১৯৯৮ সাল। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ তখনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিতে পারেনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়মিত খেলতে হলে আইসিসির টেস্ট ক্রিকেটের বনেদি পরিবারের সদস্য হতে হয়। সেই সদস্য পদ বাংলাদেশের ছিল না। আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ না পাওয়াতে বৈশ্বিক কোনো আসর আয়োজনও করতে পারেনি। তবে ১৯৮৮ সালে একবার এশিয়া কাপ ক্রিকেট আয়োজন করেছিল। এশিয়ার তিন সেরা দল পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার অংশগ্রহণে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। বাংলাদেশও খেলেছিল। এরপর ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ছাড়পত্র পেয়েছিল। কিন্তু এই আসর খেলার আগেই মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো বাংলাদেশের হাতে আকাশের চাঁদ এসে ধরা দে ১৯৯৮ সালে। টেস্ট পরিবারের সদস্য না হওয়ার পরও আইসিসির নতুন ইভেন্ট নক আইটি ট্রফি বা মিনি বিশ্বকাপ (পরিবর্তিত নাম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) আয়োজন করার স্বত্ব পায়। সময়ের প্রেক্ষাপটে সেটি ছিল বাংলাদেশের জন্য অষ্টম আশ্চর্যজনক ঘটনা! আর এটি সম্ভব হয়েছিল বাঙ্গালিবাবু কলকাতার জগমোহন ডালমিয়ার কারণেই। তিনি ছিলেন সে সময় আইসিসির সভাপতি।
বাংলাদেশের দর্শকদের ঘরের মাঠে বিশ্বমানের তারকাদের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা ছিল শুধু ১৯৮৮ সালের এশিয়া কাপই। সে সময় ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তিন দেশে বিশ্বমানের তারকাদের ছড়াছড়ি ছিল। ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, কপিল দেব, দিলিপ ভেংসরকার, মহিন্দর অমরনাথ, কিরন মোরে নভোজিৎ সিং সিধু, কৃষ্ণচামারি শ্রীকান্ত, পাকিস্তানের জাভেদ মিয়ানদাদ, আব্দুল কাদির, ওয়াসিম আকরাম, রমিজ রাজা, সেলিম মালিক, ইজাজ আহমেদ, শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, মাহানাম, অরবিন্দ ডি সিলভা, রঞ্জন মাদুগালে, দুলিপ মেন্ডিস, হাসান তিলকরত্নে। মিনি বিশ্বকাপ এই তিন দেশের অনেকের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ের অনেক তারকা ক্রিকেটারদের খেলাও মাঠে বসে দেখার সুযোগ করে দেয়। যেখানে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, গ্লেন ম্যাকগ্রা, রিকি পন্টিং, মাইকেল বেভান, ইংল্যান্ডের নেইল ফেয়ারব্রাদার, অ্যাসলে জাইলস, গ্রায়াম হিক, অ্যাডাম হোলিওক, নিউজিল্যান্ডের স্টিফেন ফ্লেমিং, ক্রিস হ্যারিস, ক্রেইগ ম্যাকমিলান, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, নাথান অ্যাসলে, দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যানসি ক্রোনিয়ে, নিকি বোয়ে, মার্ক বাউচার, জ্যাক ক্যালিস, জন্টি রোডস, শন পোলক, মাখায় এনটিনি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, শিবনারায়ণ চন্দ্রপল, কার্ল হুপার, ফিল সিমন্স, জিম্বাবুয়ের অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, অ্যান্ড্রি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার,মারি গুডউইন, নেইল জনসন, হিথ স্ট্রিক, অ্যান্ডি হুইটাল। এ সমস্ত ক্রিকেটারদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বাংলার জমিন।
একসময় যাদের খেলা দেখার একমাত্র অবলম্বন ছিল টিভি পর্দা, সেখানে চোখের সামনে হাত ছোঁয়া দূরত্বে বিশ্বের সব সেরা ক্রিকেটার! সে কি উন্মাতাল হাওয়া বাংলার আকাশে। ক্রিকেট-জ্বরে রীতিমতো কাঁপছিল দেশ। কিন্তু এতো উত্তাল আনন্দের মাঝে সেখানে ছিল না বাংলাদেশ দল। কারণ আইসিসির প্রথম এই আসর আয়োজন করেছিল শুধু টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে নিয়েই। বাংলাদেশ তখনো আইসিসির সহযোগী সদস্য ছিল। তারা পূর্ণ সদস্য হয়েছিল ২০০০ সালে। যে কারণে মিনি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল নিজ দেশে পরবাসীর মতো। বাংলাদেশ স্বাগতিক হওয়ার দরুন এক অন্য রকম সুখানুভুতি উপভোগ করেছিল দর্শকসারিতে বসে।
প্রথম আসর ছিল নকআউট। হারলে বিদায়, জিতলে টিকে থাকা। যে কারণে ৯ দলের আসরের আয়ু খুব বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। ২৪ অক্টোবর শুরু হয়ে ১ নভেম্বর শেষ হয়েছিল। ৯ দলের আসর হওয়াতে নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে দিয়ে শুরু হওয়া ম্যাচটি ছিল অনেকটা প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের মতোই। দলগুলোর র্যাঙ্কিং করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফলাফল অনুযায়ী। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড বাকি ৭ দলের মাঝে জায়গা করে নেয়। এরপর একে একে হয় কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪ উইকেটে হারিয়ে শেষ হাসি হাসে দক্ষিণ আফ্রিকা। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার এটিই আইসিসির প্রথম ও একমাত্র শিরোপা।
আইসিসির এই টুর্নামন্টে বাংলাদেশকে খুব বেশি সময় দর্শক হয়ে থাকতে হয়নি। নিজ দেশে পরবাসী থাকলেও ২০০০ সালে কেনিয়াতে পরের আসরেই বাংলাদেশ সুযোগ পায় নিজেদের মঞ্চস্থ করার। আইসিসির ৯ পূর্ণ সদস্য দেশের সঙ্গে দুই সহযোগী সদস্য বাংলাদেশ ও কেনিয়াও খেলেছিল। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ৮ উইকেটে হেরে থামে বাংলাদেশের অভিষেক আসরের যাত্রা। ২০০৯ ও ২০১৩ সালে পরপর দুই আসরে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটে না থাকাতে বাংলাদেশ খেলার সুযোগ পায়নি। এ ছাড়া প্রতি আসরেই খেলেছে। সেখানে তাদের সেরা সাফল্য ছিল সর্বশেষ ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অষ্টম আসরে সেমিফাইনাল খেলা।
এবারে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নবম আসর। আগের ৮ আসরের ৫টিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র ২টিতে। যার একটি ছিল গতবার ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। ‘এ’ গ্রুপের কার্ডিফে অনুষ্ঠিত ম্যাচে মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারিয়ে এক জয়েই ওঠে গিয়েছিল সেমিতে। গ্রুপ পর্বে বৃষ্টির কল্যাণে নিশ্চিত হারা ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ড্র করে এক পয়েন্ট পেয়েছিল। এই ড্র-ই যেমন পরে বাংলাদেশকে সেমিতে খেলতে বিরাট সহযোগিতা করেছিল, তেমনি কপাল পুড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। তারা সেমিতে যেতে পারেনি। এই জয় ছাড়া বাংলাদেশের অপর জয় ছিল ২০০৬ সালের আসরে বাছাইপর্বে। ভারতে অনুষ্ঠিত সেই আসরে ৪ দলের বাছাইপর্বে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১০১ রানে হারিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে। বাছাইপর্ব তৃতীয় হয়ে বাংলাদেশ বাদ পড়েছিল। এই দুই জয়েই বাংলাদেশের ৩টি সেঞ্চুরি ছিল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শাহরিয়ার নাফীস করেছিলেন ১২৩ রান। বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৬ উইকেটে ২৩১ রান। জিম্বাবুয়ে অলআউট হয়েছিল ১৩০ রানে। কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান। নিউজিল্যান্ডের ৮ উইকেটে করা ২৬৫ রানের জবাব দিতে নেমে এক পর্যায়ে ৪৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। পরে পঞ্চম উইকেট জুটিতে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ ২২৪ রান যোগ করে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন। সাকিব ১১৪ রান করে আউট হলেও মাহমুদউল্লাহ ১০২ রান করে অপরাজিত ছিলেন। এই দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফীস ও সাকিব আল হাসান।
এবার নবম আসরে বাংলাদেশের ষষ্ঠ অংশগ্রহণ। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত দেশবাসীকে শুনিয়ে গেছেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প!