
দেশের ফুটবলে মঙ্গলবার ছিল ঈদের দিনের মতোই। ঈদকে সামনে রেখে যেমন অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে থাকে। নতুন নতুন জামা-কাপড় কেনা, মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের ম্যাচকে ঘিরে তেমনই এক পরিবেশ তৈরি হয়। গতকালের ম্যাচকে সামনে রেখে টিকিটের জন্য দৌড়ঝাঁপ, অনলাইনে টিকিট কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়া, সেখানে যারা টিকিট পাননি, তারা টিকিটের জন্য বিভিন্ন জনের কাছে ধরনা দেন। এখানেও কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হয়েছেন হতাশ। এটিতো গেল শুধু টিকিটের পর্ব। প্রায় সাড়ে ৪ বছর মেরামত করে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামকে তৈরি করা হয়েছে নববধূর সাজে।
এদিকে এই ম্যাচকে সামনে রেখে বাফুফে নেয় ব্যাপক প্রস্তুতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। সব মিলিয়ে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম ও এর আশপাশ এলাকা ছিল শুধুই ফুটবলময়। ফুটপাত ছিল পরিষ্কার। বাফুফে আগেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল দর্শকদের জন্য গেট উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বেলা ২টায়। কিন্তু তারও অনেক আগে থেকেই দর্শকদের লম্বা লাইন। ঢাকার ফুটবল মানেই কিশোর-যুবক-তরুণ অর্থাৎ পুরুষদের উপস্থিতি। সেখানে গতকাল ছিল চোখে পড়ার মতো মেয়েদের উপস্থিতি। সর্বত্রই ছিল একটি উৎসবমুখর পরিবেশ। এমন পরিবেশ ঢাকার ফুটবলের স্বর্ণযুগেও ছিল না, যখন আবাহনী-মোহামেডানের টানে দেশ দুই ভাগ হয়ে যেত, ঘরের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে চলত তুমুল বাদানুবাদ। তবে গতকাল কোনো বিবাদ ছিল না। সবাই ছিলেন এক বিন্দুতে মিলিত। লাল-সবুজের সমর্থক।
বাংলাদেশের ফুটবলে দর্শকদের এই জোয়ার বলা যায় হঠাৎ করেই, যার শুরুটা হয় ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। আর এর কারিগর ছিলেন হামজা নামে এক বাঁশিওয়ালা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ ফুটবলারই সবার মনে নতুন করে ঝড় তুলেন। যে ঝড়ের ঢেউ ক্রমেই বেড়েছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি শিলংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৫ মার্চ। দেশের বাইরে ম্যাচ হওয়ার পরও সেই ম্যাচ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে সে কী আগ্রহ। হামজার চোখধাঁধানো ফুটবলশৈলী সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। দুর্দান্ত খেলে বাংলাদেশ ম্যাচটি ড্র করেছিল। তখন থেকেই সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে আগ্রহের মাত্রা বেড়ে যায়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গতকাল।
ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে ক্রিকেট চলে যাওয়ার পর গতকালকের আগে যেকোনো ধরনের ম্যাচকে সামনে রেখে এভাবে স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হতে দেখা যায়নি। স্টেডিয়ামে সম্পূর্ণ চেয়ার বসানোর কারণে আসন সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। ১৮ হাজার ৩০০ গ্যালারি টিকিট অনলাইনে বিক্রির জন্য ছাড়া হয়েছিল। ভিআইপি মিলিয়ে মোট আসন সংখ্যা ছিল প্রায় ২১ হাজারের মতো। কিন্তু আসন সংখ্যা পূর্ণ হওয়ার পরও প্রচুর দর্শক দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছেন। তারা মাঠে প্রবেশ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার মূল গেট ছিল চারটি। এক একটি গেটের লাইনের শেষ প্রান্ত দেখা যায়নি। বায়তুল মোকাররম প্রান্তে ছিল ৪ নম্বর গেটের প্রবেশপথ। এই পথের লাইনে দৈনিক বাংলা ছাড়িয়ে রাজউক অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলে যায়। লম্বা লাইন হলেও সবাই ছিলেন শৃঙ্খলাবদ্ধ। কোনো রকমের হুড়াহুড়ি করতে দেখা যায়নি। সবাই সারিবদ্ধভাবেই প্রবেশ করেন। এর মধ্যে এক পসরা বৃষ্টি হলেও কেউ লাইন ছেড়ে যাননি। বৃষ্টিতে ভিজে তারা প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ দর্শকদের মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বুঝা যায় বাংলাদেশ, ফুটবল দলের সমর্থক গোষ্ঠী আলট্রাসের অনেক সদস্য নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে জোর করে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ায়। তারা সবাই অবশ্য ঢুকতে পারেননি। তার আগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে অনেককে বের করে দেন। তারা বাফুফের কাছে টিকিটি চেয়েও পাননি। কয়েকদিন বাফুফে ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সব সময় যখন গ্যালারি ফাঁকা থাকত, তখনো স্টেডিয়ামে আলট্রাসের সদস্যরা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলোয়াড়দের উৎসাহ জোগাতেন।
ফুটবল খেলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ বিগত সময় ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো ম্যাচ স্টেডিয়াম অনেকটা ফাঁকাই থাকত। কাল অনেকেই এসেছেন প্রথমবারের মতো। এমনই কয়েকজন এসেছিলেন ধানমন্ডিতে থেকে। জাভেদ, মিনহাজ, হারিস, আসলাম প্রথমবার এসে খুবই আনন্দিত। তারা ফুটবল খেলা পছন্দ করেন। সব সময় ইউরোপের খেলা দেখে থাকেন রাত জেগে। তাদের আসার কারণ হামজা চৌধুরী। খবরের কাগজকে জানালেন জয় দিয়েই তাদের অভিষেক হবে। ফুটবলের এই জোয়ারটা বজায় থাকবে। নিয়মিত আসবেন খেলা দেখতে। বসুন্ধরা থেকে বাবার সঙ্গে এসেছে ১২-১৩ বছরের আইমান। ফুটবল তার প্রথম পছন্দ। নিজেও খেলে ফুটবল। হামজাকে তার খুব ভালো লাগে। তার খেলা সামনাসামনি দেখতেই বাবার কাছে মাঠে যাওয়ার বায়না ধরে। খেলাপাগল ছেলের আবদার রাখতে বাবাও সঙ্গী হন আইমানের। মগবাজার থেকে আসেন নাইমুল, ফাইয়াজ ও ইশরা। ইশরা প্রথমবার এসেছেন। বাকি দুজন ২০১৮ সালে সর্বশেষ এসেছিলেন। ইশরা এসেছেন সখের বশে। ক্রিকেট খেলা দেখতেও তিনি মাঠে গিয়ে থাকেন। নাইমুল বলেন, ‘আমি এক সময় নিয়মিত এই মাঠে ফুটবল খেলা দেখেছি। সর্বশেষ এসেছিলাম ২০১৮ সালে। অনেক দিন পর আবার আসলাম। আগামীতেও নিয়মিত আসব।’
খেলা দেখতে এসেছিলেন বিসিবির পরিচালক মাহবুব আনাম, মঞ্জুরুল আলম। সঙ্গে ছিলেন আরও বেশ কয়েকজন। ভিআইপি ১ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়েও তারা পারেননি। এ সময় আলট্রাসের সদস্যরা বিক্ষোভ করেছিলেন। পরে ২ নম্বর গেট দিয়েও গাড়ি নিয়ে ঢুকতে না পেরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। গাড়ি পাঠিয়ে দেন মোহামেডান ক্লাবে।