
তহবিল বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালে নকআউট ট্রফি বা মিনি বিশ্বকাপের (পরে হয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে। কালের আবর্তে তা হারিয়ে যেতে বসেছিল। ১৯৯৮ সালে নকআউট ট্রফি কিংবা মিনি বিশ্বকাপ নাম দিয়ে শুরু হয়েছিল এই আসরের। আইসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী র্যাঙ্কিংয়ের সেরা ৮ দল নিয়ে প্রতি ২ বছর পর এ আয়োজন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫টি আসর। কিন্তু ২০০৮ সালে আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আয়োজক ছিল পাকিস্তান। নিরাপত্তার কারণে আসর স্থানান্তরিত হয়ে একবছর পিছিয়ে ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরের আগেই আইসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এরপর থেকে ৪ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৩ ও ২০১৭ সালে পরবর্তী দুটি আসর (সপ্তম ও অষ্টম) অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আইসিসি এটিকে বাক্সবন্দি করে ফেলে।
২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অষ্টম আসর শেষ হওয়ার পর আইসিসি যখন এই ইভেন্ট বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন তাদের ইভেন্ট ছিল চারটি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ছাড়াও ছিল ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বাদ দেওয়ার পেছনে আইসিসি যুক্তি দেখিয়েছিল তিন ফরম্যাটেই একটি করে আসর অনুষ্ঠিত হবে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ৫০ ওভারের ম্যাচ হওয়াতে ওয়ানডে বিশ্বকাপসহ ৫০ ওভারের আসর দুটি হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই খড়গ পড়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ওপরই। আইসিসির এই সিদ্ধান্তের পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সিলগালা লাগানো হয়ে যায়। কিন্তু ২০২১ সালে আইসিসি আবার সিদ্ধান্ত নেয় এই আসর আয়োজনের। তার পরই নবম আসর আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয় বর্তমান চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানে। তারপর সিলগালা খুলে আবার আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় থাকে। প্রায় ৮ বছর পর যার অবসান ঘটতে যাচ্ছে আজ করাচিতে স্বাগতিক পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে। দিবা-রাত্রির ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায়।
২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিষিদ্ধ হয়েছিল। আইসিসির কোনো ইভেন্ট তো দূরের কথা, দ্বিপক্ষীয় কোনো সিরিজ খেলতেও কোনো দল যেতে রাজি হয়নি। ফলে পাকিস্তানকে খেলতে হয় পরবাসী ক্রিকেট। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ে পাকিস্তান সফরে গিয়ে ভয়ের শঙ্কা দূর করে। কিন্তু তার পরও দলগুলোর ভীতি কাটেনি। এ সময় পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাতে আইসিসিও বেশ উদ্যোগী হয়ে ওঠে। পরীক্ষামূলকভাবে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্ব একাদশের ৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ আয়োজন করে। পাকিস্তান জয়ী হয়েছিল ২-১ ম্যাচে। একমাত্র ইংল্যান্ড (রাজনৈতিক কারণে ভারত এমনিতেই পাকিস্তান যেত না) সফর ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে বাকি দেশগুলোর ক্রিকেটারদের দিয়ে সাজানো হয়েছিল বিশ্ব একাদশ। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ৩টি ম্যাচই খেলেছিলেন তামিম ইকবাল। এরপর ধীরে ধীরে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো পাকিস্তান গিয়ে খেলতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভেন্যু করে পাকিস্তান। এর ফলে দীর্ঘ ২৯ বছর পর পাকিস্তানে আইসিসির কোনো ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পাকিস্তানে আইসিসির সর্বশেষ ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেবার পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ আয়োজক ছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। দীর্ঘ বিরতির পর পাকিস্তান এবার স্বাগতিক হলেও সেখানে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সেই স্বাদ নিতে পারছে না তারা। এর কারণ ভারত। রাজনৈতিক বৈরতার কারণে পাকিস্তান গিয়ে খেলতে রাজি হয়নি ভারত। তাদের চাওয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইসিসি ভারতের সব ম্যাচ সংযুক্ত আরব আমিরাতে করার সিদ্ধান্ত নেয়। যে কারণে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে এবারই প্রথম হাইব্রিড মডেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর ফলে পাকিস্তান স্বাগতিক হওয়ার পরও থেকে যাচ্ছে অপূর্ণতা! সেটা এমনই যে, ভারতের বিপক্ষে (২৩ ফেব্রুয়ারি) গ্রুপ পর্বে তাদের ম্যাচ খেলতে হবে দুবাইয়ে। এমন কি ভারত সেমিফাইনাল, পরে ফাইনালে উঠলে তাদের প্রতিপক্ষকে দুবাইয়ে খেলতে হবে। ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ হয়ে পাকিস্তান উঠলেও দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল। ভারত ফাইনালে উঠতে না পারলে সে ক্ষেত্রে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে লাহোরে।
২০২৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেরা ৮ দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের আসর। খেলবে দুই গ্রুপে। ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড, ‘বি’ গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তান। আফগানিস্তান খেলছে প্রথমবারের মতো। দুই গ্রুপের সেরা ৪ দল খেলবে সেমিফাইনালে। এরপর ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল। দুই দেশের চারটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে খেলাগুলো। ভেন্যু চারটি হলো পাকিস্তানের করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। মোট খেলা ১৫টি। গ্রুপ পর্বে ৬টি করে ১২টি। এরপর ২টি সেমিফাইনাল, পরে ফাইনাল।
২৯ বছর পর আইসিসির ইভেন্ট আয়োজনের সুযোগ পেয়ে স্মরণীয় করে রাখতে বদ্ধপরিকর পিসিবি। উদ্বোধনী ম্যাচের আগে দর্শকদের মন ভরাতে রাখা হয়েছে ব্যতিক্রমী আয়োজন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) প্রদর্শন করবে মন ভোলানো বিখ্যাত শেরদিল অ্যারোবেটিকস কারুকাজ দেখাবে। এর সঙ্গে জিএফ -১৭ থান্ডার, এফ-১৬ ফাইটার জেটসহ বিশেষ কিছু যুদ্ধবিমানও আকাশে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবে। পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে এবার সেখানে থাকবে ভিন্নতা।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগের ৮ আসরের মাঝে একমাত্র অস্ট্রেলিয়াই পরপর দুবার (২০০৬ ও ২০০৯) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ভারতও দুবার (২০০২ ও ২০১৩) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তবে ২০০২ সালে তারা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এ ছাড়া একবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৯৮), নিউজিল্যান্ড (২০০০), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০৪) ও পাকিস্তান (২০১৭)।
একদিকে প্রায় ৮ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরু হতে যাচ্ছে, আবার পাকিস্তানে বসছে ২৯ বছর পর। কিন্তু মাঠে গড়ানোর আগেই তারকা ক্রিকেটার হারানোর মিছিল শুরু হয়েছে। ইনজুরিতে পড়ে একে একে ছিটকে পড়েছেন ভারতের বুমরা, পাকিস্তানের সাইম আইয়ুব, অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্স, জস হ্যাজেলউড, মিচেল মার্শ, দক্ষিণ আফ্রিকার নর্টজে, কোয়েটজা, আফগানিস্তানের আল্লাহ ঘাজানফার, ইংল্যান্ডের জ্যাকব বেথেল। সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ফার্গুসন। এদের না থাকাটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য অনেকটা তারকা ঘাটতির শামিল।