প্লেয়ার্স ড্রাফটের পর চিটাগং কিংসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল বিপিএল চলাকালীন মঈন আলী তাদের হয়ে খেলতে আসবেন। এমন কি আরও বড় তারকারাও আসবেন খেলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মঈন আলী কিংবা অন্য কোনো বড় তারকা তাদের দলে পরে আর খেলতে আসেননি। মঈন আলী দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ২০ আসরে জুবার্গ সুপার কিংসের হয়ে খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। বিপিএল চলাকালীন এসএ২০ আসর ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইএলটি২০ আসরও চলমান ছিল। যে কারণে শুধু মঈন আলী নয়, এ রকম বিশ্বমানের অনেক ক্রিকেটারের পক্ষেই বিপিএল খেলা সম্ভব হয়নি। যারা ছিলেন বিপিএলের নিয়মিত মুখ। এই দুই আসরের কারণে এবারের বিপিএলে মান সম্মত বিদেশি ক্রিকেটারদের শূন্যতা দেখা দেয়।
বিদেশি ক্রিকেটারদের কোটা পূরণ করতে গিয়ে বিপিএলের এক একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মানহীন বিদেশি ক্রিকেটারদের নিয়ে এসেছেন। হাতে গোনা কয়েকজন ক্রিকেটার বাদ দিলে বাকিরা ছিলেন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। এ সব মানহীন ক্রিকেটারদের পদচারণে বিপিএল হয়ে উঠেছিল যেন বিদেশি ক্রিকেটারদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। এ রকম অনেক ক্রিকেটার আছেন, যাদের বিপিএল দিয়েই দর্শকরা জানতে পেরেছেন যে তারা ক্রিকেট খেলেন!
এবারের বিপিএলে চিটাগংয়ে ১০ জন, খুলনায় ১১ জন, বরিশাল, ঢাকা ও সিলেটে ৯ জন করে, রংপুরে ৮ জন ও রাজশাহীতে ৬ জন বিদেশি ক্রিকেটার খেলেছেন। এসব দলে নামসর্বস্ব এমন অনেক ক্রিকেটার খেলেছেন, যাদের এক ম্যাচের বেশি খেলাতে সাহস করেননি ফ্র্যাঞ্চাইজিরা। এ রকম ক্রিকেটার ছিলেন বরিশালের মোহাম্মদ ইমরান, চিটাগংয়ের লাহিরু মিলানথা, থমাস ও’কনেল, রংপুরের টিমোথি হেইস ডেবিড, রাজশাহীর ধর্সানা সামারাক, আফতাব আলম, সিলেটের লুক জাগেসার।
এদের ছাড়াও একাধিক ম্যাচ খেলাও অনেক ক্রিকেটার আছেন যাদের নাম আগে কখনো শুনা যায়নি। যেমন ঢাকার স্টিফেন সিন এসকিনাজি, সোবহাম সুবাস রঞ্জন, ফারমানউল্লাহ সাফি, খুলনার আলেকজান্ডার আয়ান রোজ, রংপুরের স্টিভন টেইলর,সিলেটের আহসান ভাট্টি। আবার অনেক ক্রিকেটারকে দলভুক্ত করা হয়েছে যারা দেশের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে খেললেও কখনো টি-টোয়েন্টি খেলেননি। এ রকম ক্রিকেটার ছিলেন সিলেটের বিশালদেহের অধিকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাকিন কর্নওয়েল, ইংল্যান্ডের পিটার শিবলী, রাজশাহীর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিগুয়েল কামিন্স।
শুধু তাই নয় এমন অনেক অখ্যাত ক্রিকেটার আনা হয়েছে, যাদের দেশে ক্রিকেট এখনো সেভাবে প্রচলন হয়নি, আবার হলেও আছে দুর্বল অবস্থানে, সেই সব দেশ থেকেও ক্রিকেটার আনা হয়েছে। এ রকম ক্রিকেটার হলেন রংপুরের হয়ে একটি ম্যাচ খেলা সিঙ্গাপুরের টিমোথি হেইস ডেবিড, ঢাকার হয়ে ৩ ম্যাচে ২২ রান করা নামিবিয়ার জিন পিয়েরি কোটজি। তিনি দেশের হয়ে ৪৪ ম্যাচে ৭৯০ রান করেছেন। আবার এ রকম কিছু ক্রিকেটার খেলতে এসে নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছেন। যেমন বরিশালের মোহাম্মদ আলী মাত্র ২ ম্যাচ খেলে ৬ উইকেট নেন। যার ৫টিই ছিল আবার এক ম্যাচে। চিটাগংয়ের পাকিস্তানের খাজা নাফি (৫ ম্যাচে ২০১ রান) ও দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়াম ক্লার্ক (১৪ ম্যাচে ৪৩১ রান), খুলনার অস্ট্রেলিয়ার বসিস্তো (১০ ম্যাচে ২৯৮ রান ও ২ উইকেট), পাকিস্তানের সালমান ইরশাদ (৭ ম্যাচে ৯ উইকেট), রংপুরের পাকিস্তানের আকিফ জাভেদ (১১ ম্যাচে ২০ উইকেট)।
তারকা ক্রিকেটারদের মাঝে নিজেদের মান ধরে রাখতে পেরেছেন বরিশালের ইংল্যান্ডের ডেবিড মালান (৯ ম্যাচে ৩১৬ রান), ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাইল মায়ার্স (৭ ম্যাচে ২০৯ রান ও ৫ উইকেট), ঢাকার শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরেরা (১২ ম্যাচে ২১২ রান ও ৪ উইকেট। অপরাজিত ১০৩ রানের একটি সেঞ্চুরিও আছে), রংপুরের পাকিস্তানের খুশদিল শাহ (১০ ম্যাচে ২৯৮ রান), ইংল্যান্ডের আলেক্স হেলস (৬ ম্যাচে ২১৮ রান) পাকিস্তানের ইফতেখার আহমেদ (১২ ম্যাচে ৩০৫ রান ও ৫ উইকেট),খুলনার মোহাম্মদ নেওয়াজ (১২ ম্যাচে ৮৮ রান ও ১০ উইকেট)।
খুশদিল শাহ ও অ্যালেক্স হেলস আসরের মাঝপথে চলে যান। জেসন রয় চলে যান ২ ম্যাচ খেলে। তারকা ক্রিকেটারদের মাঝে হতাশ করেন বরিশালের আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী। ১১ ম্যাচ খেলে ব্যাটে মাত্র ৫৭ রান ও বল হাতে ৮ উইকেট নেন। একই দলের হয়ে খেলা পাকিস্তানের শাহীন শাহ আফ্রিদি হতাশ করেন সবাইকে। তিনি ৫ ম্যাচে ৩৫ রান করার পাশাপাশি উইকেট নেন মাত্র ৪টি। অথচ অতীতে বিপিএলে বিশ্বমানের অনেক তারকা ক্রিকেটারদের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা ক্রিস গেইল থেকে শুরু করে, ডি ভিলিয়ার্স, রাইলি রুশো, শহিদ আফ্রিদি, রশিদ খান, মজিবুর রহমান, ড্যারেন সামি, বাবর আজম, মোহাম্মদ সামি, সাঙ্গাকারা, তিলকরত্নে দিলশান, অজন্তা মেন্ডিস, ব্রান্ডেন টেলর, সোহেল তানভীর, স্কট স্টাইরিস, ব্রাড হজ, আহমেদ শেহজাদ, জেসন রয়, ডুয়াইন ব্রাভো, মুরালিধরন, মারলন স্যামুয়েলস, চন্দরপল, হার্সলে গিবস, আন্দ্রে রাসেল, আজহার মাহমুদ, পোলার্ড, ইমরান নাজির, নাসির জামসেদ, কামরান আকমল, হ্যামিলটন মাসাকাদজা, রবি বোপারা, জ্যাকব ওরাম, শন টেইট, ডোয়াইন স্মিথ, মোহাম্মদ নবী, শোয়েব মালিক, স্যামুয়েলস, নিকোলাস পুরান, মোহাম্মদ শাহজাদ, জোফরা আর্চার, লাসিথ মালিঙ্গা, ব্রান্ডেন ম্যাককুলাম, সুনীল নারিন, জস বাটলার, এভিন লুইস, আদিল রশিদ, উপল থারাঙ্গা, আন্দ্রে ফ্লেচার, জনসন চার্লস, থিসারা পেরেরা, সিকান্দার রাজা, মোহাম্মদ হাফিজ, ডেবড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথ, মোহাম্মদ আমির, ডেডিব মালান, ফজলহক ফারুকী, করিম জানাতের মতো ক্রিকেটাররা খেলে গেছেন।
বিপিএল যে তারকা ক্রিকেটারদের পছন্দের তালিকায় পেছনের কাতারে চলে গেছে তা বোঝা যায় ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাইল মায়ার্সের দিকে ফিরে তাকালে। তিনি শুরুতে বরিশালের হয়ে খেললেও আইএলটি২০ আসরে আবুধাবী নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলতে চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই আসর শেষ হলে তিনি আবার বিপিএলে খেলতে চলে আসেন। তারপর খেলেন ফাইনাল পর্যন্ত।
মানহীন নামসর্বস্ব যেসব ক্রিকেটারকে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলিয়েছেন, তাদের পেছনে কিন্তু টাকা ঠিকই ব্যয় করতে হয়েছ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে এ রকম যেসব ক্রিকেটার নিয়ে আসা হয়েছে তাদের পেছনে শুধু বিমান ভাড়া বাবদ ৫ লাখ টাকার ওপরে গুনতে হয়েছে। তারপর থাকা-খাওয়া, দৈনিক ভাতার সঙ্গে পারিশ্রমিক তো আছেই। কিন্তু এই ক্রিকেটারদের না এনে ভালোভাবে হোম ওয়ার্ক করলে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড এমনকি অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক ভালো খেলোয়াড় আনা সম্ভব হতো বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মানহীন বিদেশি ক্রিকেটার না এনে সেরা একাদশে প্রয়োজনে একজন বিদেশি কম খেলিয়ে দেশি একজন বেশি খেলানো যেত পারে। তা ছাড়া ভালোভাব হোম ওয়ার্ক করলে পাকিস্তানের পিএসএল, ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট, এমন কি অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ থেকেও এ সব ক্রিকেটারের চেয়ে অনেক ভালো ক্রিকেটার নিয়ে আসা সম্ভব।’