
পঞ্চগড়ের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বনগ্রামের দরিদ্র মেয়ে ফেরদৌসি আক্তার সোনালী। বাবা ভ্যানচালক। কিন্তু তিনি এখন আর শুধু ভ্যানচালকের কন্যা নন, বাংলাদেশেরও কন্যা। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গর্বিত সদস্য। রক্ষা করেন গোলপোস্ট। দারিদ্র্য, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বর্তমানে তিনি জাতীয় দলের সঙ্গে অবস্থান করছেন জর্ডানে।
সোনালীর বেড়ে ওঠা দেশের শেষ প্রান্তের জেলা পঞ্চগড় সদর উপজেলার বনগ্রামে। তার বাবা ফারুক ইসলাম পেশায় একজন ব্যাটারিচালিত ভ্যানচালক, মা মেরিনা বেগম একজন গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সোনালী সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি তার প্রবল টান থাকলেও পারিবারিক আর্থিক অনটন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সোনালীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর হাঁড়িভাসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ এবং মাঠে পারফরম্যান্স নজরে পড়ে স্থানীয় টুকু ফুটবল একাডেমির। এর পরই শুরু হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের যাত্রা। ২০২৩ সালে সোনালী ভর্তি হন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। বর্তমানে তিনি নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং বিকেএসপিতে গোলরক্ষক হিসেবে পেশাদার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তার নিষ্ঠা, প্রতিভা এবং পরিশ্রমের পুরস্কারস্বরূপ জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে।
মেয়ের এমন অর্জনে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তার বাবা ফারুক ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়ের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল। অনেকেই নানা কথা বলত, আমিও মাঝেমধ্যে নিষেধ করেছি। কিন্তু সে থামেনি। খেয়ে না খেয়ে অনুশীলনে যেত। আজ সে দেশের হয়ে বিদেশে খেলছে- এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ।’ সোনালীর মা মেরিনা বেগম বলেন, ‘মেয়ের খেলা নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে, কিন্তু আমরা সব সময় তাকে উৎসাহ দিয়েছি। আজ সে জাতীয় দলে খেলছে। আমরা বিশ্বাস করি, সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।’
সোনালীর ফুটবল যাত্রার পথপ্রদর্শক টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ‘সোনালী খুব পরিশ্রমী ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়। আমি সব সময় জানতাম সে বড় কিছু করবে। তার এই অর্জন শুধু আমাদের একাডেমির নয়, পুরো পঞ্চগড়ের গর্ব।’
জাতীয় নারী দলের আরেক গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমও পঞ্চগড়ের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামের বাসিন্দা। তিনিও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন একই একাডেমিতে। এ বিষয়ে হাঁড়িভাসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইয়েদ নূর-ই-আলম বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের দুটি গ্রামের দুই মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে, এটা শুধু গর্বের বিষয় নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীকও। সোনালীর এই অর্জন শুধু তার একার নয়, এটি প্রমাণ করে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে যদি সুযোগ পায়, তাহলে সেও দেশের গর্ব হতে পারে।’