গত মাসে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মে মাসে ‘ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক ২০২৪’ প্রকাশ করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করে থাকে। চলতি বছর ১১৯টি দেশের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ভারত ৩৯। এরপর শ্রীলংকা ৭৬, পাকিস্তান ১০১, নেপাল ১০৫। এই সূচকে বাংলাদেশের পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে জিম্বাবুয়ে, হন্ডুরাস, নাইজেরিয়া, বেনিন, আইভোরিকোস্ট, মালাউয়ি, অ্যাঙ্গোলা, ক্যামেরুন, সিয়েরা লিওন ও মালি।
সূচক তৈরিতে পাঁচটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হচ্ছে- সহায়ক পরিবেশ, ভ্রমণ ও পর্যটনবিষয়ক নীতি, অবকাঠামো ও সেবা, পর্যটন ও ভ্রমণের সম্পদ এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব। এই সূচক তৈরিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামকে সহায়তা করেছে যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়। সূচক তৈরিতে নিজেদের সংগ্রহ করা তথ্য ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সূচকের প্রথম পাঁচটি দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জাপান, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার প্রথমে জাপান- সূচক ৩। এরপর চীন- সূচক ৮, সিঙ্গাপুর- সূচক ১৩, দক্ষিণ কোরিয়া- সূচক ১৪, ইন্দোনেশিয়া- সূচক ২২, মালয়েশিয়া- সূচক ৩৫।
তার অর্থ এশিয়ার দেশগুলো পর্যটনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায়। কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, এশিয়ার সর্বশেষ সূচকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের পরে এশিয়ার আর কোনো দেশ নেই। কিন্তু কেন বাংলাদেশ পর্যটন সূচকে এতটা পিছিয়ে? কেন সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বিকাশ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পর্যটনে মূল সমস্যা কোথায়?
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। ২০২২ সালে এসেছিল ৫ লাখ ২৫ হাজার ৬৫৬ জন। ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬, ২০২০ সালে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮, ২০১৯ সালে ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন।
বিদেশি পর্যটক যে হারে বাড়ছে, তাতে একটা সংশয় রয়ে যায়। সংশয়টা কী? ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৫৫ লাখ বিদেশি পর্যটক আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ড। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিদেশি পর্যটক বাড়ার হার মোটেও সন্তোষজনক নয়।
পর্যটনের সঙ্গে কিছু বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত- পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার সড়ক, যানবাহন, নিরাপত্তা, বিশ্রাম, বিনোদন, টয়লেট, খাবারের মান ও মূল্য, থাকার জায়গা ইত্যাদি।
যদিও পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আপাতত দেশের পাঁচটি পর্যটন কেন্দ্রকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজ চলছে। এরপর আরও কিছু স্পটকে উন্নত করা হবে।
দেশের ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে ভারত থেকে। এরপর এশিয়ার মধ্যে চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জাপানের পর্যটকরা আসেন বাংলাদেশে। এশিয়ার বাইরে থেকে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, তুরস্ক এবং রাশিয়া থেকে পর্যটক বেশি আসেন।
অন্যদিকে ২০২১ সালে ৩ হাজার ৯২৩ বাংলাদেশি গিয়েছিলেন মালদ্বীপ ভ্রমণে। আর ২০২২ সালে মালদ্বীপ বেড়াতে যান ১৬ হাজার ৮০৭ জন বাংলাদেশি। ২০২৩ সালে ২৮ হাজার ৩৩৬ বাংলাদেশি। মালদ্বীপের ১৫তম পর্যটক উৎস এখন বাংলাদেশ। যদিও বছরে কতজন বাংলাদেশি বিদেশে ঘুরতে যান, সেটার চূড়ান্ত হিসাব নেই। তবে স্থলবন্দর দিয়ে বছরে ২০ লাখ বাংলাদেশি যাচ্ছেন ভারতে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি জিডিপি আসে মালদ্বীপের- দেশটির জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার সাড়ে ১২ শতাংশ, নেপালের ৬ শতাংশ, ভুটানের সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ভারতের সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। তবে দেশের পর্যটনের বড় আয় আসে দেশের ভেতরে থাকা পর্যটক থেকে- বিদেশি পর্যটক থেকে নয়।
অথচ কোনো বিদেশি পর্যটক যদি ১ হাজার ডলার নিয়ে বাংলাদেশে আসেন, তিনি ৮০০ ডলারই খরচ করেন আবাসন, খাবার ও ভ্রমণের কাজে। বাকি ২০০ ডলার শপিংয়ে খরচ করেন। এই শপিংয়ে তিনি বাংলাদেশি পণ্যই কেনেন। ফলে ১ হাজার ডলারের প্রায় সবটাই রয়ে যায় দেশে।
মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ‘দেউলিয়া’ হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত পর্যটনের ওপর ভর দিয়ে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অথচ কী নেই বাংলাদেশে? পাহাড়, সমুদ্রসহ পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো সবই আছে। নেই প্রচার, নেই পরিকল্পনা, নেই বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুযোগসুবিধা, নেই পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা এবং নেই পর্যটনবান্ধব নীতি। এত নেইয়ের মধ্যে থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে বছরে ৫৫ লাখ বিদেশি পর্যটক কি আমরা আনতে পারব?
জাহ্নবী