
মাত্র ২০ মিনিটের হেরফের। আর তাতেই অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেল বাংলাদেশের দুই ক্রিকেটার রিশাদ হোসেন ও নাহিদ রানা এবং দুই ক্রীড়া সাংবাদিক তাসফিক পোলক ও মাহরুস হাসান প্রত্যয়। শুধু বাংলাদেশের এই চারজনই নন, একই সঙ্গে প্রাণে বেঁচে গেছেন একই বিমানে থাকা ডেবিড ওয়ার্নার, কেন উইলিয়ামসন, কাইল জেমসন, শন অ্যাবটের মতো আরও অনেকে। সময়ের হিসেবে মাত্র ২০ মিনিট। একটু এদিক-সেদিক হলেই এদের সবাইকে প্রাণ হারাতে হতো! এদের নিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে মুলতান হয়ে দুবাইর উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিমান ছেড়ে যাওয়ার ২০ মিনিট পর সেখানকার নুর আলী খান বিমানঘাঁটিতে ভারত মিসাইল আক্রমণ করে। আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিমানঘাঁটি। আর কিছুক্ষণ বিলম্ব হলে রিশাদদের বহনকারী বিমানও হামলার শিকার হতে পারত! খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ রকমই জানিয়েছেন ক্রিকফেঞ্জির সাংবাদিক তাসফিক পলক।
৬ মে মঙ্গলবার রাতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পাকিস্তানে চলছিল পিএসএল। এবারের পিএসএলে বাংলাদেশ থেকে দুই ক্রিকেটার রিশাদ হোসেন ও নাহিদ রানা প্রথমবারের মতো খেলছিলেন। এমন কি বিদেশি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরেও তাদের প্রথম খেলা ছিল। পিএসএল কাভার করতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন ক্রিকফ্রেঞ্জির তাসফিক পোলক ও বিডি ক্রিকটাইমের মাহরুস হাসান প্রত্যয়।
আক্রমণের পরদিন ৭ মে বুধবার যথারীতি পিএসএলের সূচি অনুযায়ী রাওয়ালপিন্ডিতে কোয়েটা গ্লাডিয়েটর্স ও ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের পিএসএলে রাওয়ালপিন্ডিতে এটিই ছিল প্রথম খেলা। পিএসএলের সূচি অনুযায়ী একটি ভেন্যুতে টানা কয়েক দিন খেলা হয়। সেই হিসেবে রাওয়ালিপিন্ডিতে খেলা ছিল ১০ মে পর্যন্ত। যে কারণে বাংলাদেশের দুই ক্রিকেটারের খেলা থাকায় তারাও সেখানে ছিলেন। যথারীতি বাংলাদেশের দুই সাংবাদিকও ছিলেন সেখানে। ৮ মে করাচি কিংসের বিপক্ষে খেলা ছিল নাহিদ রানার দল পেশোয়ার জালমির। পরের দিন আবার নাহিদ রানার দলের বিপক্ষে খেলা ছিল রিশাদের দল লাহোর কালান্দার্সের। কিন্তু ৭ মে নাহিদ রানার দলের খেলা শুরুর আগে দুপুর ১২টার দিকে রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের সন্নিকটে ভারত ড্রোন হামলা চালায়। এতে করে তাৎক্ষণিভাবে পিসিবি রাওয়ালপিন্ডির সব ম্যাচ স্থগিত করে দেয়। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করে তাসফিক পোলক বলেন, ‘সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। খেলা রাতে। আমরা বের হওয়ার চিন্তা করছিলাম। বেলা ১২টার দিকে ড্রোন হামলা হয়। পরে আমরা আর বের হইনি। পুলিশ যেখানে হামলা হয়েছে, সেদিকে কাউকে যেতে দিচ্ছিল না। পরে জেনেছি প্রায় ২৫টির মতো ড্রোন হামলা হয়েছে।’
পিসিবি প্রথমে রাওয়ালপিন্ডির ম্যাচ, পরে গোটা পিসিএলেরই অবশিষ্ট ম্যাচ স্থগিত করে। প্রথমে দুবাইতে আয়োজনের কথা বললেও পরে তারা সেখান থেকে সরে এসে আপাতত স্থগিত করে দেয়। স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর বিদেশি ক্রিকেটারদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে পিসিবি। এদিকে বিসিবিও তাদের দুই খেলোয়াড়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের দুই সাংবাদিককেও ফিরিয়ে আনার জন্য পিসিবির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করতে থাকে। যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান থেকে কোনো বিমান ছেড়ে যাচ্ছিল না। পরিস্থিতি বুঝে মাঝে মাঝে দুই/একটি বিমান উড়াল দিচ্ছিল। পরে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে সব বিদেশি পাকিস্তান ছাড়বেন। তারা রওয়ানা দেবেন নুর আলী খান বিমানবাহিনী ঘাঁটি থেকে। প্রথমে যাবেন মুলতান। সেখান থেকে আরও কিছু বিদেশি ক্রিকেটার তাদের যাত্রা পথে সঙ্গী হবেন। যথারীতি তারা বিমানে উঠে মুলতান হয়ে দুবাই গিয়ে পৌঁছান শনিবার ভোরে।
রাওয়ালপিন্ডি নুর আলী খান বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে হামলার খবর প্রথমে জানতে পারেন রিশাদ হোসেন। তিনি এ ঘটনা জানতে পারেন মুলতানে যাওয়ার পর। কিন্তু সঙ্গীদের টেনশন মুক্ত রাখার জন্য তখন আর কাউকে কিছু বলেননি। দুবাই যাওয়ার পর ঘটনাটা তিনি সবাইকে বলেন। সেই সময়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তাসফিক পোলক বলেন, ‘আমি জানতাম যে বিমান সরাসরি দুবাই যাবে। বিমানে উঠার প্রায় ১ ঘণ্টা পর যখন ঘোষণা দেওয়া হয় মুলতান বিমানবন্দরে অবতরণ করবে, তখন বুঝতে পারি মুলতান হয়ে যাব। সেখানে বিদেশি ক্রিকেটারদের একটা ম্যাচ ছিল। তাদের নিতেই মুলতানে বিমান অবতরণ করে। মুলতান যাওয়ার পর রিশাদ রাওয়ালপিন্ডির বিমানঘাঁটিতে হামলার খবরটি জানতে পারে। কিন্তু তিনি আমাদের কাউকে কিছু বলেনি। অথচ আমরা পাশাপাশি বসে এসেছি। হয়তো আমরা টেনশন করব এ জন্য বলেননি। দুবাইতে নামার পর যখন জানতে পারলাম, তখন রীতিমতো আমার হাত-পা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। যে ভয়টা আমি রাওয়ালপিন্ডি থাকতে পাইনি, সেই ভয় আমি দুবাইতে এসে পেয়েছি। শুধু আমি না এ ঘটনা জানার পর আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি।’