কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নিরাপদ ব্যবহার ও নীতিমালা নির্ধারণে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাকশন সামিট’-এ বিশ্বনেতা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা একত্রিত হয়েছেন। গতকাল সোমবার থেকে শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী এআই সামিটের মূল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে আজ।
এ সম্মেলনে একদিকে যেমন এআই প্রযুক্তির বিকাশে বাধা হতে পারে এমন কঠোর নীতিমালা আরোপ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি বিশ্ব নেতা ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির ঢেউকে আলিঙ্গন করার আগ্রহও দেখা যাচ্ছে।
২০২২ সালে ওপেনএআইয়ের চ্যাটবট ‘চ্যাটজিপিটি’ প্রকাশের পর আগের ব্রিটেন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এআই শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে বিশ্বশক্তির মনোযোগ প্রযুক্তির ঝুঁকির দিকে কেন্দ্রীভূত হলেও, বর্তমানে এআইকে নিয়ন্ত্রণে আনার আগ্রহ কিছুটা কমেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রশাসনের এআই নীতিমালা বাতিল করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা দেশটির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে এগিয়ে নিতে সহায়ক বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও এআই নিয়ে নমনীয় নীতি গ্রহণের পথে হাঁটছে।
ইইউ সম্প্রতি ‘এআই অ্যাক্ট’ নামে নীতিমালা অনুমোদন করেছে, যা বিশ্বের প্রথম এআই বিধিমালা। তবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ও কয়েকটি দেশ এর কঠোর প্রয়োগ চায় না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ মনে করেন, অত্যধিক নিয়মনীতি ইউরোপীয় স্টার্টআপগুলোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এক সাক্ষাৎকারে মাখোঁ বলেন, ‘কিছু দেশ কোনো নিয়ম মানতে চায় না, যা বিপজ্জনক। আবার ইউরোপ যদি অতিরিক্ত নিয়ম তৈরি করে, তবে সেটিও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। উদ্ভাবনকে ভয় পাওয়া উচিত নয়।’
এআই নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। চীনের এআই প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক সম্প্রতি এমন এক এআই চ্যাটবট উন্মোচন করেছে, যা এআই প্রযুক্তির বাজারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউস জানিয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র এআই নীতিতে অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অন্যদিকে চীন নতুন সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। ফলে বিশ্বজুড়ে একটি অনিশ্চিত প্রতিযোগিতা চলছে।’
তবে যুক্তরাষ্ট্র এবারের সম্মেলনে ‘এআই সেফটি ইনস্টিটিউট’ পাঠাচ্ছে না, যা বৈশ্বিক এআই ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী নীতিমালা তৈরির আশা কমিয়ে দিয়েছে।
প্যারিস সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, চীনের ভাইস প্রিমিয়ার ঝাং গুওকিংসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। অন্যদের মধ্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোটাকিসও উপস্থিত থাকবেন।
প্রযুক্তি জগতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অংশ নিচ্ছেন এ সম্মেলনে, যাদের মধ্যে রয়েছেন গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই ও ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান। তারা প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করবেন।
এআইয়ের জন্য বিশাল জ্বালানি চাহিদা ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়েও সম্মেলনে আলোচনা হবে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এআই প্রযুক্তিকে কীভাবে টেকসই রাখা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
ফ্রান্স ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি বড় এআই ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে, যেখানে ৫০ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হবে। নতুন এআই অ্যাপ চালুর সময় ফরাসি স্টার্টআপ মিস্ট্রালের সিইও বলেছেন, ‘এখন বিশ্ব বুঝতে পারছে, ইউরোপীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও এআই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন এআইয়ের বিপজ্জনক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ভাবনকে এগিয়ে নেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজছে। এআইয়ের নীতিনির্ধারণে কঠোরতা নাকি নমনীয়তা প্রয়োজন, এ নিয়ে চলছে বিতর্ক। প্যারিস সম্মেলন কি নতুন কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারবে? সেটাই দেখার বিষয়। তথ্যসূত্র: রয়টার্স