
পর্তুগালের রাজধানী থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে ফুনচালের মনোরম দ্বীপ মাদেইরা। সেখানেই জন্ম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। তার বাবার প্রিয় অভিনেতা ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। তার নামের সঙ্গে মিল রেখেই ছেলের নাম রেখেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
রোনালদোর শৈশবটা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তিন ভাইবোন থাকতেন ছোট্ট একটি কক্ষে। সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখতেন তারকা ফুটবলার হওয়ার। ছোটবেলায় রোনালদোর আদর্শ ছিলেন ব্রাজিলের রোনালদো ও রোনালদিনহো। ১২ বছর বয়সে যোগ দেন স্বদেশি ক্লাব স্পোর্টিং ক্লাবে। সে লক্ষ্যে একাই পাড়ি জমান লিসবনে। ফুটবলে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন রোনালদো। বাকিটা ইতিহাস।
স্পোর্টিং লিসবন থেকে স্যার আলেক্স ফার্গুসনের অধীনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পদার্পণ। ২০০৯ সালে রেকর্ড অর্থে রিয়াল মাদ্রিদে গমন। গোল আর নানা কীর্তি গড়া রোনালদো এরপর জুভেন্টাস ও ম্যানইউ ঘুরে এখন খেলছেন সৌদি ক্লাব আল নাসর। জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও একটি ইউরো জিতেছেন সময়ের এই তারকা ফুটবলার। গতকাল চল্লিশে পা দেওয়া রোনালদো এখনো যেন আগের মতোই টগবগে, অপ্রতিরোধ্য। চল্লিশে চালশে নয়, চিরায়ত এই প্রবাদ বাক্য ছুড়ে ফেলা সিআরসেভেনের চল্লিশতম জন্মদিনে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক রোনালদোর কীর্তিগাঁথা।
রেকর্ডস
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের মালিক রোনালদো (১৩৫)। তার পেছনে লিওনেল মেসি (১১২) ও ইরানের আলী দাঈ (১০৮)।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলার রোনালদো (২১৭)। এখনো খেলে যাওয়া ফুটবলারদের মধ্যে রোনালদোর কাছাকাছি কেবল মেসিই (১৯১)।
২১ বছর ১৩১ দিন বয়সে পর্তুগালের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপে গোল করেছিলেন রোনালদো (২০০৬ বিশ্বকাপ, ইরানের বিপক্ষে)।
৩৩ বছর ১৩০ দিন বয়সে স্পেনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সী হ্যাটট্রিকম্যান রোনালদো।
৪৭ ম্যাচে ৩৬ গোল করে বিশ্বকাপের ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনালদো। তার পরেই রবার্ট লেভানডোভস্কি (৩০)।
কাতার বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করে বিশ্বকাপের পাঁচ আসরে গোল করা প্রথম ফুটবলার রোনালদো।
রোনালদো বিশ্বকাপের ইতিহাসে তৃতীয় বয়স্কতম গোলদাতা (৩৭ বছর ২৯২ দিন)। তার চেয়ে বেশি বয়সে গোল করেছেন পেপে (৩৯ বছর ২৮৩ দিন) এবং রজার মিলার (৪২ বছর ৩৯ দিন)।
ইউরো ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
ইউরো ফুটবলে সর্বোচ্চ ১৪ গোলের মালিক রোনালদো। দ্বিতীয় স্থানে ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি (৯টি)
৪৫০ গোল করে রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। তার পরেই আছেন করিম বেনজেমা (৩৫৪) এবং রাউল (৩২৩)।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ ১৪০ গোলের রেকর্ড রোনালদোর। এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৭ গোল করার কীর্তিও তার দখলে।
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সাত গোলের রেকর্ড রোনালদোর।
রোনালদো পাঁচবার (আইএফএফএইচএস) বিশ্বের সেরা গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন। মেসি ও লেভানডোভস্কি জিতেছেন দুবার করে।
রোনালদো তার ক্যারিয়ারে রেকর্ড ৯২৩টি আনুষ্ঠানিক গোল করেছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লিওনেল মেসির গোল ৮৫০।
রোনালদোর উদযাপন
রোনালদো প্রথমবার ২০১৩ সালে তার বিখ্যাত ‘সিউউউ’ উদযাপন করেন, যা স্প্যানিশ ভাষায় ‘হ্যাঁ’ বলার একটি বিশেষ ভঙ্গি। এটি ক্রীড়াজগতের অন্যতম জনপ্রিয় উদযাপনে পরিণত হয়েছে।
ফিফা বর্ষসেরা
ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব রোনালদো জিতেছেন পাঁচবার (২০০৮, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৭)। তার ওপরে শুধু লিওনেল মেসি। আর্জেন্টাইন ফুটবলার এই পুরস্কারটি জিতেছেন আটবার।
খ্যাতি
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে মোট এক বিলিয়ন অনুসারী অর্জন করে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন রোনালদো।
ইনস্টাগ্রামে রোনালদোর অনুসারী সবচেয়ে বেশি (৬৩৮ মিলিয়ন)। তার পরই আছেন লিওনেল মেসি (৫০৪ মিলিয়ন), সেলেনা গোমেজ (৪২২ মিলিয়ন)।
ফেসবুকে রোনালদো ১৭১ মিলিয়ন লাইক নিয়ে সবচেয়ে পছন্দনীয় ব্যক্তি। দ্বিতীয় স্থানে আছেন শাকিরা (১২৩ মিলিয়ন)। এক্স (পূর্বে টুইটার) প্ল্যাটফর্মে রোনালদো ১১৫ মিলিয়ন অনুসারী নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছেন। তার আগে আছেন বারাক ওবামা (১৩১ মিলিয়ন) এবং ইলন মাস্ক (২১৬ মিলিয়ন)।
২০২৪ সালের আগস্টে চালু হওয়া রোনালদোর ইউটিউব চ্যানেল ‘ইউআর ক্রিশ্চিয়ানো’ মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অর্জন করে, যা ইউটিউবের ইতিহাসে দ্রুততম।
রোনালদো ফোর্বসের বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়কারী ক্রীড়াবিদদের তালিকায় চারবার (২০১৬, ২০১৭, ২০২৩ এবং ২০২৪) শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন। গত ১২ বছরে প্রতিবারই শীর্ষ তিনে অবস্থান ছিল তার।
ব্যক্তিগত জীবন
রোনালদোর মা মারিয়া ডোলোরেস একবার বলেছিলেন, ফুটবলার না হলে তার ছোট ছেলে হয়তো একজন রাজমিস্ত্রি হতেন।
রোনালদোর প্রিয় খাবার ব্রাস শৈলীর কড মাছ। এটি কড ফিশ, পাতলা কাটা আলু, পেঁয়াজ, ডিম, জলপাই এবং পার্সলে দিয়ে তৈরি।
রোনালদোর গাড়ির সংগ্রহ চোখ ধাঁধানো! তার কাছে প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলারের গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি বুগাট্টি সেন্টোদিয়েচি, যার দাম ৯ মিলিয়ন ডলার। এই গাড়ি বানানোই হয়েছিল মাত্র ১০টি।
রোনালদোর বোন কাটিয়া আভেইরো লাতিন পপ গায়িকা ছিলেন এবং এক সময় ‘Ronalda’ নামে পরিচিত ছিলেন।
রোনালদো যেসব পর্যটন গন্তব্য পছন্দ করেন সেগুলো হলো আলউলা, দুবাই, লন্ডন, মাদেইরা, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস এবং রেড সি।
তার গানের পছন্দ অনেক বৈচিত্র্যময়। তিনি হিপ-হপ, আরএন্ডবি, রেগেটন, সাম্বা, ল্যাটিন এবং ইলেকট্রনিক ড্যান্স মিউজিক শুনতে পছন্দ করেন।
রোনালদো তার প্রেমিকা জর্জিনা রদ্রিগেজকে ২০১৬ সালে প্রথম দেখেন, যখন তিনি গুচি স্টোরে একটি স্যুট কিনতে গিয়েছিলেন। সেই সময় জর্জিনা সেখানে শপ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্য ফেনোমেনন অব ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামে একটি সমাজবিজ্ঞান কোর্স পড়ানো হয়!
অবসরে রোনালদো পোকার এবং টেবিল টেনিস খেলতে, বিলাসবহুল ঘড়ি সংগ্রহ করতে, ডকুমেন্টারি ও সিরিজ দেখতে, টেনিস, এনবিএ ও ইউএফসি অনুসরণ করতে পছন্দ করেন।
উক্তি
বিগত বছরগুলোতে অনেক খেলোয়াড়কে ‘নতুন জর্জ বেস্ট’ বলা হয়েছে, কিন্তু এবারই প্রথম এটি আমার জন্য সত্যিকারের প্রশংসা।
-জর্জ বেস্ট, ১৮ বছর বয়সী রোনালদোর সম্পর্কে
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আমার চেয়ে অনেক ভালো। পরিসংখ্যানই তা প্রমাণ করে। তিনি ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়।
-জিনেদিন জিদান