
গাজা, লেবানন থেকে ইরান পর্যন্ত ছড়িয়েছে ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ। তারই বিরূপ প্রভাব পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ক্রীড়াঙ্গনে। অনেক ক্রীড়াবিদ আটকে পড়েছেন, আবার কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন বিমান হামলায়। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে হারিয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, প্রতিভা ও সাংস্কৃতিক চেতনাও। কারণ যুদ্ধ শুধু মানুষের জীবন নয়, তাদের আশা, পরিচয় ও ভবিষ্যতকেও ধ্বংস করে দেয়।
মৃত্যুর সঙ্গে বসত তারেমির
ইরানি ফরোয়ার্ড মেহেদি তারেমি। ইন্টার মিলানের তারকা ফুটবলার। তিনি আটকা পড়েছে জন্মভূমিতে। খেলা হচ্ছে না ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে। আকাশপথের যুদ্ধে ইরান তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই ৩২ বছর বয়সী স্ট্রাইকার তেহরান ছাড়তে পারছেন না। ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পর সব ফ্লাইট স্থগিত হয়ে যায়। এরপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে পূর্ণমাত্রার সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে, যেখানে রকেট ও বিমান হামলা পাল্টাপাল্টি চালানো হচ্ছে।
মেহেদি তারেমি এখন পরিবারসহ বাড়িতেই আটকে আছেন। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তারেমির ক্লাব ইন্টার মিলান ইতালিতে অবস্থিত ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে সান্ত্বনা দেওয়া এবং একটি সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, যদিও বর্তমানে তা প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে নিরাপদ স্থানে রয়েছেন এবং বোমা হামলার ঝুঁকি থেকে নিরাপদে আশ্রয়ে আছেন।’ গত সোমবার নিজের ইনস্টাগ্রামে তারেমি একটি স্টোরি পোস্ট করেন, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইরানকে একা থাকতে দিন।’
ক্লাব বিশ্বকাপে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ক্লাবগুলোও অংশ নিচ্ছে, যেমন- আল আহলি (মিশর), এসপেরান্সে দে তিউনিস (তিউনিসিয়া), ওয়াইদাদ কাসাব্লাঙ্কা (মরক্কো) এবং আল-আইন (সংযুক্ত আরব আমিরাত)। যুদ্ধের ছায়া যেমন মাঠের বাইরে তারেমিদের আটকে রেখেছে, তেমনি মাঠের ভেতরে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দলগুলো বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে সম্মানজনক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই টুর্নামেন্টে তাদের জন্য পথ সহজ নয়- প্রতিটি ম্যাচই যেন বেঁচে থাকার লড়াই, ঠিক যেমনটা হচ্ছে মাঠের বাইরের বাস্তবতায়।
মাঠে ও পথে প্রাণ যাচ্ছে ক্রীড়াবিদদের
১৩ জুন তেহরানে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিল এক কিশোর তায়কোয়ানদো শিক্ষার্থী ও একজন উদীয়মান প্যাডেল খেলোয়াড়। সামরিক স্থাপনার বাইরেও বিস্তৃত এই হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে বসতবাড়ি ও পারিবারিক এলাকা। এতে বহু বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আমির আলি আমিনি, ফার্স প্রদেশের তায়কোয়ানদো অ্যাসোসিয়েশন যাকে ‘একজন অঙ্গীকারবদ্ধ তরুণ শিক্ষার্থী’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তেহরানের শহিদ চামরান নোবোনিয়াদ কমপ্লেক্সে হামলায় এই কিশোর প্রাণ হারায়। তার বাবা রেজা আমিনি, গুরুতর আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মারা যান। প্রাণঘাতী হামলায় নিহত হন ২০ বছর বয়সী প্যাডেল খেলোয়াড় পারসা মনসুর, যিনি ইরানের উদীয়মান তরুণ প্রতিভাদের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হতেন। ইরান টেনিস ফেডারেশনের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই তরুণ খেলোয়াড় নিহত হন অনুশীলন শেষে বাসায় ফেরার পথে।’
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে- রাজনৈতিক সংঘাত শুধু সীমান্তে নয় বরং খেলাধুলার মতো আশার ক্ষেত্রগুলোতেও তরুণ-সম্ভাবনাময়দের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
২৭৩টির বেশি ক্রীড়া অবকাঠামো ধ্বংস, ৭০০-এর বেশি ক্রীড়াবিদ নিহত
গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ফিলিস্তিনি জাতীয় ভলিবল দলের অধিনায়ক আহমেদ আল-মুফতি। তিনি হচ্ছেন শত শত ক্রীড়াবিদের মধ্যে একজন, যারা ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধের মধ্যে নিহত হয়েছেন। আল-মুফতি জাবালিয়া ইয়ুথ ক্লাবের হয়েও খেলতেন এবং ফিলিস্তিনি ভলিবলে ছিলেন অন্যতম পরিচিত মুখ। ফিলিস্তিনি স্পোর্টস মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (পিএসএমএ) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত ৭০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদ নিহত হয়েছেন এবং নিহতদের মধ্যে অন্তত ৯৫ জন শিশু ক্রীড়াবিদ।
ফিলিস্তিনি জাতীয় ভলিবল দলের অধিনায়ক আল-মুফতির মৃত্যুর পর আরও দুই ক্রীড়াবিদের মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে। তারা হলেন হ্যান্ডবল কোচ আহমাদ হারুন ও খেলোয়াড় আনাস আল-দেবজি। চলতি বছরের শুরুতে পৃথক দুটি হামলায় তারা নিহত হন। হারুন নিহত হন নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে তার নিজ বাড়িতে চালানো গোলাবর্ষণে, আর আল-দেবজি প্রাণ হারান যখন একটি বিমান হামলায় দেইর আল-বালাহতে তার বাড়িতে আঘাত হানে।
ফিলিস্তিনি স্পোর্টস মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (পিএসএমএ) জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধের কারণে গাজার অন্তত ২৭৩টি ক্রীড়া অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্টেডিয়াম, জিমনেসিয়াম এবং ক্রীড়া ক্লাবের ভবন।