
সফল হতে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। সঙ্গে লাগে ভাগ্যের ছোঁয়াও। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার এদুর পরিশ্রমের ঘাটতি ছিল না। ছিল মেধার স্ফুরণও। ভাগ্য একটু সুপ্রসন্ন হলেই ১৯৬৬ বিশ্বকাপটা সোনায় মোড়ানো হতো তার জন্য। যদিও তার গড়া একটি রেকর্ড আজও অমলিন। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পাওয়া সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার এদু।পুরো নাম, জোনাস এদুয়ার্দো আমেরিকা।
এদুর আবির্ভাব পেলের যুগে। সে কারণেই হয়তো ততটা লাইম লাইটে আসতে পারেননি এই উইঙ্গার। তবে ব্রাজিলের তিনটি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা এদু যে কয়টি ম্যাচ খেলেছেন, স্বাক্ষর রেখেছিলেন নিজের প্রতিভার। এদু নামটা ১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ বৈশ্বিক আসর দিয়েই এদুর আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলা। একই বছরের শুরুতে তার শুরু সান্তোস অধ্যায়ও। কিন্তু ইংল্যান্ড বিশ্বকাপটি এদু তথা ব্রাজিলের জন্য ছিল বিভীষিকাময়। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল পেলে বাহিনী, যা দেশটির বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত প্রথম। স্কোয়াডে থাকলেও সেই বিশ্বকাপে একটি ম্যাচও খেলা হয়নি এদুর। কারণ একটাই, তখন বদলি খেলোয়াড়ের প্রচলন ছিল না। কোনো খেলোয়াড় আহত হলে তাকে ছাড়াই খেলতে হতো টিমকে।
ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে এদু যখন ডাক পান, তখন তার বয়স ১৬ বছর ৩৩৯ দিন। মাঠে না নামার কারণে বিশ্বকাপে সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলারের রেকর্ডটি তার হয়নি। কিন্তু তিনি বনে যান, বিশ্বকাপ দলে ডাক পাওয়া সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার। ১৭ বছর ৪০ দিন বয়সে খেলতে নেমে বিশ্বকাপে সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলারের রেকর্ডটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের নরম্যান হোয়াইটসাইডের (১৯৮২ বিশ্বকাপ)। এই তালিকায় পেলের অবস্থান পঞ্চম (১৭ বছর ২৩৪ দিন, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ)।
সম্প্রতি ফিফা ডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৬৬ বিশ্বকাপসহ নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন ৭৫ বছর বয়সী এদু। তারুণ্য প্রসঙ্গটি আসতেই এদু শুরু করেন, ‘আজকাল অনেকেই তরুণদের নিয়ে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলেন, কিন্তু আমি ১৭ বছর বয়সে সাও পাওলো স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলাম। বয়স কোনো বাধা নয়। যদি তারা ভালো হয়, তবে তাদের খেলাতে হবে।’
১৯৬৬ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড ও উরুগুয়ে। ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। এদুর ১৭তম জন্মদিনের ঠিক তখনো ২৬ দিন বাকি। ব্রাজিলের মিশন শুরু হয়েছিল বুলগেরিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে। তবে পরের দুই ম্যাচে পর্তুগাল ও হাঙ্গেরির কাছে হেরে বিদায় নেয় ব্রাজিল। এই তিন ম্যাচে একাদশে জায়গা পাননি এদু। তবে বদলির সুযোগ থাকলে স্বপ্নটা পূর্ণ হতো তার। সেই স্মৃতি মনে করে এদু বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৬৬ সালে কোনো বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম ছিল না। শুরুর ১১ জনই খেলত, আর যদি কেউ আহত হতো, তাহলে এক খেলোয়াড় কম নিয়েই খেলা চালিয়ে যেতে হতো। আমি এবং জিতো ছিলাম একমাত্র খেলোয়াড় যারা, ওই বিশ্বকাপে মাঠে নামতে পারিনি।’
এর তিন বছর পর, তখনো কিশোর বয়সেই এদু তার ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছান। ১৯৭০ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আমেরিকান বাছাই পর্বে ব্রাজিলের হয়ে প্রতিটি ম্যাচ খেলেন তিনি। এদু বলেন, ‘১৯৬৯ সালে আমাদের ডাকা হলে, কোচ জোয়াও সালদানহা আক্রমণভাগে জরজিনহো, টোস্টাও, পেলে এবং আমাকে রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটাই সেই আক্রমণভাগ, যা ১৯৬৬ বিশ্বকাপে খেলতে পারত। আমরা সবাই তখন সেখানে ছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি মাঠে নামতে পারিনি। অন্যরা পেরেছিল।’
সালদানহা ১৯৭০ বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক মাসে আগে বরখাস্ত হন। কোচের দায়িত্ব নেন মারিও জাগালো। এরপর এদু তার জায়গা হারান। কারণ ব্রাজিলের আক্রমণভাগে তখন ছিলেন জরজিনহো, পেলে, টোস্টাও এবং রিভেলিনো। শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল স্কোয়াডে ছিলেন এদু। খেলেছিলেন একটি ম্যাচও। পেলের সঙ্গে তিনিও বিশ্বকাপজয়ী দলের গর্বিত সদস্য। সব মিলিয়ে ব্রাজিলের হয়ে ৫৪ ম্যাচে ১২ গোল করা এদুর শেষ বিশ্বকাপ ছিল ১৯৭৪।
এদুর দুই পা চলত সমান তালে। গতি ও দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আর তাই সান্তোসের ভিলা বেলমিরোতে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে নিয়ে আসা হয়। সেটাও পেলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। সান্তোসে এদু পেলের কথা রেখেছিলেন ভালোমতো। ৫৮৪ ম্যাচে তার গোল ১৮৪টি। ক্লাবটির ইতিহাসের ম্যাচ খেলা ও গোল করার দিক থেকে এদু যথাক্রমে সপ্তম এবং ষষ্ঠ স্থান দখল করে রেখেছেন।
১৯৬৬ বিশ্বকাপে না খেলতে পারায় এদু অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন মানসিকভাবে। ঘুরেও দাঁড়িয়েছিলেন দ্রুত। সে প্রসঙ্গে এদু বলেন, ‘বিশ্বকাপ শেষে এক মাস পর, সান্তোস এবং বেনফিকা আমেরিকায় একটি প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়। বেনফিকায় ছিল পর্তুগাল জাতীয় দলের সাতজন খেলোয়াড়, যারা এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়েছিল। পর্তুগিজ স্কোয়াডে ছিলেন কিংবদন্তি ইউসেবিও এবং মারিও কলুনা। কিন্তু সান্তোসের হয়ে বেনফিকাকে আমরা হারিয়েছিলাম ৪-০ গোলে। যার দুটি গোলই আমার।’
শেষের অধ্যায়ে পরম আকুতিই ঝরে পড়ল এদুর কণ্ঠে, ‘তারা আমাকে খুব ভালো করে জানত না। এটা দারুণ হতো যদি বিশ্বকাপটা খেলতে পারতাম। কারণ আমি তখন তারুণ্যের আগুনে টগবগে, রীতিমতো উড়ছিলাম। কিন্তু মাঠে নামতে না পারার কষ্টটা আজীবনই পোড়াবে হয়তো।’