
১৯৯৬ সাল। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বেনজির ভুট্টোর হাত থেকে বিশ্বকাপের ট্রফি নিচ্ছেন শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। ছবিটি লঙ্কানদের কাছে অনেক গর্বের। সফল আয়োজক হিসেবে এই ছবির জন্য গর্বিত পাকিস্তানও। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লাহোরের সেই ফাইনালের স্মৃতি বিষাদেরও জন্ম দেয় দেশটির জন্য। কারণ এরপর নানা কারণে বিশ্বকাপ দূরে থাক, আইসিসির কোনো ইভেন্টই আর আয়োজন করতে পারেনি পাকিস্তান। অবশেষে দীর্ঘ ২৯ বছর পর আইসিসির ক্রিকেট উৎসবের আবীর মাখতে চলেছে পাকিস্তান। আজ থেকে পাকিস্তানের মাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ধুন্ধুমার আসর।
১৯৯৬ থেকে ২০০৯, ১৩ বছরে আইসিসির মোট ১১টি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে (ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি)। অথচ এর মধ্যে একটিরও আয়োজক স্বত্ব পায়নি পাকিস্তান। অথচ এশিয়ার তিন দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ ঠিকই কোনো কোনো আসরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। নিয়ম অনুযায়ী ২০০৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে। কিন্তু নিরাপত্তা ইস্যুতে ছেদ পড়ে সবকিছু। একবছর পর ২০০৯ সালে সেই টুর্নামেন্ট আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। একই বছর পাকিস্তানের জন্য ছিল আরও ভয়াবহ। অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এমনিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আয়োজক স্বত্ব খোয়া গেছে, কোথায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার হবে, ঘটল উল্টো ঘটনা। লাহোরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটারদের বহনকারী বাসে হামলা চালায় বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা। যে ঘটনায় পাকিস্তানের ছয়জন পুলিশ ও দুই বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন শ্রীলঙ্কার ছয় ক্রিকেটার। ন্যক্কারজনক এ ঘটনার পর বিশ্বক্রিকেট থেকে প্রায় এক ঘরে হয়ে যায় পাকিস্তান। সেই ঘটনার বরফ গলতে লেগে যায় প্রায় এক যুগের বেশি সময়। দীর্ঘদিন পর সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও ভারত রয়ে গেছে আগের অবস্থানেই। নিরাপত্তা ইস্যুতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই যেমন পাকিস্তানে যাচ্ছে না রোহিতরা। তারা সব ম্যাচ খেলবে দুবাইয়ে। তার মানে পাকিস্তানে দীর্ঘ তিন দশক পর ক্রিকেট উৎসবের আবহে ফিরলেও গলার কাঁটা হিসেবে রয়ে গেল ভারত।
অথচ পাকিস্তানে ক্রিকেট শুধু একটি খেলা নয়, এটি একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে, যা জাতি, খেলোয়াড় ও ক্রিকেটভক্তদের মধ্যে এক অটুট সম্পর্ক তৈরি করেছে। করাচির ধোঁয়া-মাখা গলি থেকে শুরু করে লাহোরের ক্রিকেটীয় চর্চার নীরব শ্রদ্ধায়, ক্রিকেট দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় পরিচয়ের একটি প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সময়ের অবাধ দাপটে অপরিবর্তিত রয়েছে।
তবুও প্রায় ৩০ বছর ধরে পাকিস্তান ক্রিকেটের বৃহৎ মঞ্চ থেকে বঞ্চিত। ১৯৯৬ সালের উইলস ওয়ার্ল্ড কাপের পর থেকে দেশটি আর কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বকে তার হৃদয়গ্রাহী ভূখণ্ডে স্বাগত জানাতে পারেনি। অপেক্ষাটা ছিল দীর্ঘ। কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, কখনো খেলার বাইরের পরিস্থিতি দ্বারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর তাই আজ থেকে শুরু হওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কেবল একটি টুর্নামেন্টই নয় বরং একটি হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের সুযোগ।
ভারত তাদের ম্যাচ অন্যত্র খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হাইব্রিড তকমা পাচ্ছে টুর্নামেন্টটি। যার পেছনে দায়ী আসলে দুই দেশের বিরূপ কূটনৈতিক সম্পর্ক। এটি স্বাগতিক পাকিস্তানের জন্য তীব্র হতাশার। ক্রিকেট তার অপরিবর্তিত রূপে, রাজনীতি এবং কূটনীতির চেয়েও বড়। কিন্তু ক্রিকেট আজ কূটনৈতিক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এমন বিভাজন অবশ্যম্ভাবী। ক্রিকেট হোক উপভোগের, বিবাদ বা দ্বন্দ্বের নয়, এমন রীতিতেই হাঁটতে চায় দেশটি।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। নিরাপত্তা থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় সজাগ দৃষ্টি রয়েছে তাদের। আজ থেকে করাচির জাতীয় স্টেডিয়াম আবারও ক্রিকেটের উন্মাদনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। পাকিস্তান এখন একটি নতুন রূপে রূপান্তরিত। অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে স্টেডিয়ামগুলো সেজেছে নতুন সাজে। সব মিলিয়ে করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডি শহরগুলোতে এক নতুন আশার বাতাস বইছে। একটি জাতি আবারও তার ক্রিকেটের গল্প ফিরে পাচ্ছে ক্রমশ।
পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি নিশ্চিত করেছেন পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টের জন্য কতটা প্রস্তুত এবং রোমাঞ্চিত। এটিকে জাতির জন্য এবং তাদের ক্রিকেটপ্রেমী জনগণের জন্য ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫ পাকিস্তানে ২৯ বছর পর ফিরছে। এই টুর্নামেন্ট শুধু ক্রিকেট নয়, এটি পাকিস্তানের আতিথেয়তা এবং আবেগের এক অভূতপূর্ব প্রদর্শনী।’
লাহোর কেল্লাকে নির্বাচন করা হয়েছে টুর্নামেন্টের মশাল প্রজ্জ্বলিত করার জন্য। যার মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক এবং ক্রিকেটীয় রূপের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে নাকভি বলেন, ‘এই জায়গা শুধু পাকিস্তানের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেই প্রতিনিধিত্ব করে না বরং দেশের ক্রিকেটের ঐতিহ্যকেও প্রতিফলিত করে। প্রতিটি স্টেডিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকবে দর্শকে, এই দায়িত্ব পাকিস্তানের জনগণের। ক্রিকেট হোক উপভোগের মন্ত্র।’