টিনএজ বয়সে অনেকের উপস্থাপনার আগ্রহ তৈরি হয়। এই বয়সে যারা উপস্থাপনা শুরু করতে চান, তাদের কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন অনুষ্ঠানের শুরুটা যদি চিত্তাকর্ষক না হয়, তাহলে দর্শক বা অতিথি সহজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। অনুষ্ঠানের শুরু সুন্দর করার ক্ষেত্রে উপস্থাপকের ভূমিকাই মূল। নিখুঁত অনুষ্ঠানের জন্য চাই দক্ষ একজন উপস্থাপক। ভালো একটা স্ক্রিপ্ট আর পূর্বপ্রস্তুতির পাশাপাশি কিছু উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করলে একটা অনুষ্ঠান সার্থক হয়ে ওঠে। লিখেছেন ফারজানা আলম
দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা
অনুষ্ঠানের শুরুতেই যদি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো কোনো কিছু করা যায়, তবে বাকি অনুষ্ঠান ভালো যাওয়ার একটা পাকাপোক্ত সম্ভাবনা তৈরি হয়। ‘দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি’- এ ধরনের কথা না বলে এমন কিছু করা, যেন দর্শক নিজ থেকেই কৌতূহলী হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, অনুষ্ঠানের সঙ্গে যায় এমন একটা মজার কৌতুক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে অথবা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একটা সংক্ষিপ্ত ভিডিও দিয়ে। দর্শক বিনোদন পেলেই ধরে নিন আপনি একটা সুন্দর অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত!
শ্রোতাদের কল্পনা করতে বা ভাবতে দেওয়া
একজন মানুষের মস্তিষ্ক যখন সরব থাকে, তার মনোযোগ আকর্ষণ করাও সহজ হয়। যদি অনুষ্ঠানের শুরু করা যায় একটা কল্পনা দিয়ে, তাহলে কিন্তু মন্দ হয় না। এক্ষেত্রে হয়তো আপনি অনুষ্ঠানের থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা ‘কেমন হতো যদি অমুক ব্যাপারটা এমন না হয়ে তেমন হতো?’- জাতীয় প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে পারেন। তাহলে আপনার দর্শকও স্বাভাবিকভাবেই আপনার কল্পনা করা পরিস্থিতিটা নিজেরা কল্পনা করা শুরু করে দেবে। ব্যাস, পেয়ে গেলেন একসঙ্গে অনেক দর্শকের মনোযোগ।
ভবিষ্যৎ বা অতীত দিয়ে শুরু করতে পারেন
রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায় এই ব্যাপারটি অনেক লক্ষ করে থাকবেন। তারা অতীতে কোনো খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে বর্তমানে এসে পৌঁছেছেন অথবা ভবিষ্যতে কী কী সাফল্য অর্জন করবেন এমন কথা দিয়ে শুরু করেন। মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে এটি হতে পারে আপনার মাধ্যম! উদাহরণস্বরূপ ধরুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে আপনি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান উল্লেখের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন। অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করতে কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে বলতে পারেন।
প্রবাদ অথবা সংগতিপূর্ণ কবিতার লাইন
অনুষ্ঠান শুরুর বাক্য হিসেবে কবিতার লাইন অথবা কোনো প্রবাদ ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। কবিতার লাইন প্রাসঙ্গিক হলে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে যায়। আপনি যদি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্লাইড ব্যবহার করেন, তাহলে বলার সময় স্লাইডেও লাইনগুলো তুলে দিতে পারেন। এটি দর্শককে বুঝতে, কল্পনা করতে সাহায্য করবে।
গল্প অথবা ঘটনা দিয়ে শুরু করা
এটা অনেকটা প্রথম কৌশলের মতোই। এখানেও আপনার মূল কাজ দর্শককে আপনার ভাবের জগতে নিয়ে যাওয়া। অনুষ্ঠানের মূল ধারণা আর তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে কাজে আসবে এমন একটা সত্যিকার অথবা কাল্পনিক গল্প দিয়ে আপনি শুরু করতে পারেন। গল্প কিন্তু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার একটা ভালো হাতিয়ার!
রসিকতার মধ্য দিয়েও গল্প বলা যায়।
অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা থাকলে সেটা শুরুতে বলার চেষ্টা করতে পারেন।
নিজের অথবা দর্শকদের জীবন নিয়ে গল্প বলা
শ্রোতারা গল্প শুনে উপভোগ করেন, এটা তো আমরা জানলামই। আর গল্পটির সঙ্গে যখন দর্শক-শ্রোতা নিজের জীবনের মিল পাবেন, তখন গল্পটি হয়ে উঠবে আরও অসাধারণ সুন্দর। উপস্থাপক হিসেবে আপনার নিজের কোনো ঘটনা অথবা দর্শকদের জীবনের সঙ্গে মিলে যায় এমন কোনো ঘটনা দিয়ে শুরু করতে পারেন। এতে করে দর্শকের সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক তৈরি হবে অনুষ্ঠানের শুরুতেই।
দর্শকদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা
এটা অনুষ্ঠান শুরু করার আরেকটি সুন্দর উপস্থাপনা কৌশল। সাধারণত সেশন জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোয় এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই সবসময় শুরু করা হয়। এ ছাড়া যেকোনো অনুষ্ঠান শুরু করার সময় প্রশ্ন করলে অনুষ্ঠানে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকে।
পরিসংখ্যানে শুরু!
আপনি যদি আপনার অনুষ্ঠানের একটি খুব অর্থপূর্ণ শুরু চান এবং বুঝতে না পারেন কীভাবে উপস্থাপনা শুরু করতে হয়, তবে পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা হতে পারে সবচেয়ে ভালো অপশন। মনে করুন আপনার অনুষ্ঠান স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। আপনি শুরু করতে পারেন আপনার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপের মাধ্যমে। এতে করে অনুষ্ঠানে একটা ভাবগম্ভীরতা আসবে, পাশাপাশি দর্শকের মনোযোগও আকৃষ্ট হবে। তবে লক্ষ রাখতে হবে যেন খুব কঠিন কোনো উপাত্ত চলে না আসে, যা দর্শকদের বুঝতে সমস্যা হয়।
উপস্থাপনায় নতুন হলে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন
উপস্থাপনায় নতুন হলে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। সবার আগে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আর মনে রাখতে হবে আপনি কোন ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। একটা অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের মানুষ থাকতে পারে। আপনার কথা যেন সবারই বুঝতে সুবিধা হয়। একটা কথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, সহজ যেকোনো কিছুই সুন্দর। আপনার বলার বিষয় কঠিন হলেও, আপনি কত সহজে সেটাকে উপস্থাপন করতে পারছেন, এটা জরুরি। উপস্থাপনার সময় মাথায় অনেক ধরনের চাপ থাকতে পারে, অনেক দায়িত্ব নিয়ে বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। কিন্তু সহজ-সাবলীলতা একবার আয়ত্ত করে ফেলতে পারলে পুরো ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
অনেক অনুষ্ঠানেই উপস্থাপক অতিথির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। অনেক সময় দেখা যায় উপস্থাপক কিংবা দর্শকের কথার বিপরীতে অতিথি একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে যান। একজন উপস্থাপক হিসেবে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে, আপনার অতিথি যেন অপ্রীতিকর অবস্থায় না পড়েন এবং কোনো অবস্থাতেই অপমানিত বোধ না করেন।
অতিথি যেমন অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে পারেন, তেমনি আপনিও যেকোনো সময় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। কখনো হয়তো অপমানিত বোধ করতে পারেন। একজন সেরা উপস্থাপক হিসেবে আপনার কাজ হবে যতটা সম্ভব ওই পরিস্থিতিকে হাসিমুখে এড়িয়ে যাওয়া। যদি তা একান্তই সম্ভব না হয় তখন অবশ্য আলাদা ব্যাপার! তখন আপনার অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তবু কোনো অবস্থাতেই অনুষ্ঠান ভণ্ডুল হতে দেওয়া যাবে না। এই ব্যাপারে আপনার ধৈর্য কম থাকলে উপস্থাপনার দিকে পা না বাড়ানোই ভালো!
আপনার যদি কোনোভাবে মনে হয় আপনার ধৈর্যধারণক্ষমতা কম, তাহলে উপস্থাপনা আপনার জন্য নয়। সব ক্যারিয়ারেই কমবেশি ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, কিন্তু উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য। উপস্থাপনার সময় যেহেতু সরাসরি অন্য মানুষদের সংস্পর্শে আসা হয়, সেহেতু অনেক ধরনের কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরুন, কোনো একটা অনুষ্ঠানে একজন দর্শক আপনাকে অকারণে একটা বিষয়ে দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন, এমনকি কটাক্ষ করে উপহাস করতে পারেন। অনেক সময় দর্শক অথবা অতিথি এমন কথা বলতে পারেন, যা আপনার আদর্শিক দিককে মানে না। হোক সেটা টক শো, হোক সেটা সভা অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান, আপনার ধৈর্য অটুট থাকা চাই। মনে রাখবে, উপস্থাপনার জগতে ধৈর্যই আর হাসিমুখই আপনার ব্রহ্মাস্ত্র।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা কৌশল
নতুন উপস্থাপকদের জন্য পরামর্শ তো জানা হলো, এবার আসি উপস্থাপনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপসে। একজন সফল উপস্থাপক হতে হলে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখা চাই।
আত্মবিশ্বাসী হতে হবে
উপস্থাপনায় অনেক সময় আপনার অভিজ্ঞতা নেই, এমন কাজও আপনাকে করতে হতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, অনেক অভিজ্ঞরাও কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খান। অভিজ্ঞতা থাকুক আর না-ই থাকুক, আত্মবিশ্বাস থাকাটা অপরিহার্য।
একজন সফল উপস্থাপক কিন্তু একজন অ্যাটেনশান সিকার!
কী, অবাক লাগছে? অ্যাটেনশান সিকার শব্দটাকে আমরা মোটামুটি নেতিবাচক একটা গুণের কাতারেই ফেলি। কিন্তু আপনি যদি একজন সফল উপস্থাপক হতে চান, তাহলে অ্যাটেনশান সিক করা শিখে নিন। একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরুর পরমুহূর্ত থেকে উপস্থাপকের প্রধান কাজ থাকে দর্শক-অতিথির মনোযোগ ধরে রাখা। আর অ্যাটেনশান সিকিং এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে উপস্থাপনা শুরুর যে কয়েকটি কৌশলই দিয়েছি, তার প্রায় সবগুলোই দর্শকের মন আকর্ষণ করার। আপনার কাজ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে, তারা যেন সবাই আপনার কথা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
পোশাকের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা
পোশাক কি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ। পোশাকের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছা থেকে দর্শকের পছন্দের দিক বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। একজন উপস্থাপকের প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয় মাথায় রেখেই পোশাক নির্বাচন করা উচিত। অনুষ্ঠানের ভাবের সঙ্গে যায় এমন মার্জিত পোশাক পরা উচিত। দর্শকের কাছে এর মাধ্যমে একটা ইতিবাচক ভাব আসে।
স্পষ্ট উচ্চারণে বোধগম্য ভাষায় কথা বলতে হবে
উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পষ্ট, বোধগম্য ভাষায় কথা বলা। উপস্থাপকের কণ্ঠ নিচু না হওয়াই ভালো। চেষ্টা করতে হবে কথার স্পষ্টতা যেন এমন হয় যে একজন অমনোযোগী শ্রোতাও ঠিকমতো শুনতে পান।
দর্শকের দিকে তাকানো
উপস্থাপনা হোক কিংবা পাবলিক স্পিকিং, আই কন্ট্যাক্ট কিন্তু থাকা চাই-ই। অনেকসময় দেখা যায় কথা বলার সময় কেউ কেউ ছাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলে। এটা করা যাবে না। আপনি যাদের লক্ষ করে কথা বলছেন, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের দিকে তাকিয়েই আপনার কথা বলতে হবে।
হাতে স্ক্রিপ্ট না রেখে বুলেট পয়েন্ট রাখুন
অনেকে উপস্থাপনার সময় পুরো একটা স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে সেটা দেখে দেখে বলে। ফলে যা হয়, দর্শকের দিকে তাকানোই হয় না। তাই একটা পুরো স্ক্রিপ্ট হাতে না রেখে, মূল বিষয়গুলো একটা ছোট্ট কাগজে টুকে রাখা যায়। এতে করে কোনো কথা বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, পাশাপাশি একাধারে স্ক্রিপ্টের দিকে না তাকিয়ে দর্শকের দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়।
হাসিমুখ ওষুধের মতো
হাসিমুখ আপনার উপস্থাপনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে। আপনার কথার প্রতি দর্শকের মনোযোগ বাড়িয়ে দেবে, আর অনুষ্ঠানে একটা ইতিবাচক ভাব এনে দেবে। শুধু উপস্থাপনাই না, সবসময়ই হাসার চেষ্টা করুন। আপনি হাসছেন মানে আপনি আপনার নিজেকে আর আশপাশের মানুষকে ভালো থাকতে সাহায্য করছেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে জানা
এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য, যেটা সব উপস্থাপকের আয়ত্তে আনতে হয়। অনেক সময় অনুষ্ঠান যেমন চিন্তা করা হয়েছিল অমন নাও হতে পারে। ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা। উপস্থাপকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবেই উত্তপ্ত হওয়া চলবে না।
শেষ ভালো যার..
একজন উপস্থাপক অনুষ্ঠানজুড়ে কী করেছেন, এটির ধারণা দিতে হবে শেষে এসে। এর সঙ্গে সহানুভূতি আর আবেগপূর্ণ কিছু কথা জুড়ে দিয়ে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানের ইতি টানা যায়। সম্ভব হলে দর্শককে অনুষ্ঠানজুড়ে মনোযোগ ধরে রাখা এবং সাড়া প্রদানের জন্য ধন্যবাদ দিতে পারেন। অনুষ্ঠানের ইতি টানার কাজটি কিন্তু শুরুর মতোই দক্ষতার সঙ্গে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।
জাহ্নবী