কেউ প্রবাসে কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পেয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, ব্যবসায় বিফল হয়ে কেউ আছেন আর্থিক সংকটে, কেউ কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অল্প বেতনে কর্মরত, আছেন দিনমজুরসহ সমাজে বসবাস করা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত অসংখ্য পরিবার; যারা আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানি দিতে না পেরে বঞ্চিত হন মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার আনন্দ থেকে। মুখ ফুটে প্রকাশ্যে সাহায্য চাইতে না পারা সমাজের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এসব মানুষের সঙ্গে কোরবানির আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার একঝাঁক তরুণ ও পাঁচটি সংগঠন কয়েক বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যতিক্রমী একটি কার্যক্রম। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব তরুণের সম্মিলিত উদ্যোগে পশু কোরবানি দিয়ে মাংস গোপনে পৌঁছে দেওয়া হয় কোরবানি করতে না পারা পরিবারগুলোর কাছে। কার্যক্রমে অর্থের জোগান দেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে প্রবাসীরা।
অসহায়ে চক্ষু মেলো পরিবার একটি সংগঠনের নাম। এবার ঈদুল আজহায় চতুর্থবারের মতো ৮৫টি পরিবারের মাঝে গোপনে কোরবানির মাংস পৌঁছে দিয়েছে সংগঠনটি। সংগঠনের সভাপতি শরীফ আল হাসান বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ করে প্রবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থে কোরবানির জন্য পশু কেনা হয়। সন্দ্বীপের প্রতিটি ইউনিয়নে সংগঠনের সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত লোকজন আছেন। মূলত তাদের মাধ্যমে আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানি দিতে পারেননি এমন পরিবারগুলোর খোঁজ পাওয়ার পর একটি তালিকা তৈরি করে মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়। মাংস পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কাকে কাকে মাংস দেওয়া হয়েছে সেটা সংগঠনের সদস্যরা ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারে না। যে যেভাবে মাংস নিতে চায়, সেভাবেই পৌঁছে দেওয়া হয়। কেউ বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলেন, কেউ নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা দিলে, সদস্যরা শপিং ব্যাগে গোপনীয়তা রক্ষা করে মাংস পৌঁছে দেন।
রক্তদাতাদের সংগঠন সন্দ্বীপ ব্লাড ডোনার ফোরাম ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে পঞ্চমবারের মতো এ বছর ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় কেনা গরু কোরবানি দিয়ে মাংস পৌঁছে দিয়েছে ১০১টি দুস্থ, অসহায় ও কোরবানি করতে না পারা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে। সংগঠনের সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, অনেক পরিবার আছে বিভিন্ন সমস্যার কারণে কোরবানি করতে পারেন না। সামাজিক অবস্থানগত কারণে এসব পরিবারের পক্ষে প্রকাশ্যে সাহায্য চাওয়াও সম্ভব নয়। পরিবারের বড়রা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিলেও, ছোট সদস্যরা ঈদুল আজহায় কোরবানির মাংস খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। এরকম পরিবারগুলো খুঁজে বের করে গোপনে মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়। আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে যারা অবগত আছেন, ঈদুল আজহার আগে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন করা হয়।
আব্দুল কাদের মিয়া ফাউন্ডেশন এক যুগ ধরে নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করছে। এ বছর ১২০টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে তিনটি গরুর মাংস। প্রতিটি পরিবার পেয়েছে চার কেজি করে মাংস। গরু কেনা থেকে শুরু মাংস পৌঁছে দেওয়ার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন পারভেজ আলম রুস্তম, ফাহাদ চৌধুরী, মিলাদ আব্বাস, ফায়েল খান ও ওসামাসহ একঝাঁক তরুণ। কার্যক্রমের সমন্বয়কারী পারভেজ আলম রুস্তম বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন সব মানুষকে খুঁজে বের করা যারা কোরবানি দিতে পারেননি, কিন্তু প্রকাশ্যে মাংসের চাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করে এমন পরিবারগুলো খুঁজে বের করে, গোপনে তাদের কাছে মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গরিব অসহায়দের মাঝেও মাংস বিতরণ করা হয়েছে।
নিজস্ব উদ্যোগে মাংস বিতরণের পাশাপাশি ইয়ুথ ক্লাব অব চিটাগং, সন্দ্বীপ নামের একটি সংগঠনকেও দুস্থ ও অসহায়ের জন্য গরু কোরবানির কার্যক্রমে ১ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে আব্দুল কাদের মিয়া ফাউন্ডেশন। ইয়ুথ ক্লবাব অব চিটাগং, সন্দ্বীপ অন্যান্য সামাজিক কাজের পাশাপাশি কোরবানির মাংস বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে দীর্ঘ আট বছর। ইয়ুথ ক্লাব অব চিটাগাং, সন্দ্বীপের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান বলেন, প্রতি বছর আমাদের সংগঠনের সদস্যরা এবং আমাদের কিছু ডোনার অর্থায়ন করে থাকেন। এবার ৫০ জনকে আড়াই থেকে তিন কেজি করে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। মাংস বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতি বছরের মতো এবারও কোরবানি করতে না পারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো খুঁজে নেওয়া হয়েছে।
কোরবানির আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে মানুষ মানুষের জন্য নামের একটি সংগঠন তৃতীয়বারের মতো এবার ঈদুল আজহায় মাংস বিতরণ করছে ৮৯টি পরিবারের মাঝে এবং ইরামন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে গরু ও ছাগল কোরবানি। মানুষ মানুষের জন্য সংগঠনের কোরবানি কার্যক্রমের অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ মেহেদী হাসান জানান, তৃতীয়বারের মতো আমরা এবার ৮৯টি পরিবারকে দিতে সক্ষম হয়েছি। গত কোরবানিতে ছিল ৪৭ পরিবার। আমাদের নির্দিষ্ট কিছু প্রতিনিধি গোপনীয়তার সঙ্গে উপহার পৌঁছে দিয়েছে যেন আমাদের উপহার পেয়ে কোনো পরিবারকে লজ্জিত হতে না হয়। গোপনীয়তাকে শতভাগ নিশ্চয়তার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সাংগঠিনক উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাস্তবায়িত হয়েছে নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে মাংস বিতরণের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। তৃতীয়বারের মতো এবার ঈদুল আজহায় বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া অনুদান থেকে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় কেনা ৪টি গরু কোরবানি দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে একঝাঁক তরুণ, যাদের মধ্যে জাহিদ হাসান শাকিল, মিজানুর রহমান মাহি, নজরুল মাহমুদ, আরিফুল ইসলাম, মোহাম্মদ হামিদ, মিলাদ আব্বাস, মহব্বত আলম, মোহাম্মদ মিকাত, মোহাম্মদ মেহরাজ, মোহাম্মদ মাসুদ রানা, জাহিদুর ইসলাম ও আমিনুল ইসলাম সবুজ অন্যতম।
নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিতদের মাংস বিতরণ কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা জাহিদ হাসান শাকিল বলেন, তৃতীয়বারের মতো এবারও আমরা নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিতদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছি। দুদিন সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ২৬০টিরও বেশি পরিবারকে আমাদের টিমের সদস্যরা মাংস পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের প্রথম শর্ত মাংসের প্যাকেটগুলো কাকে দিয়েছি কেউ জানবে না, সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ফান্ড কালেকশন ও নিম্নআয়ের মানুষ নির্বাচনের পদ্ধতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষের মনে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ায় ঈদুল আজহার আগে অনেকে খোঁজখবর নেন। মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন করা হয়। নিম্নআয়ের মানুষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের টিমের সদস্যরা সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে তালিকা তৈরি করেন। পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমে সাহায্যপ্রার্থীদের টিমের সদস্যদের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
জাহ্নবী