
২০১৮ সাল। রাশিয়ার মস্কোতে চলছিল ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়ার ফাইনাল। মাঠে উপস্থিত ছিলেন ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস। ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। দুজনের সাক্ষাতে তারা একে অপরকে বুকে জড়িয়ে নেন। ম্যারাডোনা আব্বাসকে বলেন, ‘হৃদয় থেকে আমি ফিলিস্তিনি।’
ম্যারাডোনা ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের প্রতি তার সহানুভূতিও প্রকাশ করেন। সেই সাক্ষাতের একটি মুহূর্ত ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছিলেন ফুটবল ঈশ্বর। ছবিতে ছিলেন আব্বাস এবং ক্যাপশনে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘আমি একজন ফিলিস্তিনি। এই ব্যক্তি (আব্বাস) ফিলিস্তিনে শান্তি চান। রাষ্ট্রপ্রতি আব্বাস তার রাষ্ট্রের মালিক।’ যার পায়ের ফুটবলে সারা বিশ্ব নাচত, সেই ম্যারাডোনার মুখের বাণী আব্বাসের জন্য ছিল পরম পাওয়া। ম্যারাডোনাকে জলপাইয়ের ডাল বহনকারী একটি ঘুঘুর চিত্র উপহার দেন, যা শান্তির প্রতীক।
দেখা হয়েছিল বলেই আবেগে বলে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা- বিষয়টা মোটেও এমন নয়। জীবদ্দশায় তিনি দীর্ঘকাল ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১২ সালের কথা। তখন তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। সেই সময় ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ নিজেকে ফিলিস্তিনি জনগণের এক নম্বর সমর্থক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। নিজেকে ফিলিস্তিনি বলার একবছর পর ম্যারাডোনা ক্যাফায়া পরিধান করে আবারও সমর্থন জানান এবং বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন দীর্ঘজীবী হোক।’
২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের আক্রমণের পর ম্যারাডোনা সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা করছে তা লজ্জাজনক।’ তার সাহসী এই প্রতিবাদের জন্য ইসরায়েলি দখলদারত্বের অধীনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনদের জন্য ম্যারাডোনা ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা। একদা ফিলিস্তিন এক সাংবাদিক র্যামজি বারুদ বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনে, আপনি ম্যারাডোনাকে ঘৃণা করতে পারবেন না। তাকে ভালোবাসবেন এবং তার সম্পর্কে খারাপ তর্ক করতে পারবেন না।’
বারুদ আরও বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনা আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। একজন মানুষ যিনি বড় ছিলেন না, বস্তি থেকে এসেছিলেন, আমাদের মতোই আবেগপ্রবণ ছিলেন এবং তারপর তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত হওয়ার পথ খুঁজে পেলেন। আমাদের কাছে এটি কেবল ফুটবল বা একটি খেলার সময়, এটি একটি আশা। কারণ, এটি অনুপ্রেরণা দেয় যে সবকিছুই সম্ভব। আপনি কল্পনা করতে পারেন না যে ম্যারাডোনা যখন ফিলিস্তিনের প্রতি যত্নশীল হন এবং আমাদের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করেন তখন আমরা কতটা খুশি হই। মনে হয়, আমাদের আনন্দ পূর্ণতা পেয়েছে।’
ম্যারাডোনা, ফিলিস্তিন এবং উপনিবেশবাদকে এক সুতোয় গাঁথা হয়েছে দ্য হ্যান্ড অব গডে। বিশেষ এক প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে ‘সমাজতান্ত্রিক ম্যারাডোনা কীভাবে তার ঈশ্বরের হাতে তার আদর্শিক অর্থ’। উপনিবেশবাদ বলতে একটি দেশ কর্তৃক অন্য একটি দেশের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে বোঝায়। আর ম্যারাডোনা ছিলেন উপনিবেশবাদের প্রধান শত্রু। এমনকি তার বিখ্যাত ঈশ্বরের হাতের গোলটি ছিল আর্জেন্টিনায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
মেক্সিকোতে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ‘ঈশ্বরের হাত’ (ইংরেজিতে ‘দ্য হ্যান্ড অব গোল’) গোলটি করেছিলেন ম্যারাডোনা। এমির কুস্তুরিকা, যিনি ম্যারাডোনা (২০০৮) নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে প্রকাশ করেন যে এই গোলটি ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। কুস্তুরিকার ভাষ্য অনুযায়ী, ম্যারাডোনা এই গোলটিকে উপস্থাপন করেছিলেন ব্রিটেনের ১৯৮২ সালে মালভিনাস দ্বীপপুঞ্জে হামলার সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ হিসেবে।
ম্যারাডোনার জন্য, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই শুধুই ফুটবল মাঠের বিষয় নয়, এটি তার জন্য একান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল। ম্যারাডোনা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ছাপ আর্জেন্টিনায় ঘৃণা করতেন, যা তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ গোলটিকে ইংল্যান্ডের মালভিনাস দ্বীপপুঞ্জ ‘চুরি’ করার প্রতিক্রিয়ায় প্রাপ্ত প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। উপনিবেশবিরোধী এই মনোভাব ম্যারাডোনার হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে ছিল। কারণ ১৯ থেকে ২০ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটেন আর্জেন্টিনায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
তখন অন্যান্য উপনিবেশবাদের মতো, ব্রিটিশরা আর্জেন্টিনায় এসেছিল দেশের সব সম্পদ শোষণ করতে: রেলপথ, ব্যাংক, ডক, দোকানপাট, এমনকি সংস্কৃতিও। ইতিহাসবিদ ডেভিড ডাউনিং এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করত, শুধু নামটা ছাড়া।’ তার জীবনকালে যখন ফিলিস্তিনে উপনিবেশবাদ হয়ে ওঠে ইসরায়েল, তখন ম্যারাডোনা হয়ে যান ফিলিস্তিনি। কারণ সব ফিলিস্তিনির মতো দখলদারত্ব ছিল তার প্রধান শত্রু।