২৪ জুন, ১৯৮৭। এক উষ্ণ দুপুরে রোসারিওর আকাশে ফুটেছিল এক ফুটবল-নক্ষত্রের জন্মরং। তিন যুগ পেরিয়ে আজ তিনি ৩৮। যিনি শুধু একজন ফুটবলার নন। তিনি ইতিহাস, তিনি সময়ের মহাকাব্য। তিনি কি কেবল বয়সে বন্দি এক ফুটবলার? না, তিনি এক আবেগের নাম, এক বিপ্লবী। এক চিরন্তন কবিতা, যিনি সময়কে থমকে দিয়েছেন বাঁ পায়ের জাদুতে।
বাঁ পায়ের কেরামতি। সেটা অপার্থিব নাকি মায়াবী বিভ্রম। কেউ বলে ঐশী দক্ষতা, কেউবা অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা। সবুজ গালিচায় সর্পিল গতিতে তার আঁকাবাঁকা চলা মুগ্ধতার রেণু ছড়ায়। সঙ্গে ওলটপালট হয় রেকর্ড বুক। কত গোল, কত ট্রফি, কত কীর্তি, রোসারিও থেকে বার্সেলোনা, টিস্যু পেপারে সাইন করা থেকে ভুবন মাতানো এক ফুটবলার- লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
শুরুটা ছিল তীব্র লড়াইয়ের। ছোটবেলায় গ্রোথ হরমোনের অভাবে খর্বকায় শিশু মেসিকে কেউ ভাবেনি বিশ্ব কাঁপাবে। কিন্তু বার্সেলোনায় সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল চুপিচুপি, যেন কোনো গীতিকাব্যের প্রথম লাইন।
২০০৪ সালে ক্লাব ফুটবলে অভিষেক, এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। অনেক শিরোপা, কত্ত ব্যালন ডি’অর। তার গোলের সংখ্যা কাঁড়ি কাঁড়ি, রেকর্ডের খাতা যেন ফুরোচ্ছে না কিছুতেই। তবুও একটা অপূর্ণতা ঘিরে ছিল তাকে, তাও একটানা প্রায় এক যুগ।
একটি বিশ্বকাপের জন্য কত হাপিত্যেশ ছিল মেসির, তা সবারই জানা। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ১৯৯০, মেসির কাঁধে চড়ে ২০১৪। দুই বিশ্বকাপের ফাইনালেই জার্মান মেশিনে বিকল হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর দুবার কোপা আমেরিকার খেতাব মিস। পেনাল্টি মিসে সূর্যাস্ত। অভিমান-দুঃখে অবসরও নিয়েছিলেন মেসি। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘জাতীয় দলে আর না।’
তবে শেষ সেখানেই নয়। হেরে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে যারা চ্যাম্পিয়নের সরণিতে ফিরে আসেন, তারাই প্রকৃত লিজেন্ড। মেসিও যেমন তাই। মেসির সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছিল কোপা মিসে। কিন্তু তিনিই তো মেসি-পুনর্জন্ম যার আরেক নাম। ২০২১ সালে মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে পেলেন প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি, কোপা আমেরিকা। সেই জয় ছিল শুধুই শিরোপা নয়, ছিল জীবনের দিকে নতুন করে প্রত্যাবর্তন।
তারপর কাতার ২০২২, মেসির মহাকাব্যিক অর্জন। ৩৫ বছর বয়সে খেললেন স্বপ্নের মতো। গোল করলেন, অ্যাসিস্ট দিলেন, নেতৃত্ব দিলেন, উদযাপন করলেন নিজের মতো করে। আর শেষ পর্যন্ত হাতে তুললেন সোনালি ট্রফিটা।
‘মেসি ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেছে’, এই বাক্যটা হয়ে রইল এক সমাপ্তি-রহিত আনন্দের নাম। এরপরও থামেননি। পিএসজি ছেড়ে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়, ইন্টার মায়ামিতে। অনেকেই ভেবেছিল, এবার বুঝি বিদায়ের ঘণ্টা বাজবে। কিন্তু না, তিনি এখনো স্বতঃস্ফূর্ত, চঞ্চল, প্রাণবন্ত। আরও একটি কোপা আমেরিকা জিতেছেন এর মাঝে, যেন বলে দিচ্ছেন- ‘আমি এখনো শেষ হইনি।’
জীবন নামের বহতা নদীতে চিরস্থায়ী দুঃখ বলে কিছু নেই। কোন এক রাঙা ভোরে সব হতাশা, গ্লানি, অপ্রাপ্তি, কলঙ্ক উবে যায় প্রখর স্বর্ণালি সাফল্যে। ঐতো সূর্য, ঐটাই সাফল্য। জীবন বারবার ফিরে আসার স্ক্রিপ্ট তৈরি করার সুযোগ দেয়, সাহসের সঙ্গে যে গ্রহণ করতে পারে তিনিই দিগবিজয়ী, তিনিই কিংবদন্তি; তিনিই লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
সেই কিংবদন্তি এখন তাকিয়ে আছেন ২০২৬ বিশ্বকাপের দিকে। মেক্সিকো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হবে সেই প্রতিযোগিতা। এটাই হবে তার শেষ নাচ। আর যদি সেই মঞ্চেও আসে জয়ের ধ্বনি, তবে তিনি হবেন চিরন্তন পূর্ণতা। দুটি বিশ্বকাপ, অগণিত গোল, অজস্র সাফল্যের স্মৃতি- একজন মানুষ, এক মহাকাব্য।
মেসি চিৎকার করেন না, বিতর্কে জড়ান না। তার পায়ের ভাষাই তার উত্তর, তার চোখের আলোই তার আবেগ। আজ তার জন্মদিনে শুধু ‘শুভ জন্মদিন’ বললে অত্যুক্তি হবে। বরং বলা ভালো, ‘ধন্য এ সময়, যে সময়ে আমরা দেখেই যাচ্ছি লিওনেল মেসির খেলা।’
আমি সুখী, কারণ সব বাদ দিয়ে আমি ফুটবল খেলতেই চেয়েছি। আমি যেহেতু খেলতে ভালোবাসি, এটা আমার কাছে ‘কাজ’ মনে হয় না। এখনো সেই একই রকম আনন্দ নিয়ে খেলি, যেভাবে সেই ছোট্টবেলায় খেলতাম -লিওনেল মেসি
মেসি হলো একটি প্রতিভা। সে সবকিছু। আমি যখন তাকে দেখি, তখন আমার ম্যারাডোনার কথা মনে হয় -ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্মানি কিংবদন্তি
মেসিকে নিয়ে কিছু লিখো না। তাকে বর্ণনা করার চেষ্টাও করো না। শুধু তার খেলা দেখো এবং উপভোগ করে যাও -পেপ গার্দিওলা