
হামজা চৌধুরী আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। তবে আগে এসেছিলেন নীরবে, একজন সাধারণ যুবক হিসেবে। এবার তিনি এসেছেন মহা ধুমধামে, তারকাখ্যাতি নিয়ে। তাকে বরণ করে নিতে সেকি তোড়জোড়! ঢাকঢোল বাজিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে তাকে স্বাগত জানানো হয় বাংলার জমিনে।
ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটির এই তারকা ফুটবলার এবার পৈতৃক ভিটায় এসেছেন ২০১৩ সালের পর।
হামজা চৌধুরী এখনো জাতীয় দলের হয়ে খেলেননি। কিন্তু না খেলার আগেই তাকে নিয়ে যে রকম মাতামাতি আর হইচই হচ্ছে অতীতে আর কোনো ফুটবলারকে নিয়ে এ রকমটি হয়েছে কি না সন্দেহ। এর কারণ আর কিছুই নয়, একে তো বাংলাদেশের ফুটবলের ক্রমাবনতি, সেখানে ইংলিশ লিগে খেলা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলা যেন আঁধার ঘরে পূর্ণিমার চাঁদ। তাই তো তাকে বরণ করে নিতে এত সাজসাজ রব। উৎসবের আমেজ। ঢাকা থেকে বাফুফের কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রতিনিধিদল সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির ফুলের তোড়া নিয়ে। শুধু কী তাই! ঢাকার প্রায় সব টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিরাও সেখানে গিয়ে উপস্থিত। সিলেট থেকে তারা সরাসরি সম্প্রচার করছেন। আবার আরেক প্রতিনিধিদল হামজার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবলের স্নানঘাট গ্রামে গিয়ে হাজির। আর সাধারণ ক্রীড়ামোদীরা তো হামজাকে নিয়ে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট অবতরণের অনেক আগে থেকেই বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির। সেখানে তারা হামজা-হামজা জয়ধ্বনি করেছেন। এভাবেই এখন বাংলাদেশ হামজাজ্বরে আক্রান্ত।
ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠা হামজা চৌধুরী স্নানঘাটের কাঁচা রাস্তা, পরিচিত মাঠ, আর শৈশবের স্মৃতিজড়ানো মাটিতে পা রাখতেই যেন পুরো গ্রাম তাকে বরণ করে নেয় রাজকীয় উপায়ে। ছোট-বড়, বৃদ্ধ-যুবক সবাই হামজাকে একনজর দেখতে ভিড় জমান। গ্রামের মানুষের উচ্ছ্বাস, বাঁশি-ঢোলের শব্দ আর ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হামজা যেন ফিরে পেলেন তার শিকড়ের টান।
ইংল্যান্ডে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হলেও হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করেন হামজা। ছোটবেলা থেকেই দেশের মাটি, খেলার মাঠ ও সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল গভীর টান। তাই তো তিনি এখন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়ানোর অপেক্ষায়। ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অবসান হবে তার সেই চাওয়ার।
হামজার জন্ম ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর লেস্টারশায়ারের লফবোরোতে। ৭ বছর বয়সে তিনি লেস্টার সিটি একাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেন। ফুটবলের প্রতি তার প্রতিভার বিকাশ সেই বয়সেই দেখা যায়। হামজা চৌধুরীর বাড়িতে ছোটবেলা থেকে নিয়মিত আসতেন দুলা মিয়া। তিনি বলেন, ‘হামজার বয়স ছিল তখন ৫ বছর, আর আমার ১৬-১৭। কিন্তু তখনই আমাদের চেয়ে তার কিকে গতি অনেক বেশি ছিল। আমরা তার ফুটবল খেলার স্টাইল দেখে আফসোস করতাম। তার কিকে প্রচণ্ড শব্দ হতো এবং টিনের বেড়ায় পড়লে চ্যাপ্টা হয়ে যেত।’
লেস্টার সিটির একাডেমিতে তালিম নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন হামজা। ২০১৬ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি এক মাসের চুক্তিতে ঋণে তিনি লিগ ওয়ানে বার্টন আলবিয়নের হয়ে খেলেন। সে দিনই তার অভিষেক হয় পিরেলি স্টেডিয়ামে। ওয়ালসলের বিপক্ষে ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। তিনি নেমেছিলেন বদলি হিসেবে ম্যাচের ৭৭ মিনিটে। প্রিমিয়ার লিগেও তার অভিষেক হয় বদলি হিসেবে ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর টটেনহ্যাম হটস্পায়ারের বিপক্ষে। কোচের ক্লোদি জ্যাক পুয়েলের তালিম নিয়ে খেলতে নেমে ম্যাচে হামজার দল জয়ী হয়েছিল ২-১ গোলে। প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচের শুরু থেকে তিনি খেলেন পরের বছর। বার্নালির বিপক্ষে ১৪ এপ্রিল সেই ম্যাচ তার দল হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে। ২০২০ সালে এই ক্লাবের হয়ে তিনি চার বছরের চুক্তি করেন।
৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার হামজা লেস্টার সিটির যুব দলে খেলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। প্রতিভার জানান দিয়ে তিনি ইংল্যান্ড জাতীয় যুব (অনূর্ধ্ব-২১) দলে সুযোগ করে নেন ২০১৮ সালে। চীনের বিপক্ষে তার অভিষেক হয় বদলি হিসেবে। ইংল্যান্ড জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। ২০১৯ সালে উয়েফা অনূর্ধ্ব-২৩ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ইংল্যান্ড দলে জায়গা করে নেন। কিন্তু এই আসরে তার যাত্রা বেশি দূর হয়নি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে একটি বিপজ্জনক ফাউলের কারণে তাকে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। এ বছরই তিনি জানিয়েছিলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চান। কিন্তু সেটি ছিল তার জন্য অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ। ক্রমেই সেই আশা ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এরই মাঝে তার পিতা দেওয়ান মুর্শেদ চৌধুরী তাকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় হামজাও ধীরে ধীরে নিজের মনস্থির করে নেন লাল-সবুজের জার্সি পরে খেলার। তারপর ফিফার দীর্ঘ নিয়ম-কানুন মেনে অবশেষে তিনি বাংলাদেশের হয়ে খেলার অপেক্ষায়।
হামজার বেড়ে ওঠা নিয়ে তার পিতা দেওয়ান মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘হামজার জন্ম ও বেড়ে ওঠা লন্ডনে। তবে ছোটবেলা থেকে আমি তাকে দেশে নিয়ে আসতাম। সে এখানে এসে গ্রামের সাধারণ শিশু-কিশোদের সঙ্গে খেলাধুলা করত। এখন পর্যন্ত তাকে আমি ৮-১০ বার দেশে নিয়ে আসছি। তখন সে দীর্ঘদিন গ্রামে থেকেছে। গ্রামের পরিবেশে থাকতে সে খুব পছন্দ করত। হামজা ছোট থেকেই বেশ মেধাবী। আমরা তাকে ছোটবেলা থেকেই ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিকতাসহ গড়ে তুলেছি। সে লন্ডনের একটি স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। নিয়মিত নামাজ-রোজা পালন করে সে।’
হামজা চৌধুরীর চাচা দেওয়ান গোলাম মাসুদ বলেন, ‘পরিবার তাকে দেশ সম্পর্কে অনেক বেশি ধারণা দিয়েছে। যে কারণে ছোটবেলা থেকেই সে বাংলাদেশি যুবকদের মতো জীবনযাপন করত, পোশাক পরত। গ্রামে এলে এখানকার ছেলেদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিলেমিশে ঘোরাফিরা, খেলাধুলা করত। যে কারণে এত বছর পর দেশে ফিরেই সে প্রথমে গ্রামে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশীয় মাছ, মাংস এবং শাকসবজি খেতে পছন্দ করে। যে কারণে সে দেশে এলে বাড়িতে এসব খাবার রান্না হতো।’
হামজা চৌধুরীর বাড়িতে ছোটবেলা থেকে নিয়মিত আসতেন দুলা মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে খুব দুষ্টুমি করতাম। ছোটবেলাতেই তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে ধরে ওপরে তুলে ফেলতাম। তখন সে চেয়ে থাকত, আর হাসত। শেষে আমরা একসঙ্গে বাড়ির পুকুরে গোসল করতাম। আমাদের সঙ্গে হামজা এমনভাবে চলত, মনেই হতো না লন্ডনে সে বসবাস করে।’
হামজার ফুফাতো ভাই রাসেল চৌধুরী বলেন, ‘হামজা ছোটবেলা বাড়িতে এলে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসত। আমি তাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ছোটবেলায় সে বেশ শান্ত ছিল। তবে দৌড়ে প্রচণ্ড গতি ছিল। তখনই আমাদের মনে হতো সে বড় হলে ভালো ফুটবল খেলতে পারবে।’
ইংল্যান্ডের ফুটবল তারকা হামজা চৌধুরী, যিনি লেস্টার সিটির জার্সি গায়ে বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়িয়েছেন। দীর্ঘ এক দশক পর ফিরলেন নিজের পৈতৃক ভিটায়। তবে এবার আর সেই সাধারণ গ্রাম্য যুবক নন, এলেন এক নতুন পরিচয়ে- সাফল্যের শীর্ষে থাকা একজন কিংবদন্তি ফুটবলার হিসেবে।