উত্তর মেরুতে বসবাসরত একদল মানুষের নাম এস্কিমো। এ দের বেশ কয়েকটি গোত্র আছে। এরা সাধারণত যাযাবর ধরনের জীবন ধারণ করে। শীত এবং গ্রীষ্মে আলাদা আলাদা জায়গায় এবং আলাদা রকমের ঘরে জীবনযাপন করে। আলাস্কার বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল, নরওয়ের গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও রাশিয়ার অঞ্চলের উত্তর মেরুতে এস্কিমোরা বাস করে।
একটা সময় ছিল সব এস্কিমো বরফ দিয়ে বানানো ঘরে বাস করত। কিন্তু এখন তা নয়। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় তাদের জীবনও পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ঘরগুলোকে বলা হয়, ইগলু। ইগলু শব্দের অর্থ বরফের বাড়ি। এস্কিমোরা তাদের জীবনধারণের জন্য প্রধানত পশুর ওপর নির্ভর করে থাকে। স্লেজ নামক এক ধরনের কুকুরে টানা গাড়িতে এস্কিমোরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। পশু শিকার এবং মাছ শিকার তাদের প্রধান পেশা। একটা সময়ে এস্কিমো শিশু, টিনএজারদের শিক্ষার মূল বিষয়ই ছিল পশু শিকার, মাছ ধরা, নিজেদের পালন করার মতো এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য হাতে বানানো বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি। একটা ছেলের প্রথম চিন্তা ছিল কীভাবে সে দক্ষ মাছ শিকারি হয়ে উঠবে, মাছ ধরে নিয়ে আসবে পরিবারের জন্য। ছেলেদের বিয়ের প্রথম যোগ্যতাই ছিল, তাকে প্রমাণ করতে হতো, সে মাছ শিকার করে, বরফের ঘর বানিয়ে এবং পশু শিকার করে তার স্ত্রীকে ভরণপোষণ করতে পারবে! এরপর ছেলেটা ১৭ বা ১৮ বছর হলে সে মেয়ের বাড়ি চলে যেত। এটাকে বলা হতো বিবাহপূর্ব প্রস্তুতি। এরপর হবু শ্বশুরের সঙ্গে গৃহস্থালী কাজকর্ম করত। এভাবে তিন চার বছর অতিক্রম হলে যখন মনে করা হতো যে এবার ছেলেটি একা একা ঘর বাঁধতে পারবে তখন তাদের ভিন্ন পরিবার গড়ার অনুমতি মিলত। মেয়েটির বয়স তখন হয়তো ১৫ কী ১৬ বছর। আর মেয়েরা পরিবার কীভাবে সামলাতে হবে সেটায় দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করত। অর্থাৎ ছেলে এবং মেয়ের চিন্তাই ছিল শুধু পরিবারকে ঘিরে। আর কোনো কিছুর চিন্তা করার অবসর বা উপায় কোনোটাই ছিল না। বাবা-মায়ের প্রভাব থেকে বের হওয়ার রাস্তা ছিল একেবারে বন্ধ। বিয়ে করতে গেলেও বাবা-মায়ের কথাই ছিল শেষ কথা। তখন বাল্যবিয়েই দিত। বাবা অনেক সময় মেয়ে ছোট থাকতেই অন্য কোনো পরিবারের ছেলের জন্য বিয়ে ঠিক করে রাখত। এমনকি সন্তান জন্মানোর আগেই বাবা-মা আরেক পরিবারকে কথা দিয়ে রাখত তার সন্তানকে তাদের সন্তানের সঙ্গে বিয়ে দেবে ভবিষ্যতে। কিন্তু এখন অবস্থা একেবারে উল্টো। এখন ছেলেমেয়েরা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে। যখন তাদের পড়াশোনা থাকে না তারা জুটি বেঁধে সময় কাটায় বা কোনো কাজকর্মে যুক্ত হয়। কে কখন কাকে বিয়ে করবে সেটা তার একান্ত নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। কদাচিৎ হয়তো তারা বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করে।
এস্কিমোরা একটা সময় এমন পরিবেশে বাস করত যেখানে সাধারণ মানুষ বাস করার চিন্তাও করতে পারত না। ১৯৭০ সালেও এস্কিমোদের বসবাসের অঞ্চলে কোনো হিটিং সিস্টেম ছিল না, দোকান ছিল না, রাস্তাঘাট ছিল না। অথচ শীতকালে ওইসব অঞ্চলে প্রায়ই মাইনাস ৪০-৫০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নেমে যায়। এমনকি কখনো মাইনাস ৭০ ডিগ্রি নামে। যেখানে এ অবস্থা সেখানে পরিবারের টিনএজাদের জন্য জন্য শিক্ষার আশা করা যায় না। তারা বড়দের দেওয়া শিক্ষা দিয়েই জীবন পার করত। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে এস্কিমোরা তাদের জীবন পার করে দিয়েছে।
কিন্তু অবস্থা এখন পাল্টেছে। মাত্র ২০ থেকে ৩০ বছর আগে থেকে এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এখন বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষায় ঢোকার ফলে টিনএজাররা শিক্ষিত হয়ে তাদের সমাজ-সংসারে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এনে দিচ্ছে। টিনএজারদের জীবনেও আসছে পরিবর্তন। তারা তাদের পুরাতন সংস্কার ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে। এখন ওইসব অঞ্চলের সরকারগুলো এস্কিমোদের আদি জীবন থেকে শহুরে জীবনে এনে আধুনিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। এখন অনেক এস্কিমো পরিবার শহরে এসে বাস করে। শিশু ও টিনএজাররা দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো অনেক টিনএজার তাদের পড়াশোনা শেষ করে ঠাণ্ডার রাজ্যে ফিরে যেতে চায়। তারা শহরে নিজেদের আগন্তক মনে করে। শহুরে জীবন তাদের পছন্দ নয়। নিজেদের জায়গা ছেড়ে না যেতে চাওয়াটা টিনএজারদের জীবনে নানা ধরনের বিপত্তি ডেকে আনে। যেমন, যেখানে তারা থাকে সেসব দুর্গম অঞ্চলে পড়ালেখা করে চাকরির সুযোগ অনেক কম। চাকরি যেখানে বেশি সেখানে তারা থাকতে চায় না। এ ছাড়া পড়াশোনা করার অনিচ্ছার কারণে তাদের মধ্যে চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় ডিগ্রি থাকে না। এজন্য তাদের চাকরিতে ঢোকাও একটা সমস্যা হয়ে থাকে। ফলে বেকারত্ব অনেক সময় তাদের হতাশার দিকে নিয়ে যায়। অ্যালকোহল ও অন্য নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে তারা। আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি দেখা যায় উত্তরাঞ্চলীয় বরফাচ্ছাদিত টিনএজারদের মধ্যে। আবার ধরাবাধা স্কুল জীবন, হোস্টেলে থাকা এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন টিনএজারদের মধ্যে হতাশা এবং অসহায়ত্বের জন্ম দেয়। এতে দেখা যায় তাদের পড়ালেখার মানও হ্রাস পায়। হয়তো নাইনথ গ্রেডের ছাত্র বা ছাত্রী সত্যিকার অর্থে তার লেখাপড়ার অর্জন সিক্সথ বা সেভেনেথ গ্রেডের সমান। শহরে পড়তে আসা এসব ব্যাপার টিনএজারদের মাঝে কিন্তু অহরহ দেখা যায়। অনেকে স্কুলই ছেড়ে দেয় কয়েক মাস পড়ালেখা করেই।
এস্কিমো পিতা-মাতাদের আদর পৃথিবী বিখ্যাত। তারা কখনো তাদের সন্তানদের মারধর করে না। এস্কিমো পরিবারের মূল বিষয়ই হলো যারা টিনএজার তরুণ তাদের জীবন চলার পথে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করা, শিকার করা, মাছ ধরা, ঘর তৈরি করা শেখানো। গল্প বলার মাধ্যমে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং পারিবারিক মূল্যবোধ শেখানো। পরিবেশ, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক কর্তব্য শেখানো হয়। পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি চলে সাধারণ শিক্ষা। এ সাধারণ শিক্ষা চলে অঞ্চল অনুযায়ী। কানাডা অঞ্চলের এস্কিমো ছেলেমেয়েরা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং কানাডার ভাষা ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় এবং রাশিয়া অঞ্চলের এস্কিমোরা এস্কিমো ভাষা এবং রাশিয়ান ভাষায় পড়ালেখা করে। কিন্তু সমস্যা হলো যারা শহর থেকে বহু দূরে থাকে সেসব অঞ্চলে স্কুলে মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া অনেক কঠিন। কারণ উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকরা শহরে ভালো কাজ পেলে কেন ঠাণ্ডার মধ্যে কষ্ট করতে যাবে? ভাষাও একটা সমস্যা। স্থানীয় ভাষায় শিক্ষক পাওয়া কঠিন। এসব বিষয় এস্কিমো টিনএজারদের শিক্ষার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। খাবারের রুচিতেও তাদের ঐতিহ্যগত খাবার কাঁচা মাছ, মাংস ছাড়াও তারাও এখন ফাস্টফুড খেতে পছন্দ করছে।
এস্কিমো টিনএজাররা সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানো ছাড়াও তাদের মধ্যে বরফ ছোড়াছুড়ি, নিজেদের শক্তি পরীক্ষা যেমন পাঞ্জা লড়াই, লাথি মারা এবং নানা ধরনের কুস্তি বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া যারা স্কুল-কলেজে পড়ে সেসব টিনএজার আধুনিক অন্যান্য টিনএজারদের মতোই ফুটবল, সকার, হকি খেলে। তবে এস্কিমো সমাজে যৌন আচরণের ক্ষেত্রে তাদের বিধিনিষেধ বেশ ঢিলেঢালা। সময় হলে একজন আরেকজনের সঙ্গে ঘর করবে ব্যস! কোনো আনুষ্ঠানিক বিয়ের অনুষ্ঠানেরও দরকার হয় না।
জাহ্নবী