বিপক্ষে খেলানো যায়, তাহলে এই ঘাটতি দূর হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের আর্থিক বিষয়টাও দেখতে হবে। বিশেষ করে প্রিমিয়ার লিগ, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ- এগুলো খেলোয়াড়দের আয়ের বড় উৎস। এই খেলাগুলো মাঠে রাখতে হবে। যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাদের দায়িত্ব খেলোয়াড়দের বুস্টআপ করা, খেলার মধ্যে রাখা। খেলোয়াড়দের মোটিভেশনের ওভাব নেই। এরা নিজের পয়সা খরচ করে কেডস, বুট সবই কিনতেছে। যেমন আমার গোলকিপার তার ইকুপমেন্ট আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করে কিনেছে। কিন্তু হকি খেলে আদতে সে কত টাকা পাচ্ছে? তারা নিজেদের সেলফ ডেডিকেশন দিয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের বুস্টআপ করার দায়িত্ব আমাদের।