মিরপুর-১০, ডি ব্লক, মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে কালশীর দিকে। রাস্তার দুই পাশে ঝুটের (গার্মেন্টস কাটপিস) বাজার। ছোট ছোট টিনের দোকান তাতে ঝুটভর্তি, কোলাহল, দরদাম চলছে হরদম। এ পথে সোজা চলে গেলে, রাস্তার শেষ মাথায় একটি স্থাপনা পত পত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তোরণের দুই দিকে লাল জমিনে সাদা রঙ্গে লেখা ‘একাত্তরের গণহত্যা ও শহিদদের কথা বলবে শতকণ্ঠে জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ’ ও ‘কান পেতে শুনি কী বলিতে চাইছে জল্লাদখানা বধ্যভূমি’।
একটা সিঁড়ি নেমে গেছে মূল স্থাপনার দিকে, সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে ঢুকতেই কানে এল ঘণ্টার ধ্বনি। তিন থেকে চারজন স্কুলপড়ুয়া ছেলে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। হাতের ডান দিকে প্রথমেই চোখে পড়বে একটা খোলামেলা ঘর। ঘরের মাঝখানে দুটি সিমেন্টের বেঞ্চ ও একটা টেবিল। চারকোনায় আরও চারটি টেবিল। কর্নার টেবিলগুলোতে বিভিন্ন ফাইলে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালি হত্যার কালো ইতিহাস। মূল টেবিলে মন্তব্য খাতা।
দুজন লোককে বসে থাকতে দেখে তাদের পরিচয় জানতে চাইলাম। একজন এখানকার গার্ড আর অন্যজন মালি। তাদেরই পরম মমতায় বেড়ে উঠেছে এখানকার প্রত্যেকটি গাছ ও লতাপাতা।
জানতে চাইলাম, ‘এখানে ঘণ্টা কেন? ঘণ্টা দিয়ে কী বোঝায়?’
‘ঘণ্টা বাজিয়ে শহিদদের স্মরণ করা হয়, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করা হয়। প্রকাশ পায় সত্য ও ন্যায়ের বাণী, চেতনার ঘণ্টা বলতে পারেন’, গার্ড উত্তর দিলেন।
তিনিই জাদুঘরটি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। ভেতরের দেয়ালের চারপাশের বেদিতে মর্মর পাথরে খোদাই করা হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির নাম। ছয়টি কাচের বক্সে রাখা আছে ছয়টি বিভাগের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর মাটি। মাঝখানের দেয়ালে রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামানের তৈরি ভাস্কর্য ‘জীবন অবিনশ্বর’ এতে মৃত্যু ও ভীতির অমানিশা থেকে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ব্যাপারটিকে তারা ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষ হাতে, পরম আবেগে।
ডানে শেষ কোনায় কাচে ঘেরা একটি ২০ ফিট প্রশস্ত স্তূপ। এটিই সেই এককালের অত্যন্ত প্রশস্ত ভয়াল মৃত্যুকূপ- পাকিস্তান আমলের ওয়াটার সেপটিক ট্যাংক! মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো ৯ মাস এখানে ধরে এনে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য অসহায় মানুষকে।
১৫ নভেম্বর, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহযোগিতায় এর খনন কাজ শুরু হয়। ২৩ নভেম্বর খনন কাজ শেষ হওয়ার পর এখান থেকে তিন ট্রাক হাড়গোড় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্ধার করা হয় ৭০টি মাথার খুলি ও ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থি। এই হাড়গুলোর মালিকদের এই জল্লাদখানায় এনে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে।
পাশের ঘরটির সামনে লেখা ‘জুতা খুলে প্রবেশ করুন’। ভেতরে আরেকটি কাচে ঢাকা কূপ, ভয়াবহ ‘ওয়াটার সেফটি ট্যাঙ্ক’টির আরেকটি অংশ। কাচে ঢাকা একটি শোকেসে সাজানো আছে জামা, তসবিহ, স্যান্ডেলসহ কিছু নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এগুলো সেসব হতভাগ্য মানুষের ব্যবহার্য জিনিসপত্র যাদের ধরে আনা হতো ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে। হয়তো গভীর রাতে ঘুমন্ত কোনো শিশুর আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল তার বাবা কিংবা মাকে, হয়তোবা তাকেও। ভারী মন নিয়ে বাইরে আঙিনায় বের হয়ে আসলাম, তখনো দিনের আলো নেভেনি।
ইতিহাস
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুরের বিহারি অধ্যুষিত এলাকাগুলো সাধারণত বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালিদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর বিহারি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে গলা কেটে বড় বড় সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে ফেলে রাখত।
এ বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখণ্ড, মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলংকার, জুতা, তসবিসহ শহিদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
বর্তমান অবস্থা
১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিতকরণ ও সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করে এবং ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের সহযোগিতায় মিরপুরের দুটি জায়গায় খননকাজ চালায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আবিষ্কৃত হয় দুটি বধ্যভূমি। এরপর এ দুটিসহ পুরো মিরপুরে মোট চারটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়।
২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার পুনরায় জল্লাদখানা কর্মসূচি শুরু করে এবং স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনের সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ। এর পূর্বপাশে রয়েছে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামানের যুগ্মভাবে করা একটি ভাস্কর্য ‘জীবন অবিনশ্বর’। ২০০৭ সালের ২১ জুন এই স্থাপনাটির দ্বার উন্মোচন করা হয়।
প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ দর্শনার্থী এই স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করেন। উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ এখানে এসেছেন। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং সেই সময়ের বর্বরতার সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করতে সবার, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের এই বধ্যভূমি পরিদর্শন করা উচিত। এই বধ্যভূমি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল্য কত বড় এবং এই স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
জল্লাদখানা বধ্যভূমি যাওয়ার উপায়
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জল্লাদখানা বধ্যভূমি যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে সহজেই এই স্থানে যাওয়া যায়। গোলচত্বর থেকে ১১ নম্বর সেকশনের দিকে যেতে বেনারসি পল্লির পাশেই এর অবস্থান। আপনি বাস, রিকশা, অটোরিকশা অথবা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যেকোনো রিকশা বা অটোরিকশাওয়ালাকে জল্লাদখানা বধ্যভূমি বললেই তারা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে। বাসে করে যেতে চাইলে, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যেসব বাস ১১, ১২ নম্বর সেকশনের দিকে যায় সেগুলোতে উঠতে পারেন। বেনারসি পল্লিতে নেমে কিছুটা হাঁটলেই জল্লাদখানা বধ্যভূমি পৌঁছে যাবেন। গাড়িতে করে গেলে, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১১ নম্বরের দিকে রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই বেনারসি পল্লির পাশে জল্লাদখানা বধ্যভূমি দেখতে পাবেন।
ঢাকায় আরও দর্শনীয় স্থান
ঢাকা জেলা বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের প্রাণকেন্দ্র এবং দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই জেলা তার ঐতিহাসিক স্থাপনা, আধুনিক স্থাপত্য এবং শহুরে জীবনের বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। ঢাকার সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে লালবাগ কেল্লা, যা মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন; জাতীয় সংসদ ভবন, টাকা জাদুঘর, চিড়িয়াখানা এবং আহসান মঞ্জিল, যা ঢাকার জমিদার আমলের স্মৃতিচিহ্ন। এছাড়া, সদরঘাট, ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ ঢাকার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলিত রূপকে তুলে ধরে।