বাংলাদেশ ফলের দেশ। বিভিন্ন ঋতুতে নানান রকম ফল পাওয়া যায় দেশে। বাংলাদেশে ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ। এ মাসে যত ফলের সমাহার দেখা যায়, অন্য কোনো মাসে এত ফল পাওয়া যায় না। এ মাসে যেসব ফল পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে আম। তারপর কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, লটকন ইত্যাদি।
দেশের একেক অঞ্চল একেক ফলের জন্য বিখ্যাত। যেমন আমের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাঙামাটি, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ইত্যাদি। লিচুর জন্য বিখ্যাত পাবনা, দিনাজপুর, রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, পঞ্চগড়।
আর বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে বিখ্যাত জেলাগুলো হলো- গাজীপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, কুষ্টিয়া, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ইত্যাদি। বরিশাল, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, যশোর, পাবনা, গাজীপুর, কুমিল্লা, রংপুর, নাটোর, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি হচ্ছে পেয়ারার জন্য প্রসিদ্ধ। এই বর্ষায় টক ও মিষ্টি স্বাদের লটকন না হলে ফলাহার কিন্তু পরিপূর্ণ হয় না। লটকনের জন্য প্রথমেই নরসিংদী জেলার নাম আসে। কলার জন্য বিখ্যাত মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর। আর আনারস বলতেই সিলেট, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও নরসিংদীর নাম আসে।
তবে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল উৎপাদন অনেক গুণে বেড়েছে। বেড়েছে ফলের বাগান। ব্যক্তি উদ্যোগে দেশের অনেক পরিত্যক্ত জায়গায় ফল বাগান করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার মিশ্র ফলের বাগান করে তৈরি করছেন ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত।
শারীরিক পুষ্টির পাশাপাশি ফল কিন্তু মানসিক প্রশান্তিও তৈরি করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফল বাগানভিত্তিক পর্যটন গড়ে উঠেছে। যদিও আমাদের দেশে এটা এখনো নতুন ও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের দেশে পর্যটন বলতেই আমরা বুঝি দৃষ্টিনন্দন বা ঐতিহাসিক কিংবা বিখ্যাত কোনো স্থানে ঘোরাঘুরি। তবে পরিকল্পিত ফলবাগানও হতে পারে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র। ফল বাগান পর্যটনে টাটকা ফলের স্বাদ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পর্যটনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তিও হয়।
ফল পর্যটনে গিয়ে নিজের হাতে গাছ থেকে টাটকা ফল পেড়ে খাওয়ার যে আনন্দ ও তৃপ্তি, সেটা কি বাজার থেকে কিনে নিয়ে ফল খাওয়ার মধ্যে আছে? নেই। আর নেই বলেই বাংলাদেশেও দিন দিন ফল পর্যটন জনপ্রিয় হচ্ছে। যদিও দেশে ফল পর্যটন এখন অবধি প্রাতিষ্ঠানিক সে রূপ এখনো পায়নি। তবে যেভাবে ফল বাগানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশে পর্যটনের নতুন দিগন্ত তৈরি হচ্ছে নিশ্চিত।
বাংলাদেশে ফল পর্যটনের সম্ভাবনা ব্যাপক। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ফল পর্যটনের কিছু উদাহরণ এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে। যেমন- নরসিংদীর কিছু কিছু লটকন বাগানে এরকম সুযোগ পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে যে কেউ বাগানে ঢুকে যত ইচ্ছে লটকন খাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। একইভাবে সিলেটের কয়েকটি আনারস বাগান, ঝালকাঠির পেয়ারাবাগানে এরকম পর্যটন শুরু হয়ে গেছে। তবে দেশের কোনো আমবাগানে এরকম পর্যটনের সুযোগ এখনো তৈরি হয়েছে বলে জানা নেই। আবার কিছু মিশ্র ফলের বাগানেও এরকম ফল পর্যটন শুরু হয়েছে।
ফল পর্যটন কেবল পর্যটন খাতই নয়, সমৃদ্ধ করতে পারে কৃষি খাতকেও। সিলেটে প্রায় ৮০০ পাহাড় ও টিলা রয়েছে। এসব পাহাড় বা টিলার বেশির ভাগই পতিত বা অনাবাদি হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব পাহাড় ও টিলা কমলা এবং আনারস চাষের জন্য ভীষণ উপযোগী। এসব টিলা ও পাহাড়কে চাষের আওতায় এনে প্রচুর পরিমাণে ফল উৎপাদনের পাশাপাশি, ফল পর্যটনের সম্ভাবনাও তৈরি করা সম্ভব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে ফল বাগান- দুয়ে মিলে পর্যটনের নতুন দৃষ্টান্ত হবে অবশ্যই। বিশেষজ্ঞদের মতে টিলায় চাষাবাদ প্রাণ ও প্রকৃতিবিরোধী নয়। টিলাধস ও ভূমিক্ষয়ের শঙ্কাও থাকে না। বরং সেখানকার মাটি আরও দৃঢ় ও মজবুত হয়।
পরিকল্পিত ফলের বাগান হতে পারে টিলা বাঁচানোর দারুণতম উদ্যোগ। কেবল সিলেট নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে দেশের তিন পার্বত্য জেলাও। ২০২৩ সালে শুধু রাঙামাটিতেই আম, কলা, আনারস, লিচু ও কাঁঠাল- এই পাঁচটি ফলের উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টন। যার বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শুধু মৌসুমি ফলের চাষ করেই এই তিন পার্বত্য জেলা থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আর এর সঙ্গে পর্যটনের সম্ভাবনাও তৈরি হবে ফলের মৌসুমে।
এ জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতিমালা ও উদ্যোগ। কিছু কিছু উদ্যোগ এর মধ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ, যাতে ফলের উৎপাদনের সঙ্গে পর্যটনের উন্নতি ঘটানো যায়। পর্যটন মৌসুমে শুধু নয়, তখন ওই পার্বত্য জেলাগুলোয় ফলের মৌসুমও হতে পারে পর্যটন মৌসুম।
কলি