
কৈশোরকাল জীবনের একটি বিশেষ সময়। এই সময় ছেলেমেয়েরা শৈশবকাল পেরিয়ে ধীরে ধীরে যৌবনকালের দিকে যেতে থাকে। শিশুকাল ও যৌবনের মাঝামাঝি সময়কে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরকাল। কৈশোরকাল হলো শৈশব থেকে যৌবনে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল অর্থাৎ এই সময় হলো এমন একটি সেতু যা শৈশব ও যুবককালের মধ্যে বন্ধন স্বরূপ। এই সেতুর একদিকে শৈশবকাল যার অভিজ্ঞতা কিশোর-কিশোরীরা জীবনে অর্জন করেছে। সেতুর অন্যদিকে থাকে যুবকাল, যে অভিজ্ঞতা তাদের হয়নি কিন্তু সেই জীবনে যাওয়ার জন্য মনে থাকে স্বপ্ন, আবেগ আর নিজেকে তৈরির প্রচেষ্টা।
সুতরাং একজন বালক-বালিকা হঠাৎ করেই তরুণ-তরুণী হয়ে যায় না। তরুণ-তরুণী হওয়ার জন্য তাদের শরীর ও মনের পরিপক্বতা প্রয়োজন হয় এবং এই পরিবর্তন আসে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার জন্যই বয়ঃসন্ধিকালকে বালক/বালিকা থেকে তরুণ/তরুণী হওয়ার সেতুবন্ধন বলা যেতে পারে। জীবনের অন্যান্য সময় যেমন শৈশবকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্যের মতো কৈশোরকালও একটি স্বাভাবিক সময়। তাই কৈশোরকালকে অস্বাভাবিক ভাবার কোনো অবকাশ নেই বরং একে বিশেষ সময় বা কাল বলা যেতে পারে। এই সময় কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন হয় যার প্রভাব তার আচরণে প্রতিফলিত হয়। এ ছাড়া এ সময় তার আবেগীয়, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। যার প্রভাব পড়ে তাদের চিন্তায়, কথায় ও কাজে। সব মিলিয়ে এই বয়স ছেলেমেয়েদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ভালোবাসার আবেগটি প্রবল হয় এবং একই সঙ্গে যৌনতা ও যৌন ভাবনা জেগে ওঠে। এ ভাবনা আবেগ ও শারীরিক অনুভূতির বিশেষ চাহিদার জন্ম দেয়। এ চাহিদা থেকেই বিশেষ কারও প্রতি প্রেমে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। অল্প বয়সের প্রেম কিশোর-কিশোরীদের সাময়িকভাবে আনন্দ দেয়, তারা নিজেদের সুখী ভাবে এবং জীবন তাদের কাছে রঙিন হয়ে ওঠে। এই সুখানুভূতি নিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, ফলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
অপরিণত বয়সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া মোটেই ভালো নয় বরং এতে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই প্রেমের সম্পর্ক তাদের একটি নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যায়, তারা আবেগাপ্লুত হয়। এই আবেগের ফলে তারা যুক্তির ব্যবহার কম করে, ঠিক কাজটি করছে নাকি ভুল পথে পা দিয়েছে তা বোঝার মতো বুদ্ধি বা যুক্তি ব্যবহার করে না। এর পরিণতিতে শুধু ছেলেমেয়ে নয় বরং উভয়ের পরিবারেও নানা অশান্তি দেখা দেয়। অল্প বয়সে প্রেমের পরিণতি হয় ভয়াবহ। অল্প বয়সের প্রেমের ফলে সাধারণভাবে যেসব সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো হলো-
মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্কের অভাব
যদি একটি কিশোর-কিশোরী কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং তা মা-বাবা জেনে যান তবে সাধারণত তারা ব্যাপারটি পছন্দ করেন না। মেয়েটিকে/ছেলেটিকে এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে বলেন, ছেলে/মেয়ে থেকে দূরে সরে যেতে বলেন। কিন্তু সচারাচর যা দেখা যায় তা হলো মেয়েটি/ছেলেটি তা মেনে নেয় না বরং তার ভালোবাসার পক্ষে যুক্তি দেখাতে থাকে। এই টানাপড়েনের ফলে ছেলেটির/মেয়েটির সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কে চিড় ধরে, নষ্ট হয়ে যায় এতদিনের যত্নে গড়ে ওঠা সম্পর্ক।
মা-বাবার অনিরাপত্তাবোধ
নিজের সন্তানটি যখন কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখন মা-বাবা ভয় পান, মনে করেন সন্তানটি বিপদে পড়তে পারে। খারাপ কিছুতে জড়িয়ে যেতে পারে। এই উৎকণ্ঠা থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন।
লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা
কিশোর-কিশোরীরা যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখন প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে এত বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে যে, সব মনোযোগ থাকে মেয়েটি/ছেলেটির দিকে। এতে সে সাধারণত লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয় না, পরীক্ষার প্রস্তুতি ঠিকমতো নেয় না। ফলে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হয়। লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।
নিরাপত্তাহীনতা
যখন একটি মেয়ে/ছেলে কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তখন নানা কারণে একে অপরকে অবিশ্বাস করে। মনে করে মেয়েটি/ছেলেটি অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। সবসময় ভাবে ছেলেটি/মেয়েটি কার সঙ্গে কথা বলে, কার সঙ্গে মিশে, সামাজিক মিডিয়ায় কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইত্যাদি। এসব ভাবনা ছেলেটি/মেয়েটির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়, যা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না।
ঝগড়ার ফলে অশান্তি
আজকাল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। নানা ছোটখাটো ঘটনা থেকে ঝগড়া শুরু হয়। দেরিতে দেখা করতে আসা, বিশেষ উপলক্ষে উপহার না দেওয়া, অন্য বন্ধুদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি নানা কারণে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। এই ঝগড়ার ফলে তারা নানা অশান্তিতে ভোগে।
ব্ল্যাকমেইল করা
আজকাল প্রেমের সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে ছেলেরা মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করে থাকে, যার পরিণতি হয় ভয়ংকর। ছেলেরা মেয়েদের আপত্তিকর ছবি তুলে তা সামাজিক মিডিয়াতে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে।
অযথা খরচ
একজন আরেকজনকে খুশি রাখার জন্য নানাভাবে খরচ করে। যেমন- উপহার দেওয়া, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়ানো ইত্যাদি। এই খরচের জন্য তারা অনেক সময় অসামাজিক উপায়ে টাকা জোগাড় করে। যেমন- বাবার পকেট অথবা মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা সরানো।
প্রেমে ব্যর্থতা ও মাদকাসক্তি
কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় প্রেমে ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাৎ ছেলেটি তাকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। আবার মেয়েটিও অন্য কোনো ছেলের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া সবার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। পরিণতিতে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জড়িয়ে যায় ভয়ংকর নেশায়।
আত্মীয়স্বজনের প্রতিক্রিয়া
অল্প বয়সে কোনো মেয়ে/ছেলে যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন তার আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটি মোটেই ভালো নজরে দেখেন না। তারা ধরে নেন ছেলেটি/মেয়েটি খারাপ পথে চলে গেছে। তারা নিজেদের সন্তানদের এমন ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতে দিতে চান না।
বাল্যবিবাহের সম্ভাবনা
অল্প বয়সে মেয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে মা-বাবা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সবসময় ভাবেন কখন কী বিপদ হয়। এই বিপদের ভয়ে অনেকেই অল্প বয়সে লেখাপড়া শেষ না হতেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া শারীরিক ও মানসিক দুই দিকের জন্যই ক্ষতিকর।
ভুল মানুষকে সঙ্গী করা
অল্প বয়সে আবেগপ্রবণ হয়ে সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে সাধারণত কিশোর-কিশোরীরা ভুল মানুষকে বেছে নেয়। মেয়েটি/ছেলেটির পরিবার, শিক্ষা, স্বভাব-চরিত্র, মেজাজ, আচরণ ইত্যাদি কিছু না জেনে, না বুঝেই গর্তে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই প্রেমে পড়ে। ফলে ভুল ব্যক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পরিণতি ভালো হয় না।
তাই কিশোর-কিশোরীদের বুঝতে হবে কারও প্রতি কৌতূহল বা আকর্ষণ বোধ করা মানেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া নয়। অল্প বয়সের প্রেমের কুফলগুলো জানা এবং বোঝার মাধ্যমে নিজের বুদ্ধি ও যুক্তির ব্যবহার করে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অল্প বয়সের প্রেম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
জাহ্নবী