
একটাই অনুরোধ করব সবাইকে, ‘আমাকে মনে রাইখেন মানে ভুলে যাইয়েন না।’ এই ছোট্ট কথাটা নিশ্চয়ই সবাই মনে করতে পারছেন। ২০২৩ বিশ্বকাপের দলে নিজের নাম প্রত্যাহারের কারণ জানাতে করা তামিম ইকবালের ভিডিওবার্তার শেষ কথা এটা।
১২ মিনিট ১০ সেকেন্ডের সেই ভিডিওবার্তা তামিমের ফেসবুকে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ দল ভারতের প্লেন ধরার পরই। তামিম নিজেকে বাকিদের মনে জায়গা করানোর যেই আকুতিটা জানিয়েছিলেন তা নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু সেই সমালোচকরাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন তামিমের অনুরোধ মেটাতে।
হার্ট অ্যাটাক থেকে লাইফ সাপোর্ট, বিকেএসপির আকাশের কালো মেঘ এসে ভর করে ক্রিকেটপাগল দেশটার কোটি মানুষের মনেও। জীবন ও যমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা তামিমের জন্য গণমানুষের হৃদয়ের আকুতিতেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা এই যাত্রায় ফিরিয়ে দিয়েছেন ওয়ানডে দলের সাবেক অধিনায়ককে। তীব্র সমালোচকদের মনটাও ভারী হয়েছে সাবেক অধিনায়কের অসুস্থতার খবরে।
পেশাদার ক্রিকেটার তামিম ইকবালের জনপ্রিয়তা ও অর্থের ঘাটতি নেই। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, মনুষ্যত্ব। সেটিও তার মাঝে আছে ঢের বেশি। এই তো তামিমের লাইফ সাপোর্টের খবরেই একে-একে সেই মনুষ্যত্বের খবর সামনে আসতে শুরু করে। কবে কার হার্টে রিং পরানো ব্যয়ভার তামিম বহন করেছেন। কিছুদিন আগে দাবার প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার ছেলের পাশে দাঁড়ানো, জাতীয় দলের লেগস্পিনার আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের বাবার হৃদরোগের চিকিৎসায়ও ছিল তামিমের অবদান। করোনাকালীন সময়ে যখন কোনো হাসপাতালে সিট পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সহযোগিতার হাতটা এই তামিমই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
জনপ্রিয়তায় আড়াল হয় মানুষের মানবিক গুণাবলি, এমন একটা অভিযোগ সমাজে প্রচলিত আছে। তামিম যেন বাস্তব জীবনে ঠিক তার উল্টো। শত জনপ্রিয়তাও তার বিনয়ে চিড় ধরাতে পারেনি একটুও। এই বিনয়টাই বোধহয় তামিমের প্রতি মানুষের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। যে উদ্বেগ এসেছে দেশ ছাড়িয়ে সীমানার ওপার থেকেও।
দেশসেরা ওপেনারের দুঃসময়ে শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা, দিমুথ করুণারত্নে ভারতের দুই সাবেক যুবরাজ সিং ও মনোজ তিওয়ারি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই তালিকায় আছেন দেশটির ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলেও। এসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব ও আইপিএলের কলকাতা নাইট রাইডার্স ফ্র্যাঞ্চাইজিও সুস্থতা কামনা করে তামিমের।
মাঠে ও মাঠে বাইরে যেকোনো ক্রিকেটার আলোচিত ও সমালোচিত দুটোই হয়ে থাকেন। শুধু ক্রিকেটার নন, যেকোনো পেশার মানুষই এমনটার আওতাভুক্ত। এটি তো পেশাগত জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসবকে মিলিয়ে জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। ভারসাম্য বজায়ে কিছুটা এদিক-ওদিক হলেই অনেক উজ্জ্বল সম্পর্কই হয়ে পড়ে মলিন।
সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের সম্পর্কটার কথাই ভাবুন। সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্বটাও ফিকে হয়ে গিয়েছিল সময়ের পরিক্রমায়। যেই সাকিব বিশ্বকাপের আগে তামিমের উন্মুক্ত সমালোচনা করেছিলেন টিভিপর্দায়, তিনিই নিজের জন্মদিনের সেরা উপহার হিসেবে তামিমের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। আর তাতেই সাকিব প্রমাণ করলেন বন্ধুত্ব কখনোই ফুরায় না। বিপদেই তো বন্ধুর পরিচয়। কলকাতা নাইট রাইডার্স ও ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে খেলার সময় তো একাধিকবার সাকিব ‘বেস্টফ্রেন্ড’ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন।
হার্ট অ্যাটাকের ঘটনায় তামিম শুধু জীবন নয়, ফিরে পেয়েছেন নিজের হারিয়ে ফেলা বন্ধুত্বটাও। বন্ধুহীন জীবনের কোনো অর্থ নেই। সবকিছুই ভালোর জন্য হয়- কথাটা মিলে যাচ্ছে তামিমের বেলায়। হাসপাতাল থেকে মাঠের ক্রিকেটে তামিম ফিরুক আর নাই ফিরুক, নিজের হারিয়ে ফেলা বন্ধুত্বটা ফিরে পাওয়া নিয়ে তামিম নিশ্চিতভাবেই পুলকিত হবেন। সব খারাপেরও তো কিছু ভালো আছে। তাকে নিয়ে বন্ধু সাকিবের উদ্বেগ তো সেটারই ইঙ্গিত করে।
তামিম সুস্থভাবে ফিরে আসুক। এসে জানুক তার কথা সবাই রেখেছে। সবাই তাকে মনে রেখেছিল নিজ নিজ প্রার্থনায়। লর্ডসের শতক উদযাপনের চেয়েও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা ও সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসার এই মুহূর্তটাই হয়তো তামিমের জীবনের বিশেষ প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।