আমি রফিকুজ্জামান আকিব। সর্বপ্রথম একজন পাঠক, অতঃপর সৃজনশীল লেখক, সূক্ষ্ম পর্যালোচক, খুদে সংগঠক, বই সংগ্রাহক এবং পরিশেষে বাংলা সাহিত্যের বিস্তার লাভের জন্য পাঠক তৈরিতে লেগে থাকা একজন সাধারণ বইপ্রেমী। বই নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ধরনের কাজ করি। বর্তমানে খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছি। প্রথম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থাতেই আমি বই পড়া শুরু করি। এখনো নিয়মিত পড়ে চলেছি। সাত বছরে এক হাজারের বেশি বই পড়েছি।
আমি প্রিয় লেখকদের বই পর্যালোচনা করতে ভীষণ ভালোবাসি এবং একই সঙ্গে বই পর্যালোচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে ভালোবাসি। আমি বই পর্যালোচনা করি চতুর্থ শ্রেণি থেকে। মজার বিষয় হলো আমি এখন পর্যন্ত যে কয়টি বই পর্যালোচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি প্রত্যেকটায়ই কিছু না কিছু পুরস্কার পেয়েছি। আমি অধিকাংশ বই মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেই বইগুলোর লেখাগুলোকে মননে স্থান দিয়ে খুব নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করি। আমি অধিকাংশ সময় লিখিত পর্যালোচনা করে থাকি, মাঝে মাঝে ভিডিও পর্যালোচনাও করি। এ পর্যন্ত আমার মোট বই পর্যালোচনার সংখ্যা এক শ ছাড়িয়েছে।
আমি বইয়ের গল্প অন্যদের বলতে খুব পছন্দ করি। এ গল্প বলা বানোয়াট-মনভোলানো গল্প বলা নয়। এ গল্প বলার প্রধান উদ্দেশ্য নতুন পাঠক তৈরি করা এবং যারা পাঠক তাদের বই পড়ায় আরও উৎসাহিত করা। আমি যখন কোনো বই পড়ে শেষ করি তখন সেই বইয়ের কাহিনির সারাংশ স্কুলের বন্ধুবান্ধব, বড় ভাইবোন কিংবা পাঠকবন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। এতে করে তাদের যদি সেই বইটা পড়া না থাকে তাহলে সেই বইটা সম্পর্কে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং আমার কাছ থেকে বইটি ধার নিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে পাঠক খুব কম, একবারেই যৎসামান্য, যা শতকরা হিসাবে নিতান্তই নগণ্য। আর এই মোবাইল, ল্যাপটপ, ভিডিও গেমিং, টিভি কিংবা নেশাতে আসক্ত দেশটাকে অনেকের মতো আমিও একটি শিল্পসমৃদ্ধ পড়ুয়া রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখি। আমি জানি এটা একা চাইলে হবে না। কিন্তু আমরা যদি কিছু শৈল্পিক মানুষকে নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারি তবে আমরা পারব। এ দেশের মানুষ শুনতে ভালোবাসে, দেখতে ভালোবাসে কিন্তু অলসতার কারণে পড়তে চায় না। আমাদের খুলনাতে সৃজনশীল শিক্ষার্থী পাঠক খুব কম। আমি একটা জিনিস নিজে লক্ষ করেছি, তা হলো আমার স্কুলের যে বন্ধুরা আমি বই পড়ি তাই ‘বই পড়ে কী হবে?’, ‘জীবনে উন্নতি করতে পারবি না’ এসব বলে কটাক্ষ করত, সেই বন্ধুরাই এখন আমার চেয়েও ভালো পাঠক হয়ে যাচ্ছে। আর তাদের এই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য আমার মাধ্যমটি ছিল তাদের সামনে গিয়ে বিভিন্ন কাহিনির সারাংশ শোনানো এবং তারা সেটা বেশ উপভোগ করত। তাই মানুষ চাইলেই পারে দেশটাকে, সমাজটাকে কিংবা বিপথগামীদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে। বেশ ভালো লাগে এ কথা ভাবলে যে হয়তো অল্প হলেও আমি ইতোমধ্যে পাঠক তৈরি করতে পেরেছি। আর এ দেশকে পড়ুয়াদের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমার প্রথম প্রয়াস হলো আমার সংগঠন।
একটি সুস্থ, সুহৃদ, বাজে আসক্তিমুক্ত পড়ুয়া সমাজ গড়তে আমি কিছু সংগঠনের সঙ্গে করেছি এবং করছি। প্রথমে ‘বই আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামক দেড় লাখ সদস্যের একটি অনলাইন গ্রুপ ও মাঠপর্যায়ের সেই সংগঠনের অ্যাডমিন ও গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে সংগঠন সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছি। পরে নিজেই একটি বই ও সাহিত্যবিষয়ক অনলাইন সংগঠন তৈরি করেছি, যার নাম ‘বইপ্রেমী পাঠকদের সম্মিলন’ এবং এর সদস্য সংখ্যা ১১ হাজার। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমি অনেক পাঠক তৈরি করেছি আর তার চেয়ে বড় কথা প্রায় পাঁচ শ-এর বেশি পাঠকের হাতে বই তুলে দিয়েছি। বিশেষ করে টাকার অভাবে বই কিনতে না পারা মানুষকে বেশি বই উপহার দিয়েছি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমি পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দেই। কারণ, কেউ যদি কোনো কিছু বিনামূল্যে পায় তখন তার কাছে সেই জিনিসের কোনো মূল্য থাকে না। কিন্তু যখন কেউ সেই জিনিসটা অর্জন করে নেয় তখন কিন্তু তার কাছে সেই জিনিসটার মূল্য থাকে অপরিসীম।
আমি লেখালেখি করি শখের বশে। ইতোমধ্যে প্রথম উপন্যাস ‘অন্ধকারের গোলকধাঁধায়’ অন্যপ্রকাশ থেকে বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে। এ উপন্যাসটি আমি লিখেছি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এবং এটির শব্দ সংখ্যা হয়েছে ৪৫ হাজার। লেখালেখি জিনিসটা যতটা সহজ মনে হয়, আসলে ততটাও সহজ নয়। কারণ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যখন আমি লিখেছি সেসময় ১০০টি শব্দ লিখতে গেলেও ১০ ঘণ্টা গবেষণা করতে হয়েছে। এখনো অনেক কিছু শেখার আছে। আমি মনে করি, একজন ভালো লেখক হয়ে উঠতে গেলে আগে একজন ভালো পাঠক হয়ে ওঠা খুব জরুরি। তাই চেষ্টা করছি একজন শৈল্পিক ও সৃজনশীল পাঠক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে।
লেখালিখি, বই পড়া ও বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি আমি বই সংগ্রহ করতেও ভালোবাসি। আমি প্রচুর পরিমাণে বই সংগ্রহ করি। আমার অন্য বন্ধুরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়ে টাকা জমায় কিছু কিনে খাওয়ার জন্য কিংবা মোবাইল গেমিংয়ের পেছনে খরচ করার জন্য। আর আমি হেঁটে স্কুল-কোচিংয়ে গিয়ে টাকা জমাই বই কেনার জন্য। কারণ কিছু কিনে খেলে তা হজমই হয়ে যাবে কিন্তু বই কিনলে জ্ঞানার্জন হবে এবং তা দীর্ঘমেয়াদি। আমার সংগ্রহে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ বই রয়েছে।
এ ছাড়া আমি অডিওবুক তৈরি করতে ভালোবাসি। অধিকাংশ পাঠক অলসতায় বই পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসে। তাই আমি সুযোগ পেলেই অডিওবুক তৈরি করি। যদিও এখন শুধুমাত্র ছোটখাটো গল্প অডিওবুক আকারে প্রকাশ করে ফেসবুক প্রোফাইলে দিয়ে থাকি। কিন্তু খুব শিগগিরই আমি ও আমার দুই বড় ভাই মিলে একটি ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের কিছু শৈল্পিক গল্প-উপন্যাস দিয়ে অডিওবুকের বড় যাত্রা শুরু করতে চলেছি।
প্রথমদিকে বাড়ি থেকে তেমন অনুপ্রেরণা না পাওয়ায় বিদ্যালয়ে গিয়ে লুকিয়ে বই পড়তাম। বইয়ের অভাবে অনেক বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে পড়তাম। আর একবার বিদ্যালয় পালিয়ে অনেক খুঁজে পছন্দ তালিকার একটি বই কিনেছিলাম। পরবর্তী সময়ে পরিবার থেকে মোটামুটি সহায়তা পেয়েছি। তবে এ কথা অস্বীকার করব না যে, আমার মায়ের (প্রভাষক, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজ, খালিশপুর খুলনা) কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছি। বাড়ির মধ্যে তিনিই সবসময় বই পড়া ও লেখালেখিতে আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন এবং উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।
লেখালিখি করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বয়সে ছোট হওয়ায় এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে, হেয় হতে হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ বলেছেন ছোট মানুষের লেখা এত গভীর হওয়া সম্ভব নয়, নির্ঘাত পিতা-মাতা লিখে দেয়। আসলে আমি সবসময় প্রমাণ করতে চেয়েছি বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আর সেজন্য কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি সাহিত্যাঙ্গনে। আসলে বয়সের তুলনায় আমি একটু বেশি জ্ঞান লাভ করা এবং সবসময় নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আর অনেকেই ভাবেন বয়সের তুলনায় বেশি পাকা। আসলে বিষয়টি হলো আমার জানার আগ্রহটা গভীর, বয়স অনুযায়ী বেশি চিন্তা করি এবং বেশি কঠিন করে জীবনকে দেখি।
আমরা অনেকটা মোবাইল এবং অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছি। তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করব বেশি বেশি বই পড়ুন। আমাদের অনেক কিছুই অজানা থাকে। আমরা যখন একটা বই পড়ে আগে থেকে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে অবগত হই তাহলে আমাদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সেরকম কোনো পরিস্থিতি ঘটলে আমরা শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে পারব এবং সহজভাবে নিতে পারব। উদাহরণস্বরূপ আপনাকে নিয়ে কেউ বিদ্রুপ করছে।
আপনিও উল্টো তাকে বিদ্রুপ করে বসলেন এবং হাতাহাতির পর্যায় চলে গেলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আপনি বইতে পড়লেন কেউ বিদ্রুপ করলে উপেক্ষা করতে হবে, ফিরতি বিদ্রুপ শুধু সহিংসতারই জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ এটি যদি আপনি আগে থেকে জানতেন তাহলে ফিরতি বিদ্রুপ করে ঝগড়ার পরিমাণ বাড়াতেন না, এড়িয়ে যেতেন।
অষ্টম শ্রেণি, খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা
গোয়ালখালী, খালিশপুর, খুলনা
কলি