নেপাল অর্থনৈতিকভাবে একটি দুর্বল দেশ। নেপালের মূল আয় পর্যটন। বিশেষ করে হিমালয়কে ঘিরে সবকিছুর আয়োজন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিনএজারদের জীবন এবং শহর অঞ্চলের টিনএজারদের জীবনযাপনের ধরন স্বাভাবিকভাবেই এক নয়। যেমন গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ ছেলে টিনএজারদের একটা স্বপ্ন থাকে বড় হয়ে সে শেরপা হবে। শেরপা হলো যারা হিমালয় জয় করতে যায়, সেই সব অভিযাত্রীর সঙ্গী হয়ে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা অবধি এগিয়ে দিয়ে আসে। বিশেষ করে শহর ও গ্রাম নির্বিশেষে অনেক ছেলের স্বপ্ন থাকে দেশের সৈনিক হওয়া বা ব্রিটিশ সেনাদলে নাম লেখানো। ব্রিটেনে এখনো গোর্খা ব্রিগেড আছে, যারা মূলতঃ নেপাল থেকে যায়। বিশেষ করে ছেত্রী, গুরং, মাগার, রাই ও লিম্বু সম্প্রদায়ের যুবকরা ব্রিটিশ গোর্খা রেজিমেন্টে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যদিও সৈনিক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অতীব কঠিন পথ পার হয়ে যেতে হয়। গোর্খা সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার মূল কারণ, এটা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে খুব সম্মানের সঙ্গে নেওয়া হয়। বিদেশে অ্যাডভেঞ্চার, সঙ্গে উচ্চ বেতন- এসবই নেপালি যুবকদের একাজে যাওয়ার জন্য উৎসাহ জোগায়। আবার শহর অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখে ডাক্তার, প্রকৌশলী বা অন্য পেশাজীবী হওয়ার।
নেপালে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের বয়স পাঁচ। শুরু হয় বেসিক এডুকেশন পর্যায়। এই ধাপটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর মাধ্যমিক স্তর হলো নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। কিন্তু নেপালেও উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং খাবারের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। শহর অঞ্চলেও ছেলেদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয় আর মেয়েদের ক্ষেত্রে চিন্তা করা হয় বিয়ের কথা। গ্রাম অঞ্চলে এই বৈষম্য চরম।
নেপালি টিনএজারদের খুব বেশি পড়ালেখার চাপ নিতে হয়। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের বিষয়ে বাবা-মা ও সমাজের একটা বড় ধরনের চাপ থাকে। অন্যের এই চাওয়া-পাওয়াটা অনেক ছেলেমেয়েকে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। নেপালে দারিদ্র্য একটা বড় সমস্যা। দারিদ্রতার কারণে স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসা টিনএজাররা যথাযথ শিক্ষা নিয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগটা কমই পায়। আর এর ফলে তাদের জীবনও বিকশিত হতে পারে না। আইনগত বিধিনিষেধ থাকলেও বিষণ্নতা বা যথাযথ মানসিক ও আর্থিক সমর্থন না পাওয়ার কারণে অনেক ছেলেমেয়ে জীবনসংগ্রামে টিকতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়। এরপর তারা অ্যালকোহল, তামাকজাত বস্তু ও ড্রাগের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। ভূমিকম্প, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের দরুন ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও নেপালি টিনএজারদের জীবন ওলটপালট করে দেয়। যেমন ২০১৫ সালের ভয়ংকর ভূমিকম্পে ৯ হাজার স্কুল পুরোপুরি বা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে করে ১০ লাখ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় বিপর্যয় নেমে আসে। প্রাকৃতিক কারণে অভিভাবকদের মৃত্যুও টিনএজারদের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট বয়ে আনে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও টিনএজারদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করে।
নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগুলোতে একটি কুপ্রথা পালন করা হয়, এর নাম ‘চৌপদী’। মেয়েদের পিরিয়ডের সময় তাদের মূল বসবাসের ঘরের বাইরে একটি কুঁড়েঘরে বা গরুর ঘরে রাখা হয়। এসব হতভাগা মেয়ের অভিভাবক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, এ সময় মেয়েরা হয়ে যায় অপবিত্র এবং মূল ঘরে রাখলে পরিবারের অমঙ্গল হবে! এ কুপ্রথার দরুণ অল্পবয়সী মেয়েরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ঠাণ্ডাজনিত রোগে কাবু করে ফেলে। নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এমন ঘটনাও আছে।
নেপালে ‘টানি বিবাহ’ নামে একটি প্রথা আছে, যেখানে একবার একটা মেয়েকে অপহরণ করে ঘরে তুলতে পারলেই হলো, তাতে সেই পুরুষের বিয়ে করার অধিকার জন্মে যায়, মেয়েটির ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক। নেপালে ‘ছোট্টি বাসনে’ নামে আরেকটি বিবাহ প্রথা বহু বছর ধরে প্রচলিত আছে। ‘ছোট্টি বাসনে’ প্রথায় কোনো একজন ছেলে আসবে মেয়েটির গ্রামে। ছেলেটি মেয়েটির বাড়ি আসবে বা কোনো খোলা জায়গায় মেয়েটিকে দেখে গান গাইবে, নাচবে মেয়েটির ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। তখন মেয়েটির মা-বাবা সঙ্গে থাকতে পারে। ছেলেটি মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। মেয়েটি যদি রাজি হয় তাহলে বিয়ে সেখানেই ফাইনাল। সবই ঠিক আছে। কিন্তু আসলে মেয়েটির মতামতকে পাত্তা দেওয়া হয় না। তার এ বিয়েতে সম্মতি আছে কি না? কিন্তু এভাবে কোনো ছেলে প্রস্তাব দিলে ছেলেটির মেয়েটিকে বিয়ে করতেই হয়। এসব প্রথাকে গ্রামবাসী মেনে চলে। গ্রামের জনপ্রতিনিধিরাও পুলিশকে এসব কু-প্রথার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেয় না। মেয়েরাই এসব কুপ্রথার একমাত্র শিকার। মেয়েদের বিরুদ্ধে যায় এমন অনেক কু-প্রথা বিরাজমান আছে নেপালে।
বিষয়গুলো এতই বৈষম্যমূলক যে, এসব কুসংস্কারকে বাধা দেওয়ার জন্য আইন পাস করা হয়েছে। কিন্তু তাতে এসব কু-প্রথা পালন বন্ধ করা যায়নি। এসব রয়েই গেছে। যেহেতু দরিদ্র পরিবারে অভাবের কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা-মাই অস্থির হয়ে পড়েন, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েরা অনেক সময় তাদের কোনো পছন্দের পাত্রের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। সেখানেও তারা বেশির ভাগ সময় আরও প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয়। অল্প বয়স্ক স্বামীর যথাযথ উপার্জন এবং দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা না থাকায় নাবালিকা মেয়েটি শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর খুঁজে পায় না। নেপালিদের মধ্যে বিবাহপূর্ব যৌনতাকে সমর্থন করা হয় না। তার পরও ১৮-১৯ বছরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের অনেকেরই যৌনতার অভিজ্ঞতা হয়ে যায়।
নেপালে পারিবারিক মূল্যবোধকে মূল্যায়ন করা হয়। মেয়েরা বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করবে, ছেলেরা বাবাকে। পরিবারের বড়দের সম্মান করাও নেপালি টিনএজারদের অবশ্য কর্তব্য। ছেলেমেয়েরা বিয়ে বা চাকরি পাওয়া পর্যন্ত বাবা-মায়ের পরিবারেই থাকে। মেয়েরা তো অবশ্যই বিয়ে পর্যন্ত বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে।
নেপালে আছে বহুবিধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এসব উৎসবে টিনএজাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এসব উৎসব তাদের নিজ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের প্রতি পরিচয় করিয়ে দেয়। সর্বোপরি নেপালের টিনএজাররা ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও আধুনিক সমাজের রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত। তবে আস্তে আস্তে হলেও নেপালি সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যা টিনএজারদের হাত ধরেই আসছে।
জাহ্নবী