
এটা যেন এক রকম অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দল নিজেদের সামর্থ্যের কথা না ভেবে সংবাদ সম্মেলনে বড় বড় বুলি ছাড়ে। ফাইনালে খেলবে, চ্যাম্পিয়ন হবে। পরে দেখা যাবে গ্রুপ পর্বই পার হতে পারেনি। আর পারলেও কোনো রকমে। এক সময় বাংলাদেশে দলের এ রকম কথায় ক্রিকেট প্রেমীরা আশাবাদী হয়ে উঠলেও এখন আর এসব কথাকে মোটেই আমলে নেন না। তারা বুঝে গেছেন এ সবই কথার কথা। অতীতের মতো এবারও চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত আগে বিভিন্ন অধিনায়কের বলা সব কথাকে পেছনে ফেলে এক কদম এগিয়ে বলেছেন চ্যাম্পিয়ন হবেন।তার মুখ থেকে বের হয়েছে, ‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে যাচ্ছি।’
এটা ঠিক একটা সময় বাংলাদেশ দল ওয়ানডে ক্রিকেটে বেশ অবস্থানে ছিল। কিন্তু তাও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো অবস্থানে ছিল না। এখনতো সেই অবস্থানের অবনমন হয়েছে। সর্বশেষ দুইটি ওয়ানডে সিরিজই তারা হেরেছে। তারপর আবার খেলতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে। যেখানে আবার ব্যাটাররা নেই ফর্মে। সবচেয়ে বাজে অবস্থানে আছে অধিনায়ক নিজেই। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে নাজমুল হোসেন শান্তর এই কথা বলার সারমর্ম কী? পরে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি একটু ঘুরিয়ে বলেন, ‘৮ দলই ডিজার্ভ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। সবাই কোয়ালিটি টিম। আমাদের দলের ঐ সামর্থ্য আছে আমি বিশ্বাস করি। সবাই এটাই চায় মনেপ্রাণে। বিশ্বাস করে সামর্থ্য আছে। আমাদের রিজিকে আল্লাহ কি লিখে রেখেছেন জানা নেই। আমরা মেহনত করছি। সততার সঙ্গে কাজ করছি। প্রত্যেকে বিশ্বাস করি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’ দলের সবার প্রতি তার আত্মবিশ্বাস আছে। তিনি বলেন, ‘ যে ১৫ জন স্কোয়াডে আছে সবাইকে নিয়ে খুবই খুশি ও আত্মবিশ্বাসী। যেই খেলবে একা ম্যাচ জেতাতে পারে, এই সামর্থ্য সবার আছে।’
এভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য থাকলে প্রতিটি ম্যাচ জেতাই তখন জরুরি হয়ে পড়ে। প্রথম টার্গেট থাকে সেমিফাইনালে যাওয়ার। চার দলের গ্রুপে অন্তত দুইটি ম্যাচ জেতা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এতে করে জয়ের জন্য দলের ওপর একটা বাড়তি চাপ পড়ে। কিন্তু অধিনায়ক মনে করেন এতে করে কোনো চাপ তৈরি হবে না। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বাড়তি চাপ মনে হয় না। বাড়তি চাপ কেউ অনুভব করবে না।’ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ম্যাচ জেতার সঠিক পরিকল্পনায় এগুতে হবে। নাজমুল হোসেন শান্ত তাও ঠিক করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আশা করছি ৩০০ + উইকেট হবে। এ ধরনের স্কোর করতে হবে আগে ব্যাট করলে। ডিফেন্ড করার ক্ষেত্রেও এমন রান লাগবে। দুবাইতে একেক সময় একেক রকম হয়। তাও আমার মনে হয় ২৬০-২৮০ এর ভেতরেই থাকবে। নির্দিষ্ট দিনে কত রান করা দরকার বা কত রানে আটকানো দরকার এসব এনালাইসিস করব। দলের পাশে এত রান জমা করতে হলে ব্যাটারাদের রান করতে হবে। কিন্তু সেখানেইতো ঘাটতি। টি-টোয়েন্টি খেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে যাচ্ছে। অধিনায়ক মনে করেন এটা কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, ‘ফরম্যাট অনুযায়ী একটু তো ভিন্নতা আছেই। তবে যেভাবে ব্যাটাররা খেলেছে, উইকেট ভালো ছিল, যে কন্ডিশনে খেলব এর চেয়ে হয়তো ভালো উইকেট থাকবে। প্রস্তুতি ভালো নিয়েছে ব্যাটাররা, লম্বা সময় খেলা জরুরি। ৫০-৬০ রানকে ১০০-১২০ করতে হবে। ম্যাচ সিনারিও প্র্যাকটিস হচ্ছে। প্রস্তুতির দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছি। হাতে আরও ৬-৭ দিন আছে, এই সময়ে আমরা আরও গুছিয়ে নিতে পারব।’ অথচ দুই দিন আগে এই নিয়ে আক্ষেপ করে গেছেন দলের কোচ ফিল সিমন্স। নাজমুল শান্ত-এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘কোচ এমন কিছু মিন করেছে মনে হয় না।’
একোতো বাংলাদেশ কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলেনি, প্রস্তুতি বলতে যা তা শুধু বিপিএলে। কিন্তু বাজে ফর্মের কারণে এই বিপিএলও খেলা হয়নি অধিনায়কের। এটাতো দলের জন্য অনেক বড় টেনশনের কারণ। কিন্তু নাজমুল হোসেন শান্ত এই না খেলাটাকে তার জন্য ‘ইতিবাচক’ হয়েছে বলে মনে করেন। দল থকে বাদ পড়ার পর তিনি নিয়মিত অনুশীলন করেছেন, ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,’ আলহামদুলিল্লাহ, বিশ্বাস করছি ভালো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব। ম্যাচ খেলতে পারিনি এখানেও ইতিবাচক দিক ছিল। নিয়মিত অনুশীলন করেছি। ফিটনেস নিয়েও কাজ করেছি। সব ঠিকঠাক থাকলে আশা করছি টুর্নামেন্ট ভালো যাবে।’ নিজেকে ফিরে পাওয়ার টনিক হিসেবে তিনি নিজের খেলা সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচটাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যে ম্যাচ খেলার পর ইনজুরির কারণে তিনি দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। ৭৬ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন। দলও জিতেছিল ৬৮ রানে। সিরিজে এসেছিল সমতা। পরে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছিল। নাজমুল বলেন, ‘লাস্ট ওয়ানডে ম্যাচে ভালো ইনিংস খেলেছিলাম আফগানিস্তানের সঙ্গে। গত বছর রান মোটামুটি করেছি তবে স্ট্রাইক রেট ওরকম আপ টু দা মার্ক ছিল না। আমি বিশ্বাস করি আমি এর চেয়েও ভালো ব্যাটার। ওয়ানডে ফরম্যাট ভালো যাচ্ছে। অনেক দিন পর ম্যাচ খেলব। এখানে ম্যাচ সিনারিও প্র্যাকটিস হচ্ছে, আজও হবে। সামনে প্র্যাকটিস ম্যাচও আছে। এই ফরম্যাট ছোট বেলা থেকে খেলি। এডজাস্টমেন্টে সমস্যা হয় না।’
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে গতবার সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। সেমিতে খেলার পেছনে সাকিব আল হাসানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নিউজিল্যান্ডের ২৬৫ রান তাড়া করতে নেমে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে সাকিব পঞ্চম উইকেট জুটিতে ২২৪ রান করে দলকে ৫ উইকেটে জিতিয়ে সেমিতে নিয়ে যান। সাকিব ১১৪ রান করে আউট হলেও মাহমুদউল্লাহ ১০২ রান করে অপরাজিত ছিলেন। এবারে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলার পেছনেও রয়েছে সাকিবের বিশেষখ অবদান। ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঐতিহাসিক ম্যাচটি না জিতলে বাংলাদেশকে দর্শক হয়ে থাকতে হতো। সেই ম্যাচে ইতিহাসে প্রথমবারের ম্যাথিউসের বিপক্ষে সাকিবের সেই বিখ্যাত টাইম আউট ঘটনা দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। ম্যাচে সাকিব বল হাতে ২ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৬৫ বলে ৮২ রানের ইনিংস। নাজমুলের সঙ্গেই তৃতীয় উইকেট জুটিতে করেছিলেন ১৪৯ বরে ১৬৯ রান। সেই সাকিবই নেই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। তাকে কী মিস করবেন অধিনায়ক। এ রকম প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েন নাজমুল। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্ন কেন করলেন আমি জানি না। অবশ্যই সাকিব ভাইকে মিস করব। থাকলে ভালো হতো। অনেকবার উত্তর পেয়েছেন। আমার মনে হয় না এক টুর্নামেন্টে যাওয়ার আগে এই প্রসঙ্গে বলা যৌক্তিক হবে। ঐ ম্যাচে ব্রিয়ালিয়ান্ট ব্যাটিং করেছেন। দলকে জেতাতে অনেক সহায়তা করেছে।’ সাকিবের পরিবের্ত যে যে দায়িত্ব পাবে সেই সাকিবের রোল প্লে করবে বলে জানান নাজমুল। সাকিবের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার না থাকলেও মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগাতে চান। তরুণ ক্রিকেটারদের মাঝে বিলিয়ে দিতে চান।