
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গঠনতন্ত্র সর্বশেষ সংশোধিত হয়েছিল ২০২৪ সালে। এই সংশোধনে ২৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আগের পরিচালনা পর্ষদই রাখা হয়েছে। যেখানে উল্লেখ আছে তিন ক্যাটাগারিতে ২৫ জন পরিচালক নিয়ে গঠিত হবে পরিচালনা পর্ষদ। এই তিন ক্যাটাগরির মাঝে ক্যাটাগরি-১ থেকে নির্বাচিত হয়ে আসবেন ১০ জন পরিচালক। এ প্রসঙ্গে ২৯ পৃষ্ঠার গঠনতন্ত্রে তৃতীয় অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৯.১-এ আঞ্চলিক ও জেলা ক্রিকেট সংস্থার প্রতিনিধি (ক)তে উল্লেখ আছে- ‘প্রতিটি আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার (ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ব্যতীত) হইতে ০১ (এক) জন করিয়া প্রতিনিধি থাকিবে।’ এখানে আঞ্চলিক সংস্থা বলতে বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাকে বোঝানো হয়েছে। দেশে আটটি বিভাগ থাকলেও বিসিবি সাতটি বিভাগকে অনুমোদন দিয়েছে। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তাদের হিসাবের আওতায় আনেনি।
বাংলাদেশে প্রথমে বিভাগ ছিল চারটি- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। পর্যায়ক্রমে বিভাগ অনুমোদন পায় বরিশাল, সিলেট ও রংপুর। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগেই বরিশাল ও সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রংপুর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। এর পরই রংপুর বিভাগ বিসিবির গঠনতন্ত্রে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত বিসিবির গঠনতন্ত্রে জায়গা পায়নি। নাজমুল হাসান পাপনের চার মেয়াদে একাধিকবার গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনা হলেও ময়মনসিংহ বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগের পক্ষ থেকে সংগঠক ও ক্রিকেটাররা বারবার বিসিবির কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তারা উপেক্ষিতই থেকে যান। সেই উপেক্ষার ধারা নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদের সময়ও অব্যাহত থাকতে যাচ্ছে! বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য নাজমুল আবেদীন ফাহিমের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিটি ময়মনসিংহ বিভাগকে আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থা হিসেবে রাখার জন্য প্রস্তাব করেনি। এ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে ময়মনসিংহের ক্রীড়াঙ্গন। মানববন্ধন করা হয়েছে। বিসিবি সভাপতি বরাবর দেওয়া হয়েছে স্মারকলিপিও।
দেশের ক্রিকেটে ময়মনসিংহের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। সেই রামচাঁদ গোয়ালা থেকে শুরু করে বেলায়েত হোসেন বেলাল, হারুনুর রশিদ লিটন, আজহার হোসেন, সদরুল আনাম, সাইফুল ইসলাম, সানোয়ার হোসেন, মাহবুবুর রহমান সেলিম, শরিফুল হক প্লাবন, মনির, জাকির থেকে শুরু করে এই সময়ের শুভাগত হোম, যুবায়ের লিখন, আবু হায়দার রনি, আব্দুল মজিদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উঠে এসেছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে। একসময় ঢাকার জনপ্রিয় প্রথম বিভাগ (পরে প্রিমিয়ার বিভাগ) ক্রিকেট লিগে জিএমসিসি (গ্রেটার ময়মনসিংহ ক্রিকেট ক্লাব) নামে একটি ক্লাব বেশ দাপটের সঙ্গে খেলেছে। বিসিবি অনুমোদন না দেওয়ায় এনসিএল ও বিসিএলে ময়মনসিংহ বিভাগ খেলার সুযোগ পায় না। যে কারণে এই বিভাগের ক্রিকেটারদের ঢাকা বা অন্য বিভাগের হয়ে খেলতে হয়। ময়মনসিংহ বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান বলেন, ‘যদি নিজস্ব খেলোয়াড় দিয়ে জাতীয় লিগ খেলা হয়, ময়মনসিংহের পর্যাপ্ত খেলোয়াড় আছে এবং চ্যাম্পিয়ন ফাইট দেবে।’
ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে বিসিবির দৃষ্টিভঙ্গিও বিতর্কিত। বিসিবির অনুমোদন না পাওয়ায় এনসিএল ও বিসিএলে পুরুষ দল খেলার সুযোগ পায় না, কিন্তু নারী দলকে এনসিএলে ঠিকই খেলার সুযোগ করে দিয়েছে বিসিবি। অনেকেই মনে করেন, ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে এটি বিসিবির খামখেয়ালিপনা। এ নিয়ে আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান বলেন, ‘পাপন ভাইয়ের ( বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন) সময় আমরা বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর আইনগতভাবে যেতে চাইলাম। কিন্তু মল্লিক সাহেব (বিসিবির সাবেক পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক) নিষেধ করলেন আইনগতভাবে যেতে। তিনি জানালেন মহিলাদেরটা দিয়ে দিই। মহিলা জাতীয় লিগ খেলুক। ছেলেদেরটা আগামীবার দিয়ে দিচ্ছি। এই যে আগামী করতে করতে এই পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।’ নারী এনসিএলে ময়মনসিংহ বিভাগ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন।
বিসিবি এনসিএলে সাতটি বিভাগীয় দলের পাশাপাশি ঢাকা মেট্রো নামে আরকটি দল দিয়ে আট দলের আসর করে থাকে। কিন্তু ময়মনসিংহ বিভাগ ন্যায্য দাবিদার হওয়ার পরও তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগ উপেক্ষিত থাকলেও ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পরিচালক পদ একটি করে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে যেখানে ক্যাটাগরি-১ থেকে পরিচালক ছিলেন ১০ জন, বর্তমানে সেখানে তিনজন বাড়িয়ে ১৩ জন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান বলেন, ‘আমার মনে হয় সিন্ডিকেটের কাজ এটা, যাতে ময়মনসিংহ বিভাগের কেউ ঢুকতে না পারে। ৩৩তম বোর্ডসভায় তখন আমি পরিচালক ছিলাম। রংপুর যখন বিভাগ হলো, তারা দরখাস্ত করল। তখন আমরা রংপুর বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করলাম। টিম হলো সাতটা। তখন টুটুল (বিসিবির সাবেক পরিচালক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল) সাহেব বললেন রেদওয়ান ভাই সাতটি টিমের খেলার ফরম্যাট তো ভালো হয় না, আটটি টিম নেন। তখন আমি আটটি টিম কাকে নেব? তিনি বললেন সিসিডিএমকে ধার হিসেবে নেন। পরে নতুন কোনো বিভাগ হলে সে বিভাগ ঢুকবে। সেটা রেজল্যুশন আকারেই আছে। কিন্তু ২০১৫ সালে বিভাগ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তারা ময়মনসিংহকে ঢোকায়নি আর সিসিডিএমকেও বাদ দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো ময়মনসিংহ বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা, কাউন্সিলরশিপপ্রধান, ময়মনসিংহ বিভাগে পরিচালক পদ সৃষ্টি করা।’ তিনি গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির আহ্বায়ক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সমালোচনা করে বলেন, ‘ফারুক (ফারুক আহমেদ) সাহেব সভাপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সব কাগজপত্র দিয়েছি যে ময়মনসিংহ বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি আমাদের জানালেন এটি করে দেবেন। কিন্তু হঠাৎ করে খসড়া গঠনতন্ত্র সংশোধনীতে দেখি ময়মনসিংহ বিভাগের নামই নেই। আর যিনি সংশোধনী করেছেন ফাহিম (নাজমুল আবেদীন ফাহিম) সাহেব কোনো ক্লাবের সঙ্গে জড়িত না, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গেও জড়িত না। উনি কারও মতামতও নেননি। উনি ওনার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় সংশোধন করেছেন।’
ময়মনসিংহের সন্তান জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেনও এ নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘আমরা আগের বোর্ডকে বলেছি। বর্তমান বোর্ডকেও অবহিত করেছি। ফাহিম ভাই ( নাজমুল আবেদীন ফাহিম) সবকিছু জানেন। প্রপার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে তার। কিন্তু তিনিও করেননি। উদ্দেশ্য কী বুঝলাম না? কিন্তু থাকবে না কেন? আমি হতাশ। বর্তমানে অনেক কিছুই নতুন করে হচ্ছে। ময়মনসিংহ বিভাগও যেন বিসিবির অন্তর্ভুক্ত হয় আমি এই দাবি জানাই।’
এ ব্যাপারে বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির আহ্বায়ক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘ আমরা তো এখনো জমাই দিইনি। বাইরে চলে আসায় আলোচনা হচ্ছে। বাইরে যে বিষয়টা এসেছে, আমি নিজেও দেখিনি।’ কিন্তু ময়মনসিংহ বিভাগ থাকবে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘থাকবে কি না এখনই বলতে পারছি না। সাবমিট করিনি। সাবমিট করার পর দেখতে পারবেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি এ মুহূর্তে বলতে পারব না।’